অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ বিমানের ট্রেনিং বিভাগ। সংস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিভাগ হলেও এখানে চলছে চরম অরাজকতা। অনিয়ম-দুর্নীতি আর লুটপাটের সুবিধার জন্য এই বিভাগের শীর্ষ পদগুলোতে একের পর এক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে অযোগ্য, অদক্ষ জুনিয়র পাইলটকে। ২৮ জন সিনিয়রকে ডিঙিয়ে ট্রেনিং বিভাগের প্রধান বানানো হয়েছে ইলিয়াস উদ্দিন আহমেদ নামে বিমানের সবচেয়ে অদক্ষ হিসেবে পরিচিত একজন জুনিয়র ক্যা
প্টেনকে। সিভিল এভিয়েশনের র্যাংকিং অনুযায়ী ক্যাপ্টেন ইলিয়াস কোনোভাবেই বিভাগীয় প্রধান হওয়ার যোগ্য নন। সংস্থার পরিচালক ফ্লাইট সেফটি অ্যান্ড রেগুলেশন গ্র“প ক্যাপ্টেন এসএম নাজমুল আনাম সম্প্রতি বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে এক চিঠিতে বলেছেন, কম যোগ্যতাসম্পন্ন পাইলটকে দিয়ে বিমানের ট্রেনিং বিভাগ সাজানো হচ্ছে, যা বিমানের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। শুধু বিভাগীয় প্রধানই নন, এই বিভাগের ডেপুটি প্রধান করা হয়েছে আরেক অযোগ্য ও অদক্ষ ফার্স্ট অফিসার শামীম নজরুল শামীমকে। সম্প্রতি বিমানের সোনা চোরাচালান মামলার প্রধান আসামি ও গডফাদার পলাশের জবানবন্দিতে এই শামীম নজরুলকে তাদের অন্যতম সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই অভিযোগে সম্প্রতি তাকে পদত্যাগ করতে বলা হলেও শীর্ষ ম্যানেজমেন্ট রহস্যজনক কারণে এখনও তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেনি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ঘুষ না দেয়ায় তিনি ৮ জন ক্যাডেট পাইলটকে ট্রেনিং না করিয়ে গত ৪ বছর বসিয়ে রেখেছেন। অপরদিকে পাইলট সংকট দেখিয়ে শত কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ করে বিদেশী পাইলট নিয়োগ দিয়েছেন। ক্যাডেট বৈমানিকরা তাদের ট্রেনিংয়ের জন্য উচ্চ আদালতে মামলা করলেও তা তোয়াক্কা করেননি শামীম। জানা গেছে, বর্তমানে বিমানের ফ্লাইট অপারেশন ও ট্রেনিং বিভাগ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। অদক্ষ ও অযোগ্যতার অভিযোগ এনে সম্প্রতি পরিচালক ফ্লাইট অপারেশন (ডিএফও) ক্যাপ্টেন তোফায়েল আহম্মেদের লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশও করেছে সিভিল এভিয়েশনের নিযুক্ত বিদেশী ইন্সট্রাক্টর ক্যাপ্টেন মারিও ডি বরোডা। একই সঙ্গে ক্যাপ্টেন তোফায়েলসহ কো-পাইলট শামীম নজরুলকে প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটসহ সব ধরনের ভিভিআইপি ফ্লাইট থেকে অফলোড করার সুপারিশ করেছেন। বিমানবন্দরে কর্মরত একটি গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে, ক্যাপ্টেন ইলিয়াসের পরিবার মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিল। এমন এক পরিবারের সদস্যকে কিভাবে বিমানের ট্রেনিং বিভাগের প্রধান করা হয়েছে তা নিয়েও ওই রিপোর্টে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ট্রেনিং বিভাগের ডেপুটি চিফ শামীম নজরুল এখন বিমানের অঘোষিত গডফাদার। সম্প্রতি ম্যানেজমেন্টের অনুমোদন ছাড়াই তার বিরুদ্ধে গোপনে লন্ডনে গিয়ে ট্রেনিং নেয়া এবং এটিপিএল (এয়ারক্রাফট পাইলট লাইসেন্স) লাইসেন্সের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এয়ারলাইন্স বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, একজন ফার্স্ট অফিসার হয়েও গোপনে এটিপিএল ট্রেনিং করা এবং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করা চাকরির শৃঙ্খলা ভঙ্গজনিত অপরাধ। এই অভিযোগে তাকে চাকরিচ্যুত করা