Sunday, February 1, 2015

৫১ রোগীর ১৫ জন সংকটাপন্ন:কালের কন্ঠ

'ও মা, ও আল্লাহ, আর পারি না'- বিশেষ ওয়ার্ডের বারান্দায় তিনটি কাঁথা দিয়ে ঢেকে রাখা রাশেদের গোঙানি আর থামে না। স্ত্রী রায়হানা বেগম ও শাশুড়ি বিবি মরিয়ম চেপে ধরে আছেন তাঁকে। তবু জ্বরে কাঁপছিলেন রাশেদ। স্বামীর কষ্টে রায়হানার দুই চোখ বেয়ে গড়িয়ে নামছিল পানি। অবস্থা জানতে চাইলে বলেন, 'ওরা আমার সব শেষ কইরা দিছে। পোড়া মানুষটা জ্বরে কষ্ট পাইতাছে।' ট্রাকের হেলপার রাশেদ (২৬) গত বৃহস্পতিবার নোয়াখালীর চাটখিলে পে
ট্রলবোমার আগুনে দগ্ধ হন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শরীরের ১০ শতাংশ দগ্ধ হলেও মুখমণ্ডল পোড়ার কারণে তাঁর অবস্থা গুরুতর। গতকাল শনিবার দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইনস্টিটিউট ঘুরে নাশকতায় দগ্ধ রোগীদের নানা রকম যন্ত্রণায় ভুগতে দেখা গেছে। গতকাল সেখানে ৫১ জন চিকিৎসাধীন ছিল, যাদের মধ্যে ১৫ জনের অবস্থা সংকটাপন্ন। আশঙ্কাজনক ছয়জনকে রাখা হয়েছে আইসিইউতে। চিকিৎসকরা বলছেন, রোগীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও সেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে সারা দেশ থেকে রোগীদের ঢাকায় আসা কমানো না গেলে এই সেবা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তাঁদের। গতকাল দুপুরে বার্ন ইনস্টিটিউটের প্রশাসনিক ব্লকে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অবৈতনিক উপদেষ্টা ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, এখন পর্যন্ত নাশকতার আগুনে দগ্ধ ৯৫ জন রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছেন তাঁরা। এখনো ৫১ জন চিকিৎসাধীন। ছয়জন মারা গেছে। বাকি ৩৮ জন বাড়ি চলে গেছে। চিকিৎসাধীন রোগীদের মধ্যে ১৫ জনের অবস্থা তুলনামূলক খারাপ। সংবাদ সম্মেলনে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ, অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ খন্দকারসহ চিকিৎসকরা উপস্থিত ছিলেন। সবখানে আহাজারি : ফটোকপির মেশিন মেরামতের কাজ করেন রাজু আহমেদ (২০) ও জীবন আহমেদ (২০)। গত শুক্রবার রাতে যাত্রাবাড়ী থেকে তাঁরা বাসে করে যাচ্ছিলেন রামপুরায়। খিলগাঁও ফ্লাইওভারের কাছে তাঁদের বহনকারী তুরাগ পরিবহনের বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। দুজনই এখন হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। রাজুর মুখমণ্ডলসহ শরীরের ১৫ শতাংশ পুড়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক। অস্পষ্ট কণ্ঠে বলেন, 'কাজে যাচ্ছিলাম। বুঝি নাই পথে এমন বিপদ আছে। ভাই, আমি বাঁচমু তো?' বারান্দায় চিকিৎসাধীন জীবনের মা হনুফা বেগম বলেন, 'ছেলেডার অবস্থা দেইখা কিছুই ভালা লাগে না। ওর পোড়া দেইখ্যা মনে হয় সেই শয়তানগো গায়েও আগুন দেই।' একই ঘটনায় দগ্ধ হয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কনস্টেবল জামাল উদ্দিন। তিনি রামপুরার উলনে যাচ্ছিলেন স্ত্রী, মেয়ে আর নাতনিকে নিয়ে। আগুনে জামালের হাত, পিঠ, বাঁ পাসহ শরীরের ২০ শতাংশ পুড়েছে। কাতরকণ্ঠে জানালেন, তাঁর স্ত্রী খাদিজা বেগমও সামান্য দগ্ধ হয়েছেন। তিনি নিচতলায় ভর্তি আছেন। বাস থেকে নামতে গিয়ে মেয়ে দিবার পায়ের আঙুল ভেঙে গেছে। তবে সাত মাস বয়সের নাতনি আয়েশার কোনো ক্ষতি হয়নি। জামাল বলেন, 'মুহূর্তের মধ্যে আগুন ধইরা যায়। ওগোরে আগে নামাইতে যাইয়া আমি বেশি পুইড়া গেছি।' গত ১৭ জানুয়ারি মোহাম্মদপুরে বাসে পুড়েছেন বৃদ্ধ আবু তাহের। চার দিন আগে তাঁকে আইসিইউ থেকে এইচডিইউতে আনা হয়েছে। এখনো তাঁকে নিয়ে উৎকণ্ঠায় স্বজনরা। ছেলে আবু বকর সিদ্দিক বলেন, 'কামরাঙ্গীরচরে থাকি। সেইখানে মা-বাবারে আনতে গেছিলাম। পাবনা থেকে বাসে আসে তারা। এর মধ্যে আগুন দিলে সবাই দগ্ধ হই। আব্বাই বেশি পুড়েছে। এই বুড়া মানুষটা পোলার কাছে আইসা এখন মরতাছে।' ২৩ জানুয়ারি রাতে যাত্রাবাড়ীতে বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় দগ্ধ হন রূপগঞ্জের একটি অক্সিজেন কারখানার কর্মী রুবেল (২৪)। তাঁর শরীরের ৩০ শতাংশ পুড়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তাঁকে অন্তত তিন ব্যাগ রক্ত দিতে হবে। এবি নেগেটিভ রক্ত পাওয়া যাচ্ছিল না। চিকিৎসকরা গণমাধ্যমে প্রচার করে রক্তদাতা সংগ্রহ করেছেন। গতকাল রুবেল বলেন, 'শরীরের যন্ত্রণায় জানটা বাইর হইয়া যায়। এর মধ্যে মানুষের ভালোবাসায় একটু শান্তি পাই।' ঠাকুরগাঁওয়ে দগ্ধ পিকআপ ভ্যানচালক নাজমুল ইসলাম, বগুড়ায় দগ্ধ ট্রাকের হেলপার জাহাঙ্গীর আলম, সিলেটে দগ্ধ মোটর মেকানিক নিরঞ্জন সিংহ, বগুড়ায় ট্রাকে দগ্ধ আসবাবপত্র ব্যবসায়ী সাজু খলিফা, যাত্রাবাড়ীতে দগ্ধ রাজমিস্ত্রির ঠিকাদার নূর আলম ও আশুলিয়ায় দগ্ধ ভ্যানচালক আব্দুর রশিদকে আইসিইউতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।    

No comments:

Post a Comment