জনসংখ্যার ডিভিডেন্ড বা বোনাসকালের সুবাদে দেশে বর্তমানে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ছয় কোটি সাত লাখ, যা মোট জনগোষ্ঠীর ৩৯ শতাংশ। এর মধ্যে কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে পাঁচ কোটি ৮১ লাখ। সে হিসাবে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ। আর নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে শ্রমশক্তির বাইরে রয়ে গেছে সোয়া চার কোটি মানুষ। মোট জনশক্তির বাকিটা ১৫ বছরের নিচে শিশু। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপে এ তথ্য উঠে এসে
ছে। এর আগে ২০১০ সালের শ্রমশক্তি জরিপে দেশে কর্মক্ষম মানুষ ছিল পাঁচ কোটি ৬৭ লাখ। সে হিসাবে তিন বছরে দেশে শ্রমশক্তি বেড়েছে ৪০ লাখ। আর ২০১১ সালের পঞ্চম আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যা ১৫ কোটি ৪১ লাখ। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সিনিয়র সদস্য ড. শামসুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জনসংখ্যার এই আধিক্যের মধ্যেও বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানোর সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হয়েছে। কোনো একটি রাষ্ট্র জনসংখ্যা পরিবর্তনে সুযোগ একবারই পেয়ে থাকে। এ সময়টাকে বলা হয় জনসংখ্যার ডিভিডেন্ড বা বোনাসকাল। অর্থাৎ এ সময়ে দেশের জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বেশি থাকে ১৫ থেকে ৬৪ বছরের মধ্যে। এক থেকে ১৫ বছরের নিচে বয়সী জনসংখ্যাও কমতে থাকে। একই সঙ্গে ৬৪ বছরের ওপর জনসংখ্যা থাকে সবচেয়ে কম। বাংলাদেশেও এখন সবচেয়ে কম নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী বসবাস করছে। সর্বাধিক কর্মক্ষম এই জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও কাজের পরিবেশ তৈরি করাটা জরুরি।’ বিবিএস বলছে, ২০১০ সালের পর থেকে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সুবাদে গত তিন বছরে নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান বেড়েছে। এ সময়ে অর্থনীতিতে নারীর অবদান বেড়েছে চোখে পড়ার মতো। জরিপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দেশে এখন কর্মসংস্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত পাঁচ কোটি ৮১ লাখ মানুষ। এর মধ্যে পুরুষ চার কোটি ১২ লাখ। বাকি এক কোটি ৬৮ লাখ নারী। এর আগের জরিপে কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল পাঁচ কোটি ৪১ লাখ। সে আলোকে কর্মসংস্থান বেড়েছে ৪০ লাখ। শিল্প ও সেবা খাতে নারীর অন্তর্ভুক্তি বেড়েছে। ২০১০ সালে এক কোটি ৬২ লাখ নারী কৃষি, ম্যানুফ্যাকচারিং ও সেবা খাতের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। সেটি এখন বেড়ে হয়েছে এক কোটি ৬৮ লাখ। বিবিএসের কর্মকর্তারা জানান, দেশে বেকারের সংখ্যা আগের মতোই স্থির হয়ে আছে। গত তিন বছরে দেশে বেকারের সংখ্যা বাড়েনি, আবার কমেওনি। ২০১০ সালের শ্রমশক্তি জরিপে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৬ লাখ, যেটি এখনো বহাল রয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা অনুযায়ী, ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে এক ব্যক্তি গত এক মাসে কাজ খুঁজেছে কিন্তু পায়নি, গত এক সপ্তাহে কাজের জন্য প্রস্তুত ছিল, সে সময়ও কাজ জোটেনি, বর্তমানে সে ব্যক্তি কোনো ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, তাকে বেকার বলে অভিহিত করা হয়েছে। ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে কোনো ব্যক্তি যদি গত এক সপ্তাহে এক ঘণ্টাও কাজ করে থাকে, আইএলওর সংজ্ঞা অনুযায়ী তাকে বেকার বলা যাবে না। জরিপে দেখা গেছে, দেশের বড় একটি জনগোষ্ঠী কর্মসংস্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। তারা কাজ করতেও আগ্রহী নয়। এই তালিকায় রয়েছে শিক্ষার্থী, গৃহিণী, অসুস্থ, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধী। দেশে এখন কর্মসংস্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, এমন মানুষের সংখ্যা চার কোটি ২৬ লাখ। এর মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই বেশি, তিন কোটি ৩৩ লাখ। বাকি ৯২ লাখ নারী। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কর্মকর্তারা বলেছেন, কয়েক বছর আগেও দেশে ঝরে পড়ার হার বেশি ছিল। তারা যেকোনো ধরনের কাজের সঙ্গে জড়িয়ে যেত। কিন্তু ধীরে ধীরে ঝরে পড়ার হার কমেছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় ছেলে-মেয়ের আনুপাতিক হার অনেক কমে এসেছে। এ জন্য শ্রমশক্তির সঙ্গে যোগ না হওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। এটি একটি ইতিবাচক দিক বলে মনে করেন তাঁরা। শ্রমশক্তি জরিপে আরো দেখা গেছে, অর্থনৈতিকভাবে একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতা কমে আসছে। ২০১০ সালের জরিপে নির্ভরতার হার ছিল ৬৯ শতাংশ, যা কমে দাঁড়িয়েছে ৬৭ শতাংশ। অর্থ্যাৎ আগে একজন নারী, মা, সন্তান তাঁর পরিবারের একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল থাকতেন। সেটি প্রতিনিয়তই কমছে। এতে দেখা যায়, প্রত্যেকেই কিছু একটা করার চেষ্টা করছেন। এ ছাড়া গত তিন বছরে কৃষি খাতের ওপর কাজ করার হার কমে যাচ্ছে। মানুষ এখন ম্যানুফ্যাকচারিং ও সেবা খাতের দিকে ঝুঁকছে। জরিপে দেখা গেছে, কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত ৪৫ শতাংশ মানুষ। আর ৫৫ শতাংশ মানুষ ম্যানুফ্যাকচারিং ও অন্যান্য কাজের সঙ্গে যুক্ত। গত তিন বছরে দেশে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সের যুবসমাজের হার বেড়েছে। দেশে এখন দুই কোটি ৩৪ লাখ যুবক কর্মে নিয়োজিত। ২০১০ সালের জরিপে ছিল দুই কোটি ৯ লাখ। কর্মকর্তারা বলেছেন, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে হলে সবার আগে দরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। পাশাপাশি গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। একই সঙ্গে কারিগরি ও শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। জনসংখ্যার এই বোনাসকালকে কাজে লাগানোর পরামর্শ তাঁদের।
No comments:
Post a Comment