যায়। বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) বলছে, শামীম নজরুলের মতো ফার্স্ট অফিসার এটিপিএল লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্য নন। কেবল সিনিয়র পাইলটরাই সংস্থার অনুমোদন সাপেক্ষে নির্ধারিত ঘণ্টা ফ্লাই করার পর এ ধরনের লাইসেন্সের জন্য ট্রেনিং নিতে পারেন। সাধারণত লন্ডন ও সিঙ্গাপুরে এ ধরনের ট্রেনিং হয়ে থাকে। এটিপিএল লাইসেন্স পেতে হলে সংশ্লিষ্ট পাইলটকে রুট ট্রেনিংসহ ৮টি সেশনে পাস করতে হয়। শামীম নজরুল পাস করেছেন মাত্র দুটিতে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শামীম নজরুলকে এটিপিএল লাইসেন্স দেয়ার জন্য বিমানের ট্রেনিং শাখার প্রধান ক্যাপ্টেন ইলিয়াস বেবিচককে চিঠি দিয়েছেন। সিভিল এভিয়েশন বলছে, ক্যাপ্টেন ইলিয়াসের ফ্লাইয়িং রেকর্ড খুবই নিুমানের। এছাড়া তার বিরুদ্ধে উড়োজাহাজ দুর্ঘটনাসহ বহু অভিযোগ আছে। সিভিল এভিয়েশনের সংশ্লিষ্টদের মতে, ম্যানেজমেন্টের অনুমোদন ছাড়া কার নির্দেশে ক্যাপ্টেন ইলিয়াস এ ধরনের চিঠি পাঠিয়েছেন তার তদন্ত দরকার। তাছাড়া কার নির্দেশে শামীম নজরুল ট্রেনিং করেছেন এবং বিমানকে আর্থিক ক্ষতির মুখে ফেলেছেন সেটারও তদন্ত চায় তারা। শামীম নজরুলের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, তিনি কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই এবং সব গোয়েন্দা সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী একটি ফ্লাইট উড্ডয়ন (টেকঅফ) করেছিলেন। কিছুদিন আগে রাশিয়ার বেলারুশ সফর শেষে দেশে ফেরার পথে বিমানের ওই ফ্লাইটটি রহস্যজনক কারণে ঝুঁকিপূর্ণভাবে টেকঅফ করেন শামীম। আর এ ঘটনায় তাকে সহযোগিতা করায় পুরস্কার হিসেবে ক্যাপ্টেন তোফায়েলকে পরে ডিএফও হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ওই ফ্লাইটের চিফ পাইলট ছিলেন ক্যাপ্টেন তোফায়েল আহম্মেদ। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ হচ্ছে, রহস্যজনক কারণে ওই ঘটনায় শামীম ও তোফায়েলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো বিষয়টি ধামাচাপা দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, প্রধানমন্ত্রী বিমানের কোনো ফ্লাইটে থাকলে কো-পাইলট শামীম নজরুল প্রায়ই ককপিট থেকে বেরিয়ে এসে প্রধানমন্ত্রীর কেবিনের আশপাশে রহস্যজনকভাবে ঘোরাফেরা করেন। এ অভিযোগে পরবর্তীকালে তাকে প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটসহ সব ধরনের অনুষ্ঠান থেকে অফলোড করা হয়। জানা গেছে, পাইলট ট্রেনিং মনিটরিং করতে বেবিচক নিযুক্ত বিদেশী ইনসট্রাক্টর মারিও আর বরডা সম্প্রতি এক ই-মেইল বার্তায় বলেছেন, বিমানের পরিচালক ফ্লাইট অপারেশন (ডিএফও) ক্যাপ্টেন তোফায়েল আহম্মেদের ফ্লাইট পরিচালনা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। ফ্লাইট সেফটি সংক্রান্ত ১৫টি মারাত্মক তথ্য তুলে ধরে মারিও অবিলম্বে ক্যাপ্টেন তোফায়েলের পাইলট লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করেন। তিনি বলেছেন, ২০১৩ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক ট্রেনিংয়ে ক্যাপ্টেন তোফায়েল সবকিছুতে ফেল করলেও বিমানের ডেপুটি চিফ অব ট্রেনিং ক্যাপ্টেন শামীম নজরুল অতিরিক্ত সময় দিয়ে ক্যাপ্টেন তোফায়েলকে জোর করে পাস করাতে সহায়তা করেন। যে কোনো এয়ারলাইন্সের জন্য এটি ভয়ঙ্কর ও মারাÍক ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার। ১৬ নভেম্বর মারিও ডি বোরডা সিভিল এভিয়েশনের পরিচালক ফ্লাইট সেফটি গ্র“প ক্যাপ্টেন নাজমুল আনামকে এই চিঠি পাঠান। নাজমুল আনাম চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করে