Monday, March 30, 2015

আবার সেই অস্ট্রেলিয়াই:কালের কন্ঠ

জুলে রিমে কাপের নিয়মটা এখন ফুটবলেও নেই। কিন্তু কালকের পর মনে হচ্ছে ক্রিকেটে এটা থাকা উচিত ছিল। তিনবার জিতে ব্রাজিল চিরদিনের জন্য জুলে রিমে ট্রফিটা নিয়ে যেতে পারলে এগারোবারের মধ্যে পাঁচবার, গতবার চারবারের মধ্যে তিনবার, পাঁচটি আলাদা মহাদেশে আয়োজিত টুর্নামেন্ট জেতা দলটি বিশ্বকাপ ট্রফির স্থায়ী মালিকানা তো দাবি করতেই পারে। ট্রফি যদি হয় শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি তাহলে আসলে ট্রফি দিয়ে এবং সেটা ফিরিয়ে নিয়ে সঠ
িক দাম দেওয়া হয় না। আধুনিক ক্রিকেটে, ওয়ানডে ক্রিকেটে ওদের দাপটের মূল্য এর চেয়ে অনেক বেশি। এতটাই যে ফাইনালকে ওরা ছেলেখেলা বানিয়ে ফেলে, ছোট ভাই জাতীয় দেশের স্বপ্নকে তাসমান সাগরে নিয়ে ফেলে নিষ্ঠুর হৃদয়ে। আবেগ ছিল নিউজিল্যান্ডের, বেগের কাছে সেটা উড়ে যায়। কিছু বঞ্চনার ক্ষতিপূরণের জমানো স্বপ্ন ছিল, সেগুলো শেষ হয় নতুন জাতীয় যন্ত্রণায়। ধুঁকতে ধুঁকতে শেষে যখন নিউজিল্যান্ডের স্কোরটা ১৮৩ হয়ে গেল তখন সবার যে স্মৃতি মনে পড়ার কথা সেটাই মনে পড়ে। ১৯৮৩। 'কপিলস ডেভিলস' নামের দলটি এই সামান্য ১৮৩-কেই বিশ্বকাপ জেতার স্কোর বানিয়ে সংখ্যাটাকে ক্রিকেট জাদুঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। কিন্তু জাদুঘরে ঢুকে যাওয়া জিনিস রোজ রোজ বেরোলে জাদুঘর পোস্ট অফিস হয়ে যায় এবং জাদু কীর্তি বারবার হলে জাদু যদু মধুর কারবার হয়ে যায়।  হয় না অবশ্য। বরং যা হওয়ার তাই হয়ে ধরে রাখে এই বিশ্বকাপের চরিত্র। এ তো সেই বিশ্বকাপ যেটা আসলে একপেশে লড়াইয়ের প্রদর্শনীর মঞ্চ। নিউজিল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকা সেমিফাইনালটা বাদ দিলে নকআউট পর্যায়ের ম্যাচগুলোর সব কটা প্রথম ইনিংস শেষ হতেই শেষ। কাল সন্ধ্যায় সগৌরবে জানানো হলো ৯৩,০১৩ জন দর্শক হাজির হয়ে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট ইতিহাসের আগের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। কালকের সমবেত মানুষরা দিনশেষে কী পেল! দ্বিতীয় ইনিংসের মাঝখানে বেরিয়ে দেখি স্টেডিয়ামের বাইরে স্যুভেনির শপে মানুষের ভিড়। পাশে দাঁড়িয়ে কেউ সিগারেট টানছে, কেউ আড্ডা মারছে। পাড়ার ক্রিকেটেও ম্যাচের মাঝখানে এই দৃশ্য বিরল, আর বিশ্বকাপ ফাইনালে, সোনার হরিণের মূল্যে কিনা ফাইনালের এই হাল। আইসিসির কেনা বোদ্ধা এবং চেনা বাদকরা ঢোল বাজিয়ে বলবেন দারুণ সফল বিশ্বকাপ হয়েছে কিন্তু আসলে যা হলো তা শেষ পর্যন্তু ৫০ ওভারের বিশ্বকাপের জন্য হুমকিই। কিন্তু ঠিক এভাবে সরলীকরণ করে ফেললে তাঁদের প্রতি অবিচার করা হয় যাঁরা এই বিশ্বকাপে ওয়ানডে ক্রিকেটের সাজানো চিত্রনাট্যকে তছনছও করলেন। বলছি বোলারদের কথা, পেসারদের কথা। এবং