গ্রেপ্তার, আটক অথবা গৃহবন্দি করার কৌশল নয়, এবার বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে 'সামাজিকভাবে' বিচ্ছিন্ন করার কৌশল নিয়েছে সরকার। রাজনৈতিক পরামর্শদাতাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বন্ধ করে বিএনপি নেত্রীকে আপাতত গুলশান কার্যালয়ের 'বাইরে' আনার চেষ্টা চলছে। এর জন্যই চলছে নানা উদ্যোগ। পুলিশের পাশাপাশি নানা সংস্থা শুক্রবার রাত থেকেই এ বিষয়ে কাজ করছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে 'সংকেত' পেয়েই সব রকমের প্রশাসনিক
পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। এর পাশাপাশি এক মাস রাজনৈতিক কার্যালয়ে অবস্থান করা বিএনপি নেত্রীকে 'জনবিচ্ছিন্ন' হিসেবে প্রমাণ করার জন্য রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোও বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে। রাজনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, টানা অবরোধ-হরতাল-নাশকতায় যে জনরোষ ও প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে, এর মুখোমুখি করাতে খালেদা জিয়াকে প্রকাশ্যে আনার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। তাঁকে কার্যালয়কেন্দ্রিক রাজনীতি থেকে বাইরে আনতেই আগ্রহী সরকার। তবে আওয়ামী লীগের ভেতরে অনেকেই চাইছেন খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমেই পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু নীতিনির্ধারকরা সায় দিচ্ছেন না এ চরম পদক্ষেপে। এমনকি বিএনপির পক্ষ থেকে এ মুহূর্তে সভা-সমাবেশ করতে চাইলেও তাতে সম্মতি দেওয়ার পক্ষে তাঁরা। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, হামলা ও নাশকতা প্রতিরোধে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাউকে গ্রেপ্তারের প্রয়োজন হলে করা হবে। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফেরাতে সরকার কঠোর পদক্ষেপ নেবে। কাউকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। গুলশানে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পাশাপাশি গতকাল শনিবার সেখানে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা বিক্ষোভ করেছেন। আরো বেশ কিছু সংগঠন এ কার্যালয় ঘেরাওসহ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে। এ অবস্থায় খালেদা জিয়ার অবস্থান ঘিরে তৈরি হয়েছে এক ধরনের 'নিরাপত্তাহীনতা'। অবশ্য বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ১৭ ঘণ্টা পর গত রাতে তা আবার চালু করা হয়। পুলিশের গুলশান জোনের উপকমিশনার লুৎফুল কবীর গত রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, নিরাপত্তা বিষয়ে পুলিশ প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। যখন যেভাবে দরকার সেভাবেই ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তুতি ও নির্দেশনা আছে। রাজনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, গুলশান কার্যালয়কে 'আবাসিক' বানিয়ে বিএনপি নেত্রীর আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার বর্তমান কৌশলে সরকার বিরক্ত। সর্বশেষ খালেদা জিয়ার ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর সমবেদনা জানাতে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ ভবনে ঢুকতে না দেওয়ার ঘটনা এবং এসএসসি পরীক্ষার মধ্যে অবরোধ-হরতাল চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে সরকার বিবেচনা করছে 'চরম ঔদ্ধত্য' হিসেবে। এ অবস্থা আর চলতে দেওয়া হবে না- সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এ রকম মতামত পেয়ে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, নাশকতা প্রতিরোধে সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তারের সম্ভাবনা আপাতত নেই। আরাফাত রহমান কোকোর কুলখানিসহ শোকাবহতা কাটিয়ে ওঠার পরই খালেদা জিয়ার ব্যাপারে সে রকম ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। আপাতত বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলীয় নেতাদের আটক ও গ্রেপ্তার এবং মামলা দায়েরের মধ্যেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নির্দেশনা রয়েছে পুলিশের। আর গুলশানের এ দলীয় কার্যালয়ে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন না করেই কড়া নজরদারি করতে বলা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে গতকাল শনিবার থেকে এ কার্যালয়ের দিকে অগ্রসর হওয়া 'অনাহূত' ব্যক্তিদের আটক করার জন্য বলা হয়েছে। খাবার, পানিসহ বিভিন্ন দ্রব্য নিয়ে এ কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়ে কেউ যেন কোনো 'নাটক' না করতে পারে সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে পুলিশ কর্মকর্তাদের। বিচ্ছিন্নতার প্রথম পর্যায় : শুক্রবার দিবাগত রাত ২টা ৪২ মিনিটে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় খালেদা জিয়ার অবস্থান করা ভবনটিতে। এরপর জেনারেটরে চলছিল কার্যক্রম। সকালে জেনারেটরের জ্বালানি তেল শেষ হয়ে গেলে ভ্যানে করে দুই ড্রাম তেল আনা হয়। পুলিশ তাতে বাধা না দেওয়ায় পরে তিরস্কারের মুখোমুখি হয়েছে। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে কেব্ল্ টিভি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। এর কিছুক্ষণ পরেই বিচ্ছিন্ন করা হয় ইন্টারনেট সংযোগ। একপর্যায়ে এ ভবনের আশপাশের মোবাইল টাওয়ারগুলো 'নিষ্ক্রিয় ও নিয়ন্ত্রিত' করা হয়। বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান এ কাজগুলো করলে তাতে 'বাধা না দিতে' বলা হয়েছে পুলিশকে। বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেওয়ার ১৭ ঘণ্টা পর ফের চালু করা হয়। সন্ধ্যায় গুলশানের এ রাজনৈতিক কার্যালয়ের ফটক থেকে পুলিশ আটক করেছে ছয় নারী আইনজীবীকে। বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য খালেদা ইয়াসমিনকেও আটক করা হয় এর কিছুক্ষণ পর। তাঁরা কার্যালয়ের আশপাশে অহেতুক ঘোরাঘুরি করছিলেন বলে পুলিশের দাবি। এরপর এ ভবনে আগাম মজুদ করতে ছয়টি পানির ড্রাম আনা হলে পুলিশ তা ফিরিয়ে দেয়। ভবনটিতে খাদ্য-পানীয়সহ কেউ ঢুকতে চাইলে তাদের দূর থেকে বাধা দেওয়া হবে এবং ফিরিয়ে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, লাগাতার অবরোধ-হরতালে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খুব সামান্যই। কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্ষতি অপূরণীয়। আর এ কর্মসূচি সফল করতে গিয়ে যে ধরনের নাশকতা হয়েছে তার শিকার হয়েছে সাধারণ মানুষ। সব মিলিয়ে সরকারবিরোধী এ আন্দোলন ঝুলে গেছে নেতৃত্বের ও সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে। সে সুবাদে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের সরকারবিরোধী আন্দোলন কার্যত এখন 'জনবিচ্ছিন্ন' পর্যায়েই চলে গেছে। পেট্রলবোমায় দগ্ধ মানুষদের হাসপাতালে দেখতে যাওয়ার মতো কাজটুকুও করেননি বিএনপি নেতারা। গ্রেপ্তার আতঙ্কসহ নানা অজুহাতে নেতারা এসব কাজ থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন কম। এ অবস্থায় গত ৩ জানুয়ারি থেকে রাজনৈতিক কার্যালয়কে 'বাসা' বানিয়ে টানা অবস্থান করার কৌশল খালেদা জিয়ার জন্য এখন বুমেরাং হচ্ছে। প্রথম পর্যায়ে খালেদা জিয়ার এ অবস্থানকে সরকার ইট-বালুর ট্রাক দিয়ে ঘিরে ও ফটকে তালা মেরে বরং উসকে দিয়েছিল। পরে এ অবরুদ্ধ অবস্থান থেকেই টানা অবরোধের ডাক দেন খালেদা জিয়া। এরপর ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় সরকার রাজনৈতিক এ কার্যালয়কে মুক্ত করে দিলেও খালেদা জিয়া আর ফেরেননি খুব কাছের দূরত্বের 'প্রকৃত' বাসায়। এমনকি ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পরও তিনি রাজনৈতিক কার্যালয় ছাড়েননি। সরকারের পক্ষ থেকে এ পর্যায়েই খালেদা জিয়াকে এখন আলোচিত রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে বের করার চেষ্টা হচ্ছে সরকার পক্ষ থেকে।
No comments:
Post a Comment