যুগান্তরকে বলেন, চিঠিটি খুবই সিগনিফিকেন্ট ও স্পর্শকাতর। চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রীয় ভিভিআইপিদের ফ্লাইট পরিচালনার বিষয়েও বেশ কিছু সুপারিশ আছে। বোরডার মেইলে বলা হয়েছে, ডিএফও ক্যাপ্টেন তোফায়েল ১৪ নভেম্বর ৩০০ যাত্রী নিয়ে মালয়েশিয়া-ঢাকার একটি ফ্লাইট অবতরণের সময় ফ্লাইট ম্যানুয়েলের নিয়ম-কানুন না মেনেই ফ্লাইট অবতরণ করিয়েছিলেন। টেক্সিওয়ে (হোটেল সাইড) বন্ধ থাকার পরও তিনি ৮৯ নটিক্যাল মাইল বেগে ফ্লাইটটি ওই ট্যাক্সিওয়েতে ঢুকিয়ে দেন। পরে ক্যাপ্টেন জামান চিৎকার করে গতিরোধ করান। বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, বিমানের ট্রেনিং শাখার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ জমা আছে সিভিল এভিয়েশন ও আইকাওর কাছে। এগুলোর মধ্যে অর্থের বিনিময়ে পাইলট-ফার্স্ট অফিসারকে ট্রেনিংয়ে পাঠানো, সিনিয়রিটি লঙ্ঘন করা, পছন্দের প্রার্থী না হলে তাকে ট্রেনিংয়ে ফেল করানো, একাধিকবার ফেল করা ও দুর্ঘটনা ঘটানো পাইলট ও ফার্স্ট অফিসারকে অর্থের বিনিময়ে পাস করানো, নারী কেলেংকারি, ১৮ ক্যাডেট পাইলটকে ৪ বছরেও ট্রেনিং না করিয়ে নতুন করে ১৬ ফার্স্ট অফিসার নিয়োগ, উচ্চ আদালতের নির্দেশ লঙ্ঘন করে অর্থের বিনিময়ে পাইলট নিয়োগ, বিভিন্ন বিভাগের ডেপুটি চিফদের দিয়ে ফার্স্ট অফিসার নিয়োগের যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন অন্যতম। এদিকে ২০১০ সালে নিয়োগ পাওয়া ১৮ ক্যাডেট বৈমানিকের মধ্যে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ৮ জনকে এখনও ট্রেনিং না করিয়ে নতুন করে আরও ১৬ ফার্স্ট অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ বলছে, বিমান বোর্ড সভার নির্দেশ অনুযায়ী তারা ৮ জন ক্যাডেট পাইলটকে অধিকতর ট্রেনিং করিয়ে বিমানের ৭৩৭ উড়োজাহাজে নিয়োগ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু শামীম ও ইলিয়াস সিভিল এভিয়েশনের এই নির্দেশনা অমান্য করেছেন। বেবিচকের নির্দেশের পরও গত ৭ মাসে তাদের ট্রেনিং করানো হয়নি। নতুন করে নিয়োগের বিষয়ে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও শামীম-ইলিয়াস সিন্ডিকেট তা অমান্য করেছে। অভিযোগ রয়েছে, এই সিন্ডিকেট বিমানে কৃত্রিম পাইলট সংকট তৈরি করে জনপ্রতি ৫০ লাখ টাকা বেতনে ৬ জন বিদেশী পাইলট নিয়োগ দিয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে বিদেশী পাইলট নিয়োগ দিয়ে শামীম-ইলিয়াস সিন্ডিকেট শত কোটি টাকার বেশি অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন মোসাদ্দিক আহম্মেদ যুগান্তরকে জানান, চিফ অব ট্রেনিং ও ডেপুটি চিফ অব ট্রেনিংয়ের নিয়োগ তার আমলে হয়নি। বিমানের সাবেক এমডি কেভিন স্টিল তাদের নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, ক্যাপ্টেন ইলিয়াস ও ক্যাপ্টেন শামীম নজরুলের অযোগ্যতা ও অদক্ষতা সম্পর্কে কোনো অভিযোগ তার জানা নেই। অবশ্য ট্রেনিং বিভাগের মান নিয়ে বেবিচকের কাছ থেকে কয়েকটি চিঠি তিনি পেয়েছেন বলে জানান। এসব চিঠিতে ৮ জন ক্যাডেট বৈমানিকের ট্রেনিং করানোর বিষয় উল্লেখ ছিল। বিমানের এমডি বলেন, ডেপুটি চিফ অব ট্রেনিং পদ থেকে ক্যাপ্টেন শামীম নজরুলের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়েছে। তবে পরিচালক ফ্লাইট অপারেশনের (ডিএফও) কারণে শামীম নজরুলের পদে এখনও অন্য কাউকে স্থলাভিষিক্ত করা যাচ্ছে না। ডিএফও’র সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি সুরাহা করবেন বলে যুগান্তরকে নিশ্চিত করেন ক্যাপ্টেন মোসাদ্দিক।
No comments:
Post a Comment