ফাইনালটা যেন তাঁদের একটা পক্ষ চূড়ান্ত কীর্তি দেখানোর জন্য জমিয়ে রেখেছিলেন। স্টার্ক-জনসন-ফকনাররা দেখেছেন এই খেলাটা কিভাবে ব্যাটসম্যান আর ব্যাটিংয়ের হাতে চলে যাচ্ছে। দুঃখভরে আরো দেখলেন নিজের দেশের উইকেটগুলোর চরিত্রও কেমন বদলে তাঁদের বিরুদ্ধে। সেই বঞ্চনা তাঁদের তাড়িত করেছে, সেই তাড়না হাতের বলে বিষ মাখিয়ে যে গোলাগুলো বের করে দিয়েছেন তাতেই তৈরি হয়েছে বিশ্বকাপের চূড়ান্ত গন্তব্য। প্রত্যেকেই বিষাক্ত কিন্তু এর মধ্যে চারজনের চার রকম ধরন পুরো বৃত্তটাকে সম্পূর্ণ করে যেন! স্টার্ক বলে-কয়ে ইয়র্কার করতে পারেন, হ্যাজলউড নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ব্যাটসম্যানকে আটকে চাপ তৈরি করেন, যখন জনসন ঝড় তোলেন গতি আর বাউন্সারের এবং ফকনারের স্লোয়ার আর গতি পরিবর্তন। কালকের দিনে ফুলের সবগুলো পাপড়ি মেলার মতো এমন সুবাস ছড়ালেন যে তার জবাব কী করে থাকবে ম্যাককালামদের! ম্যাককালামের সঙ্গে স্টার্কের প্রাথমিক লড়াইটা ম্যাচের গতিবিধি ঠিক করবে জানা ছিল। আর সেজন্যই ম্যাচটা আসলে শেষ হয়ে গেল ম্যাচের পঞ্চম বলেই, যখন আগের দুটো বল ঠিকমতো খেলতে না পারা ম্যাককালাম বোল্ড হয়ে গেলেন। এবারের নিউজিল্যান্ডের সাফল্যের রেসিপিই ছিল শুরুতে ম্যাককালামের ঝড়, তাতে তৈরি লাইনে দাঁড়িয়ে বাকিদের ট্রেনটাকে চালিয়ে নিয়ে চলা। ম্যাককালাম গেলেন এবং নিউজিল্যান্ডের সম্ভাবনা সঙ্গে সঙ্গে প্রাক ম্যাচে যা ছিল তার অর্ধেক হয়ে গেল। তাঁকে অন্ধের মতো অনুসরণ করেন গাপটিল ও উইলিয়ামসন। ম্যাচ প্রায় শেষ। কিন্তু ধ্বংসস্তূপেও যেমন সৃষ্টির গান চলে, চলে নিশান ওড়ানোর চেষ্টা, তেমনি চেষ্টা শুরু করলেন গত ম্যাচের নায়ক গ্রান্ট এলিয়ট এবং অভিজ্ঞ রস টেলর। কারো কারো স্মৃতিতে তখন ১৯৯২ ফাইনাল। ২৩ বছর আগে এই মেলবোর্নেই তো শুরুর ধাক্কা কাটিয়ে ঠিক ঘুরে দাঁড়িয়েছিল পাকিস্তান, তৈরি করেছিল রূপকথা। এলিয়টদের ব্যাটে তার আগমনীধ্বনি যারা শুনলেন তারা অবশ্য পরে কানে হাত দিলেন। ব্যাটিং পাওয়ার প্লে বলে একটা জিনিস আছে এখন, যার নাম আসলে হওয়া উচিত ব্যাটিং সর্বনাশ। ৩৯ রানে ৩ উইকেট হারানোর ধাক্কা সামলে বড় পার্টনারশিপে রান তখন দেড়শ ছাড়িয়েছে, সেই সময়ের পাওয়ার প্লের ৫ ওভারে একটা গতিবৃদ্ধি হলে ম্যাচটা উত্তেজনার পাল্লায় চলে আসে। কিন্তু ক্রিকেট সাধারণ পরিকল্পনার অঙ্ক মেনে চললে তো আর সে অনিশ্চতার খেলা থাকে না। ৮ বলের মধ্যে ৩ উইকেট হারাল নিউজিল্যান্ড এবং সত্যি বললে ২০১৫ বিশ্বকাপ ওখানেই শেষ। আর যদিও কাগজে লেখা থাকবে স্টার্ক-ফকনাররাই সর্বনাশ করেছেন কিন্তু আসলে মোড়টা ঘুরিয়েছেন ব্র্যাড হ্যাডিন। কী যে দুর্দান্ত ক্যাচ নিলেন টেলরের। আম্পায়াররা আজকাল যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে টিভির সাহায্য নেন, ধর্মসেনা সেটা করাতে