Tuesday, February 3, 2015

নগর সরকার অপরিহার্য:কালের কন্ঠ

উন্নত দেশের নগর এলাকায় 'নগর-সেবা' বা সিটি সার্ভিস বলতে যা বোঝায় তার নিয়ন্ত্রক সংস্থা একটিই থাকে। ফলে কাজের সমন্বয় নিয়ে ঝামেলা পোহাতে হয় না। সেসব নগরে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিফোন, পরিবেশ সংরক্ষণ, নগর উন্নয়ন, সড়ক ও জনপথ, জননিরাপত্তা (পুলিশ), স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহন ও আবাসনব্যবস্থাসহ সব ধরনের সেবার নিয়ন্ত্রণ থাকে সিটি করপোরেশনের হাতে; নগর সরকার ব্যবস্থার আওতায়। আমাদের শহর-নগরকে যত ভাগেই ভাগ করা হ
োক না কেন, নগর সরকার ব্যবস্থা কায়েম না করলে তা কাজে আসবে না। নগর সরকারের প্রধানকে উপপ্রধানমন্ত্রী বা পূর্ণ মন্ত্রীর পদমর্যাদার হতে হবে। কেননা, ২০টির বেশি মন্ত্রণালয়ের প্রায় ৫২টি সরকারি দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবেন নগর সরকারের প্রধান। নগর সরকার কায়েমের পর ওয়ার্ডগুলোর পরিচালন ব্যবস্থাও সংহত করতে হবে, নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার জন্য। সব কিছুই সম্ভব যদি রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন হয়। নগর সরকারের বিষয়ে এখনই ভাবতে বসতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি চারজন নগর পরিকল্পনাবিদের সমন্বয়ে পরিচালিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এ বিষয়ে প্রস্তাব ও সুপারিশ পেশ করা হয়েছে। নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. গোলাম মরতুজার নেতৃত্বে পরিচালিত গবেষণায় সংযুক্ত ছিলেন পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান, ড. মো. জাহিদ হোসেন ও অধ্যাপক ড. গোলাম মঈনউদ্দিন। গবেষণা দলের প্রধান অধ্যাপক ড. গোলাম মরতুজা বলেন, দ্রুত নগরায়ণের ফলে ঢাকা শহরে নাগরিক সেবা প্রদানে নগর ব্যবস্থাপনায় যে নেতিবাচক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তার উত্তরণে সুশাসনের বিষয়টি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বিবেচনা করা প্রয়োজন। সমস্যার মূলে রয়েছে প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপকীয় জটিলতা, অনভিজ্ঞতা, অযোগ্যতা, দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব, সচেতনতার অভাব এবং অপর্যাপ্ত তহবিল। সমস্যার আরো বেশ কিছু কারণ রয়েছে। মূলত সুশাসনের অভাবেই এমন দুর্বহ, অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, নগরে সুশাসনের ব্যবস্থা করে নাগরিক সেবা প্রদান, উন্নয়ন ও দারিদ্র্যমোচন সম্ভব। অধ্যাপক মরতুজা বলেন, এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার জায়গা নিয়ে ঢাকা মহানগর এলাকা। ঢাকায় মূলত তিন ধরনের স্টেকহোল্ডার নগর-সুশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সরকারি প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আর সুধীসমাজ। সুশাসনের বিষয়টির সঙ্গে নাগরিক সচেতনতা, দায়িত্বশীলতার ব্যাপারগুলোও সংশ্লিষ্ট উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমরা নিয়মিত কর দিতে চাই না; কিন্তু নাগরিক সেবা পেতে চাই। বিগত দিনে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বার্ষিক বাজেটের দুই-তৃতীয়াংশ সরকারি অনুদান ও ধার-দেনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। নিজস্ব আয় আশানুরূপ নয়।' অধ্যাপক মরতুজা বলেন, ঢাকায় ৫২টি সরকারি প্রতিষ্ঠান নগর সেবা প্রদানের কাজে নিয়োজিত। সংস্থাগুলো ২০টি মন্ত্রণালয়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করছে। বাংলাদেশে সর্ব প্রথম যৌথ ব্যবস্থাপনায় জনগণের অংশীদারত্বে, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ৫০ সদস্যের শহর সমন্বয় কমিটি গঠন করার কথা স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, ২০০৯-এ বলা হয়েছে। স্থানীয় জনগণের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া সঠিকভাবে নাগরিক সেবা প্রদান করা সম্ভব নয়। ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগে ভাগ করে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব বাড়ানো হয়েছে কেবল। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজ, প্রশিকা, টিআইবিসহ বেশ কিছু সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, সিটি করপোরেশন, ডেসা, ঢাকা ওয়াসা ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশসহ নগর সেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবার মান নিয়ে নাগরিকদের মনে বেশ অসন্তোষ ও হতাশা রয়েছে। সমন্বয়, মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণের কাজে কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়োজিত নেই। এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে জনমনে অনেক প্রশ্ন আছে। গবেষণা প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বিভিন্ন নাগরিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের দ্বারা নগর-সুশাসন নিশ্চিত করার বিষয়টি স্পষ্ট নয়। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯-এ নগর-সুশাসনের বিষয়টি স্পষ্ট গুরুত্ব পায়নি। নগর সরকার কায়েমের ব্যাপারে ১৯৯৪ সালে ঢাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ও ২০০২ সালে ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা এবং চট্টগ্রামের মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী উদ্যোগ নিলেও সেসব কার্যকর হয়নি। সম্প্রতি রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির ফলে সৃষ্ট দুর্ভোগ থেকে নগরবাসীর স্থায়ী মুক্তির জন্য কমন ইউটিলিটি টানেল (সেবা সংস্থাগুলোর লাইন সমন্বিতভাবে স্থাপন) নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে স্থায়ী পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য গত ১৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আন্তমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক মো. আশরাফ উদ্দিনের সই করা এক চিঠিতে কমন ইউটিলিটি ট্যানেল নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা ও যথার্থতার কথা তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু নগর সরকারের ধারণা পাস- এসব উদ্যোগে শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতাই বাড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, টেলিফোন লাইন, স্যুয়ারেজ ও কেব্‌ল্‌ লাইন মহানগরীর রাস্তার নিচে পরিকল্পনাহীনভাবে স্থাপন করা হয়েছে এবং হচ্ছে। সমন্বিত পরিকল্পনা ছাড়াই ইউটিলিটি লাইন স্থাপন অব্যাহত রয়েছে। নতুন লাইন স্থাপন ছাড়াও রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য যেকোনো সময় রাস্তা কাটতে হয়। বিদ্যমান লাইনের অবস্থান স্পষ্ট না থাকায় এক সংস্থার লাইন মেরামত করতে গিয়ে আরেক সংস্থার লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে অর্থের অপচয়ের পাশাপাশি সড়কের ক্ষতিও অব্যাহত রয়েছে। যে টাকা খরচ করে ইউটিলিটির জন্য একটি রাস্তা খোঁড়া হয় তা দিয়ে একটি ফুট ওভারব্রিজ বা আন্ডারপাস নির্মাণ করা সম্ভব। গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ প্রভৃতি ইউটিলিটি সার্ভিসগুলোর সুরক্ষা বিধান, সরকারের আর্থিক অপচয় কমানো, সড়ক অবকাঠামোর স্থায়িত্ব বাড়ানো ও জনদুর্ভোগ কমানোর লক্ষ্যে আধুনিক ও উপযোগী কমন ইউটিলিটি টানেল নির্মাণ এখন সময়ের দাবি। নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'নগরবাসীর সেবাব্যবস্থাকে সংহত করার জন্য ঢাকা সিটিকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে বলে সে সময় বলা হয়েছিল। কিন্তু সেবা বাড়ার বদলে বরং জনভোগান্তি বেড়েছে। এখন নগর সেবা বাড়ানো বা এ-সংক্রান্ত জটিলতা দূর করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কোনো প্রকল্প গ্রহণ করে তাহলে তা কোনো ফল বয়ে আনবে না। সব কিছুই করা হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারকে আরো শক্তিশালী করার জন্য।' তিনি বলেন, কার্যকর নগর সরকারই জনসংশ্লিষ্টতার মাধ্যমে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে পারে। নগরে সুশাসন নিশ্চিত করতে পারে।    

No comments:

Post a Comment