সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৫ জানুয়ারি সমাবেশ করা নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপি মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। একই দিনে কর্মসূচি সফল করা নিয়ে দু’দলই অনড়। যে কোনো মূল্যে ওইদিন রাজপথ দখলে রাখতে মরিয়া উভয় দল। কেউ ছাড় দিতে রাজি নয়। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সরকার অনুমতি না দিলেও তারা মহাসমাবেশ করবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের বক্তব্য বিএনপিকে ওইদিন রাজপথেই নামতে দেয়া হবে না। সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ এক হ
য়ে বিএনপিকে মোকাবেলা করছে বলে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা অভিযোগ করেন। এ পরিস্থিতিতে ৫ জানুয়ারির ডেটলাইনকে কেন্দ্র করে নতুন বছরের শুরুতেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে রাজপথ। বড় দুই দলের এমন মুখোমুখি অবস্থানে সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। সবার দৃষ্টি এখন ৫ জানুয়ারির দিকে। কী হবে এ দিন এমন প্রশ্ন প্রায় সবার মুখে। দিবসটিকে ‘গণতন্ত্রের হত্যা দিবস’ আখ্যা দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, শাপলা চত্বর বা নয়াপল্টন যে কোনো একটি স্থানে সমাবেশের অনুমতি চেয়েছে বিএনপি। অনুমতি না দিলেও তারা সমাবেশ করবে। একই সঙ্গে কালো পতাকা হাতে খালেদা জিয়া রাজপথে নেমে আসবেন। তাকে যেখানে বাধা দেয়া হবে নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি সেখানেই বসে পড়বেন। সেখান থেকেই সারা দেশের নেতাকর্মীদের রাজপথে বসে যাওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন এমন পরিকল্পনাও আছে দলের হাইকমান্ডের। রাজপথে নামতে দেয়া না হলে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে টানা ৭২ ঘণ্টা হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করবে বিএনপি। এদিকে ৫ জানুয়ারিকে ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ আখ্যা দিয়ে ওইদিন রাজধানীতে সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ঢাকার ১৬টি পয়েন্ট থেকে র্যালি করবে। সারা দেশে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা ও র্যালি বের হবে। মোড়ে মোড়ে পুলিশ ও সরকারি দলের নেতাকর্মীরা সতর্ক অবস্থায় থাকবে। বিএনপির হুমকি-ধমকিকে তারা পাত্তাই দিচ্ছে না। আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বিএনপিকে কাগুজে বাঘ হিসেবেও আখ্যায়িত করেন। এদিকে বিএনপিকে মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। নাশকতার অভিযোগ এনে সক্রিয় নেতাদের তালিকা তৈরি শেষে তাদের গ্রেফতারে চালাচ্ছে চিরুনি অভিযান। সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, যদি নাশকতার কোনো আশঙ্কা থাকে তবে বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হবে না। সারা দেশে দলীয় সংসদ সদস্য ও জেলা নেতাদের সতর্ক অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে আওয়ামী লীগ। সংশ্লিষ্টদের মতে, ৫ জানুয়ারি রাজপথ দখলে রাখার রণকৌশল চূড়ান্ত করছে উভয় দল। প্রতিপক্ষকে ঘায়েলেও নেয়া হচ্ছে ব্যাপক প্রস্তুতি। ওইদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ব্যাপক শোডাউনের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি রাজধানীসহ আশপাশের জেলা থেকেও নেতাকর্মীদের ঢাকায় আসার নির্দেশ দিয়েছে বলে জানা গেছে। বিএনপিকে সমাবেশ করতে দেয়া হোক বা না হোক ওইদিন রাজধানীতে তারা ব্যাপক শোডাউন করবে দলের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের বাধা দিলে পাল্টা আঘাতেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে নেতাকর্মীরা। ৫ জানুয়ারিতে করণীয় নিয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহানগর আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন খালেদা জিয়া। দলের পাশাপাশি জোটের নেতাদেরও ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তুতি সভা করতে না পারায় নেয়া হচ্ছে প্রযুক্তির সহায়তা। নেতাকর্মীদের ‘ক্ষুদে বার্তার’ মাধ্যমে দলের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগের প্রস্তুতি : ৫ জানুয়ারি ঘিরে সব ধরনের নৈরাজ্য রোধে কঠোর পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। ইতিমধ্যে বিএনপি এবং জামায়াতের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার অভিযান শুরু হয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা যুগান্তরকে জানিয়েছেন, গণতন্ত্রের বিজয় দিবসে রাজধানী ঢাকায় বিরোধী পক্ষকে সমবেত হওয়ার কোনো সুযোগ দেয়া হবে না। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে তাদের দমনে প্রশাসনিক এবং দলীয় সম্ভাব্য সব কিছু কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করেছে ক্ষমতাসীনরা। ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ উপলক্ষে ৫ জানুয়ারি ঢাকাসহ সারা দেশে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা ও আনন্দ র্যালি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। ওই দিন বেলা আড়াইটায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া রাজধানীর ১৬টি পয়েন্টে জড়ো হয়ে র্যালি করবে আওয়ামী লীগ। এজন্য প্রস্তুতি চূড়ান্ত করা হয়েছে। দিবসটি পালন উপলক্ষে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ বৃহস্পতিবার বর্ধিত সভা করে। সেখানে দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেন। একই উদ্দেশ্যে শুক্রবার রাজধানীর দলীয় এমপি ও থানা নেতাদের নিয়ে যৌথ সভা করেছে আওয়ামী লীগ। এ সভায় দলের কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বিএনপি নেতারা ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ পালনের ঘোষণা দিয়েছেন। এ দিন তারা রাজধানী ঢাকায় সমাবেশ করার লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি স্থানে কর্মসূচি পালনের অনুমতি চেয়েছে। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একজন নীতিনির্ধারক শুক্রবার যুগান্তরকে জানিয়েছেন, বিএনপিকে সমাবেশ তো দূরে থাক ঢাকার রাস্তায় নামতেই দেয়া হবে না। মোড়ে মোড়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান করবেন। পুলিশও থাকবে সতর্কাবস্থায়। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, নাশকতার আশংকা থাকলে ৫ জানুয়ারি ঢাকায় বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হবে না। বিষয়টি নিয়ে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে বলেও জানান তিনি। শুক্রবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অষ্টম হজ ও ওমরা মেলা উদ্বোধনের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি। আগের দিন বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বিএনপিকে প্রতিহত করার ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, ৫ তারিখ ঢাকা শহর হবে আমাদের। আমাদের প্রস্তুতি হতে হবে এমন, ওই দিন যারা কালো দিবস পালন করতে চায় তাদের জন্য সে দিন হবে কান্নার দিবস। সেই ব্যবস্থা করতে হবে। মায়া বিএনপিকে রুখতে তার দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘দিনের পবিত্রতা রক্ষা করার দায়িত্বও আমাদের।’ ৫ জানুয়ারির বিএনপির কর্মসূচির বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ এমপি শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, আমরা বলতে পারি যারা এই কাগুজে বাঘ-মিডিয়া বাঘ, তারা মিডিয়াতে হংকার দিচ্ছেন। আপনারা ৫ তারিখে তাদের খুঁজে পাবেন না। গত বছর ৫ জানুয়ারি বিএনপিবিহীন যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তা সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষায় অপরিহার্য ছিল বলে আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন। এ দিন ঢাকাসহ সারা দেশে অনুষ্ঠিত মিছিল ও সভা-সমাবেশে সরকারের বিভিন্ন সফলতা তুলে ধরা হবে। সর্বাত্মক