Friday, January 16, 2015

উদ্বেগ–আতঙ্কে মানুষ, বিপর্যস্ত নিম্নবিত্ত:প্রথম অালো

চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংস পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। বেশি বেকায়দায় পড়েছে নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। টানা অবরোধ ও হরতালে ফুটপাতের দোকানদার থেকে শুরু করে খেটে খাওয়া মানুষের আয়ের পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। নিম্নমধ্যবিত্ত আর মধ্যবিত্ত মানুষ কর্মস্থলের উদ্দেশে পথে বের হয়ে যানবাহনে উঠছেন আতঙ্ক নিয়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানদের পাঠাতে ভয় প
াচ্ছেন, আবার পাঠিয়ে থাকছেন উৎকণ্ঠায়। গতকাল বৃহস্পতিবার ও আগের দুই দিন রাজধানীতে নানা মানুষের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। গতকাল দৈনিক বাংলা মোড়ে ফুটপাতে প্লাস্টিকের টুলে বসে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিলেন শরীয়তপুরের সিকান্দার হোসেন। সামনে শীতের কাপড়ের পসরা। বেলা গড়িয়ে গেছে। স্বাভাবিক দিনে এ সময় ‘বাইছ্যা লন ১০০, যা লইবেন ১০০’ জপতে জপতে দম ফেলার ফুরসত থাকে না তাঁর। কিন্তু অবরোধ-হরতালের কারণে গতকাল রাস্তা আধা ফাঁকা। মাঝেমধ্যে দু-একটি বাস, ব্যক্তিগত গাড়ি আর কিছু রিকশা চলছে। ফুটপাতেও লোক চলাচল কম। এ কারণে তাঁর পসরার সামনেও ক্রেতা নেই। অলস সময়ে তাই পত্রিকায় চোখ বোলানো। প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা বিক্রি হয় সিকান্দারের দোকানে। তাতে আয় হয় সাত শ থেকে হাজার টাকা। থাকেন দক্ষিণ মুগদায়। পাঁচজনের সংসার, মোটামুটি চলে যায়। গতকাল বিকেল চারটায় যখন তাঁর সঙ্গে কথা হয়, তখন পর্যন্ত সাকল্যে বিক্রি ২২৫ টাকা। লাভ দূর অস্ত, দুপুরের খাবারের খরচই ওঠেনি। তাঁর পাশেই জুতা-স্যান্ডেল বিছিয়ে বসেছেন বিক্রমপুরের সুমন রহমান। তাঁর অবস্থা আরও খারাপ। বউনিই হয়নি। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ জোড়া জুতা-স্যান্ডেল বিক্রি হয়। আরও খানিকটা এগিয়ে হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন ভবনের পাশে ফলের পসরা। সেখানে থাই কাঁচামিঠা আম, রাঙামাটির বারোমাসি কাঁঠাল, থাইল্যান্ডের রামবুটান, ম্যাঙ্গেস্টিন, দেশি কুল, পেয়ারা, সফেদা, কতবেল, পেঁপে প্রভৃতির সম্ভার সাজিয়ে মুখ বেজার করে বসে ফলের ওপর বসা মাছি তাড়াচ্ছিলেন খায়রুল ইসলাম। কথা বলারই আগ্রহ নেই তাঁর। একরাশ হতাশা নিয়ে বললেন, ‘এইভাবে ক্যামেন জীবন চলে কন দেহি। হারাডা দিন বইস্যা রইচি, ৫০০ টাকা বেচতে পারি নাই।’ কাপড় বিক্রেতাদের তবু রক্ষা, তাঁদের পণ্য পচনশীল নয়। ফল বিক্রেতাদের সমস্যা হলো দ্রুত বিক্রি না হলে ওজন কমে যায়, পচে যায়। এক কেজি রাম্বুটানের দাম ৫০০ টাকা। বিক্রি করে লাভ ৫০ টাকার মাতো। পচে গেলে পুরো লোকসান। বছরের শুরু থেকেই হরতাল-অবরোধে বিক্রিবাট্টা অনেক কমে গেছে তাঁদের। রাজধানীর এমন কোনো পথ নেই, যার ফুটপাতে বিক্রেতারা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন না। হরতাল-অবরোধে এই বিপুলসংখ্যক অল্প পুঁজির কারবারিরা বিপর্যস্ত। প্রতিদিনের বিক্রির ওপর নির্ভর করে তাঁদের সংসার চলে। অনেকেই পুঁজি সংগ্রহ করেছেন ঋণ করে। সেই ঋণের কিস্তি শোধ করতে হয়। তাঁদের কয়েকজন জানালেন, বিক্রি পড়ে যাওয়ায় দুর্মূল্যের বাজারে তাঁদের বেগ পেতে হচ্ছে সংসার চালাতে। শ্রমজীবী মানুষের অবস্থা আরও শোচনীয়। বিকেলে শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের সামনের ফুটপাতে রিকশাভ্যানের ওপর শুকনো মুখে বসে ছিলেন জামালপুরের