Sunday, January 25, 2015

হাসিনার জন্য খালেদার গেট বন্ধ!:কালের কন্ঠ

পুত্রশোকে কাতর খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে গিয়ে ফিরে আসতে হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। গত রাতে গাড়িবহর নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ের গেটে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নেমে ভেতরে ঢোকার জন্য অপেক্ষা করলেও গেট খোলা হয়নি। গেটের ওপারে বিএনপির সিনিয়র নেতারা দাঁড়িয়ে থাকলেও তাঁদের কেউ গেট খোলেননি বা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কোনো কথাও বলেননি। অগত্যা শেখ হাসিনা গাড়িতে উঠে ফিরে আসেন। এ ঘটনার মধ
্য দিয়ে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দুই নেত্রীর মধ্যে বরফ গলার একটা সুযোগ তৈরি হলেও শেষ পর্যন্ত তা নিষ্ফল হলো। বহু প্রত্যাশিত সাক্ষাৎটি হলো না শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যে। ফলে রাজনৈতিক সংকট সংকটের মধ্যেই রয়ে গেল। অনেকের মতে, শুধু তাই নয়, বরং তিক্ততা আরো এক দফা বাড়ল। গুলশান কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে কেন্দ্র করে গতকাল সন্ধ্যা থেকে নেতা-কর্মীসহ গোটা দেশবাসীর মধ্যে প্রত্যাশার পারদ বাড়তে থাকে। আর যখন প্রধানমন্ত্রী যাচ্ছেন- এ খবর মিডিয়ার মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে তখন এক ধরনের টানটান উত্তেজনাও তৈরি হয়। কারণ সারা দেশের মানুষের নজর তখন ছিল খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের দিকে। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী গুলশান কার্যালয়ের সামনে পৌঁছান রাত ৮টা ৩৫ মিনিটে। কিন্তু এর কয়েক মিনিট আগে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের ব্রিফিংয়েই স্পষ্ট হয়ে যায়- দুই নেত্রীর দেখা হচ্ছে না। শিমুল বিশ্বাস সাংবাদিকদের জানান, শোকাহত খালেদা জিয়াকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমবেদনা জানাতে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে আসার ইচ্ছা পোষণ করলেও খালেদা জিয়ার অসুস্থতার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। শিমুল বিশ্বাস আরো বলেন, খালেদা জিয়ার সুস্থতা সাপেক্ষে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরে একসময় দেখা হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়ি বহর গুলশান কার্যালয়ের গেটের সামনে পৌঁছে প্রথম চার মিনিট তিনি গাড়িতেই বসে ছিলেন। কিন্তু ভেতর থেকে গেট খোলার কোনো লক্ষণ নেই। পঞ্চম মিনিটে গাড়ি থেকে নেমে শেখ হাসিনা দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে থাকা মন্ত্রী আমীর হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদসহ কয়েকজন নেতা নেমে গুলশান কার্যালয়ের পকেট গেটের কাছে যান। তাঁরা এবং প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত এসএসএফ কর্মকর্তারা এ সময় গেটে কর্তব্যরত নিরাপত্তা (সিএসএফ) কর্মীদের জানান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এসেছেন। সিএসএফ কর্মকর্তারা দৌড়ে দোতলায় গিয়ে এ খবর দিলে শিমুল বিশ্বাস নেমে অপেক্ষারত নেতাদের বলেন, ‘ম্যাডাম ঘুমিয়ে আছেন। এখন দেখা হবে কিভাবে?’ শিমুল বিশ্বাস আরো বলেন, ‘ম্যাডাম সুস্থ হলে আপনাদের জানাব।’ এরপর মিনিটখানেক অপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি গণভবনের দিকে চলে যায়। এর আগে বিকেল থেকেই গুলশান কার্যালয়ে গুঞ্জন চলছিল, আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুতে তাঁর শোকাহত মা খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুলশান কার্যালয়ে যেতে পারেন। অবশেষে গুঞ্জন সত্যি হলো এবং প্রধানমন্ত্রী গেলেনও। কিন্তু দেখা হলো না খালেদা জিয়ার সঙ্গে। এ ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘এভাবে দরজা বন্ধ করে রাখা ভদ্রজনোচিত নয়। প্রধানমন্ত্রী একজন মা হিসেবে সমবেদনা জানাতে এসেছিলেন। এর মধ্যে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না।’ শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি, দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী ও বিশেষ সহকারী সাইফুজ্জামান শেখর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী হিসেবে আমি খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাসের সঙ্গে আগেই যোগাযোগ করেছিলাম। প্রধানমন্ত্রী এসে পৌঁছানোর পরও ফটক বন্ধ দেখে আবারও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে গেট খুলে দেওয়ার অনুরোধ করি। তাঁকে আমি বলি, প্রধানমন্ত্রী শোক জানিয়েই চলে যাবেন। কিন্তু শিমুল বিশ্বাস গেট খুলতে অপারগতা জানিয়ে বলেন, ম্যাডামের শরীর ভালো নেই। আমরা আপনাদের সঙ্গে পরে যোগাযোগ করব।’ আগেই নিরাপত্তা : গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের সদস্যরা খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের আশপাশের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে নেন। এসএসএফসহ অন্যান্য নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা এলাকায় অবস্থান নেন। এ সময় কার্যালয়ের বাইরে ও ভেতরে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ভিড় ছিল। শেখ হাসিনা পৌঁছানোর পরও বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ের প্রধান ফটকের পকেট গেটটিও ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। প্রধান ফটকের সামনে ভেতরের অংশে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত একটি গাড়ি দাঁড়ানো ছিল। এ সময় বিএনপির সিনিয়র নেতা আর এ গণি, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদসহ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা কার্যালয়ের ভেতরে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ফিরে যাওয়ার পর শিমুল বিশ্বাস আবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘ম্যাডাম যে ঘুমিয়ে আছেন, তা প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী সাইফুজ্জামান শেখরকে ৭টা ১০ মিনিটেই জানানো হয়েছিল। এরপর তাঁরা আর যোগাযোগ করেননি। তা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী আসার পর আমি শোকবই নিয়ে গেটে গেছি। তাঁরা এসেছেন, সম্মান জানিয়েছেন। তবে তাঁরা যদি সত্যি শোক প্রকাশ করে থাকেন, তাহলে তাঁদের অনুভূতিকে আমরা সম্মান জানাই। তবে ছেলের মৃত্যুতে খালেদা জিয়ার এই পরিস্থিতি নিয়ে কেউ যাতে রাজনীতি না করেন, সে অনুরোধ জানাচ্ছি। আমরা বলেছি, ম্যাডাম ঘুম থেকে উঠলে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে প্রধানমন্ত্রীর সহকারীকে পরবর্তী সময়ে যাতে দেখা হয়, দরকার হলে তা করব।’ প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ : এদিকে রাত ১১টার দিকে খালেদা জিয়ার প্রেসসচিব মারুফ কামাল খান সাংবাদিকদের বলেন, রাত পৌনে ১১টার দিকে বেগম জিয়া ঘুম ভাঙলে তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর আগমনের বিষয়টি জানানো হয়। খালেদা জিয়া এখন কেমন আছেন- জানতে চাইলে প্রেসসচিব বলেন, ‘বর্তমানে ম্যাডামের অবস্থা ভালো না। আপনারা জানেন, শোকগ্রস্ত অবস্থায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তখন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ আনা হয়েছিল। তাঁরা তাঁকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন। তিনি ঘুম থেকে উঠে জানার পর প্রধানমন্ত্রীকে আসার জন্য ধন্যবাদ জানান।’ বেগম জিয়া তাঁর ছোট ছেলের জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন বলেও জানান প্রেসসচিব। প্রধানমন্ত্রীকে কার্যালয়ে ঢুকতে দেওয়া হয়নি এই অভিযোগের জবাবে প্রেসসচিব বলেন, ‘এটা ঠিক নয়। কারণ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে আগেই খালেদা জিয়ার মানসিক অবস্থা জানানো হয়েছিল। এর পরও আমরা বুঝে ওঠার আগেই শুনলাম তিনি এসে চলে গেছেন।’ খালেদা জিয়ার রুমের দরজা বন্ধ ছিল : বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান এবং জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রবসহ আরো অনেক নেতা সন্ধ্যা থেকে গুলশান কার্যালয়ের দোতলায় ছিলেন। তাঁরা জানান, কান্নাকাটির একপর্যায়ে খালেদা জিয়া প্রায় অচেতন হয়ে পড়েন। ওই অবস্থায় ডাক্তার তাঁকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে অন্তত ৮ ঘণ্টা বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দেন। এরপর নিজের রুমে খালেদা জিয়া ঘুমিয়ে পড়েন। তাঁর রুমের দরজা বন্ধ ছিল। আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘প্রকৃত অর্থে তিনি অসুস্থ ছিলেন। ওই অবস্থায় তাঁর সঙ্গে দেখা করা সম্ভবপর ছিল না।’ উপস্থিত আরেক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে জানান, আসলে দরজা বন্ধ থাকায় ওই দরজা খুলতে বলার মতো সাহসই কারো ছিল না। অন্যদের মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আর এ গণি, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, বেগম সারোয়ারী রহমান, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, সেলিমা রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনসহ আরো অনেকে রাতে গুলশান কার্যালয়ের দোতলায় অবস্থান করেন। তাঁদের কেউই খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হকও খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে পারেননি বলে জানা গেছে। শোক নিয়ে রাজনীতি না করার অনুরোধ : আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর শোক নিয়ে কোনো পক্ষকে রাজনীতি না করার অনুরোধ জানিয়েছেন খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস। গতকাল রাতে প্রধান ফটকে তালা পেয়ে প্রধানমন্ত্রী ফিরে যাওয়ার পর বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের কাছে তিনি এ অনুরোধ জানান। তিনি দাবি করেন, প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে রওনা দেওয়ার আগেই খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা জানানো হয়েছিল।

No comments:

Post a Comment