প্রস্তুতি বিএনপির : আগামী ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তিকে কেন্দ্র করে ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। দিনটিকে আন্দোলনের এসিড টেস্ট হিসেবে নিয়েছে দলটি। ৫ জানুয়ারিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে ৩ জানুয়ারি জনসভা করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে বিএনপি। স্থগিত করা হয়েছে শুক্রবারের ছাত্রদলের সমাবেশও। ৫ জানুয়ারিকে ‘গণতন্ত্রের হত্যা দিবস’ আখ্যা দিয়ে সোহওয়ার্দী উদ্যানসহ ঢাকার তিনটি স্থানে সমাবেশের অনুমতি চেয়েছে দলটি। অনুমতি পাওয়া এবং না পাওয়াকে কেন্দ্র করে দু’ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটির হাইকমান্ড। প্রথমত : ওই দিন যেকোনো মূল্যে রাজপথে নামাকেই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সরকার সমাবেশের অনুমতি না দিলে বিকল্প পন্থায় গণজমায়েতের সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে বিএনপি জোট। নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও আশপাশে নেতাকর্মীদের জড়ো হওয়ার নির্দেশ দেয়া হবে। নেতাকর্মীদের একটি অংশকে খালেদা জিয়ার গুলশানে বাসার আশপাশে জমায়েত হতে বলা হবে। খালেদা জিয়া কালো পতাকা হাতে বাসা থেকে বের হওয়ার পর ব্যাপক শোডাউন করে তিনি নয়াপল্টনের দিকে রওনা হবেন। যেখানে বাধা দেয়া হবে সেখানেই বসে পড়তে পারেন তিনি। একই সঙ্গে সারা দেশের নেতাকর্মীদের রাজপথে অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দিতে পারেন খালেদা জিয়া। দ্বিতীয়ত : শেষ পর্যন্ত সরকার যদি খালেদা জিয়াকে বাসা থেকে বের হতে না দেন এবং সিনিয়র নেতাদের গ্রেফতার শুরু করে সে ক্ষেত্রে করণীয় চূড়ান্ত করা হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ৪ জানুয়ারি রাতেই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করা হতে পারে। ৫ জানুয়ারি থেকে টানা ৭২ ঘণ্টার হরতাল দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। ৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া বিশ্ব ইজতেমার সময়টুকু বাদ দিয়ে আবার শুরু হবে হরতাল বা অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি। সূত্র জানায়, ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে মহানগর বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দলসহ সব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রস্তুতির অংশ হিসেবে স্থগিত করা হয় শুক্রবার সোহরাওয়ার্দীতে ছাত্রদলের সমাবেশ। কেন্দ্র ছাড়াও দেশের সব মহানগর, জেলা ও উপজেলা নেতাদের ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বাত্মক সতর্ক থাকতে তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অনুমতি না পেলেও ৫ জানুয়ারি রাজধানীতে সমাবেশ করা হবে এমন মন্তব্য করে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, ‘আমরা ৫ তারিখে (জানুয়ারি) ঢাকায় গণতন্ত্র হত্যা দিবসের সমাবেশ করব। অনুমতি দেবে কি দেবে না, তা সরকারের বিষয়। আমাদের যা করণীয়, তা আমরা করব।’ শুক্রবার বিকালে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে ঢাকায় ৫ জানুয়ারি ‘যেকোনো মূল্যে’ জনসভা করার ঘোষণা দেন দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, ‘দৃঢ়তার সঙ্গে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে আমরা বলতে চাই, ৫ জানুয়ারি আমরা কর্মসূচি করবই।’ আর এ কর্মসূচি করতে সরকারের সহযোগিতা চেয়ে রিজভী বলেন, আমরা বারবার অঙ্গীকার করছি, ৫ জানুয়ারি ২০ দলীয় জোটের জনসভা হবে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ। আমরা এ জনসভায় আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সার্বিক সহযোগিতা চাই। সরকার কর্মসূচির অনুমতি না দিলে কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনুমতি না দিলে সে ক্ষেত্রে আমাদের কর্মসূচি দিতেই হবে। এ জন্য সরকারকেই দায় নিতে হবে।
No comments:
Post a Comment