হেকমত আলী, হামিদ মিয়া ও তাঁদের কয়েকজন সঙ্গী। তাঁরা রিকশাভ্যানে করে এই মার্কেটের পাইকারি মালামাল আনা-নেওয়া করেন। দিনমজুরির কাজও করেন। গতকাল মার্কেটে মালামাল আনা-নেওয়া হয়নি। দিনমজুরির কাজও জোটেনি। একই দশা বিভিন্ন পেশার এই শ্রেণির মানুষদের। আতঙ্কের জীবন: বছরের শুরুতেই রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রাজধানীর অনেক অভিভাবক সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন। জানিসুর রহমান নামের এক অভিভাবক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর দুই মেয়ে দুটি বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়ে। কিন্তু এ বছর এখনো বিদ্যালয়ে পাঠাতে পারেনিন। বললেন, ক্ষতি হলেও এ অবস্থায় মেয়েদের বিদ্যালয়ে দিতে ভয় পাচ্ছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিদ্যালয় খোলা রাখা হলেও ক্লাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম। বর্তমানে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত দেশে মোট শিক্ষার্থী প্রায় ৪ কোটি ৪৪ লাখ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আরও অন্তত ২৫ লাখ শিক্ষার্থী পড়েছেন একই সমস্যায়। এর মধ্যে ২১ লাখ শিক্ষার্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে পড়াশোনা করছেন। সবার ক্ষেত্রেই কমবেশি সমস্যা হচ্ছে। ৫ জানুয়ারি সামনে রেখে বিএনপির কর্মসূচিকে ঘিরে ওই দিন থেকে অস্থিরতা শুরু হয়। সেদিন নগরে গণপরিবহন প্রায় চলেনি। পরদিন থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধের ডাক দেয় বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট। এর মধ্যে গতকাল ছিল সকাল-সন্ধ্যা হরতাল। এর আগে দেশের বিভিন্ন স্থানে হরতাল হয়েছে। গত ১১ দিনে সারা দেশে ২৩ জন নিহত হয়েছেন এবং ৪২৯টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়। সহিংসতার কারণে চাকরিজীবীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন নারী কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, গাড়িতে বোমা ও অগ্নিসংযোগের কারণে প্রতিদিন অফিসে যাতায়াতের সময় ভয় হয়। তেজগাঁওয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন হাসান দাউদ চৌধুরী। তিনি বলেন, তাঁর বাসা কাঁঠালবাগান। অফিসে যাওয়ার সময় উদ্বেগে থাকেন। বিশেষ করে সাতরাস্তা মোড়ের কাছে ভয় বেশি হয়। কারণ, এখানে ককটেল হামলার খবর শুনেছেন। শুধু যাওয়া-আসা নয়, কাজের লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ করতে পারছেন না। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে কথা হয় দুই ব্যক্তির সঙ্গে। কাছেই ছিল একটি অ্যাম্বুলেন্স। জানালেন, তাঁদের এক আত্মীয় নীলফামারীতে মারা গেছেন। এ জন্য নীলফামারী যেতে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করেছেন। অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া গুনতে হবে ১৮ হাজার টাকা। অথচ পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে যেতে খরচ হতো বড়জোর চার-পাঁচ হাজার টাকা। তবে টাকার চেয়েও বড় দুশ্চিন্তা হলো রাস্তায় কোনো অঘটন ঘটে কি না। রাতে পরীক্ষা: হরতালের কারণে ইংরেজি মাধ্যম ‘ও’ লেভেলের গতকালের পরীক্ষার সময় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা ও পৌনে ১২টায় নির্ধারণ করা হয় আগেই। ব্রিটিশ কাউন্সিল বাংলাদেশের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, হরতাল হলে তাঁরা এভাবেই পরীক্ষা নেন। কারণ, এ পরীক্ষা বিশ্বব্যাপী একই দিনে হয়।

No comments:

Post a Comment