বারবার রিপ্লেতে দেখলাম কী অসম্ভব ক্যাচটা ধরেছেন। ১১১ রানের জুটি ভেঙে সেই যে ছন্দটা কাটল আর ফেরা হয়নি কিউইদের। পাওয়ার প্লেতে ফিল্ডার ভেতরে থাকাটাই সবাই দেখে কিন্তু এর ফলে আবার সমস্যা যে ফিল্ডিংটা অনেক আক্রমণাত্মক হয়ে যায়। সঠিক টেকনিক না জানলে টিকে থাকা কঠিন হয়। সেটাই হলো পরের দুই নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানের। সেই সময় ১৫ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে ৪০ ওভার শেষে ৬ উইকেটে ১৬৫, যখন ৩৫ ওভারে ৩ উইকেটে ১৫০ ছিল কত সম্ভাবনাময়। ফকনার-স্টার্ককেই দিতে হবে মূল কৃতিত্ব এবং পেসাররাই এবার অস্ট্রেলিয়াকে জিতিয়েছে বিশ্বকাপ, ব্যাটসম্যানদেরও প্রায় সমান অবদান কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না ফিল্ডাররাও হাত বাড়িয়ে রেখেছিলেন। হ্যাডিনের এই অবিশ্বাস্য ক্যাচ বাদ দিলেও গত ম্যাচের দুটো অবিশ্বাস্য রান আউট চিন্তা করুন, কালও তেমনি একটা রান আউটেই ইনিংসের সমাপ্তি। না, রাজত্বটা অস্ট্রেলিয়া ফিরিয়ে আনল খেলার সব বিভাগের সর্বোচ্চ শক্তির মিলিত জোয়ারে। আগের দিন ওয়ানডের আলো থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে মাইকেল ক্লার্ক ফাইনালের আলোটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন। সেই আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে পথভ্রষ্ট হওয়ার একটা আশঙ্কা ছিলই। কিন্তু সেই আশঙ্কা জয় করতে পারেন বলেই না ক্রিকেটাররা অমর কীর্তির নায়ক হয়ে ওঠেন। তৈরি হয় সেই রূপকথা, যা লিখতে কল্পনাবিলাসী লেখকেরও কলম কাঁপে। কিন্তু ক্রিকেট তাঁকেই ভরিয়ে দেয় যে তাঁর মর্মকে উঁচুতে তুলতে হয়ে থাকে একান্ত পূজারি। যখন বোঝা হওয়ার ন্যূনতম আশঙ্কা, তখনই জেগে ওঠা অহংয়ে যিনি বলি দিতে পারেন যেকোনো ব্যক্তিগত লোভ, তিনি তো আসলে খেলাটার বীরত্বের প্রতীক। সেই বীরকে ওপরে তুলে ধরে ক্রিকেট যেন তার দায়িত্বটাও পালন করল। ১৮৩-কে ১৯৮৩-র জাদুকরী জায়গায় নিতে বোল্ট-সাউদিদের দুর্ধর্ষ হতে হয় কিন্তু হওয়ার পূর্বশর্ত যে নিজের দেশের পরিচিত মানুষ আর হাওয়া। তা ছাড়া স্কোরবোর্ডেও রান দরকার কিছু। নেই বলে ওদের করার কিছু থাকে না, এই রানটা যেকোনোভাবেই অস্ট্রেলিয়া করবেই। নেতৃত্ব দিতে পারতেন অন্য যে কেউ, ওয়ার্নার-ফিঞ্চদের কেউ স্বভাবসুলভ দানবীয় ইনিংস খেলতেই পারতেন। কিন্তু তাহলে যে ক্লার্ককে ক্রিকেট তার প্রাপ্য ফিরিয়ে দিতে পারে না। তাই দ্রুত দুই উইকেট পড়ে যায়, তিনি আসেন। প্রথম বলটা ঠিক ব্যাটে-বলে হয় না। আশঙ্কা জাগে, দ্রুত ফিরে গিয়ে ইনিংসটাকে না পথচ্যুত করে দেন। কিন্তু ক্রিকেট দেবতার আশীর্বাদ যে আজ তাঁর ব্যাটে ভর করার কথা। পাশে থাকা স্মিথ আধুনিক ব্যাটিংয়ের শিল্পিত আগ্রাসনের ছবি কিন্তু তিনিও এদিন কী ছায়ায় ঢাকা! দারুণ সব স্ট্রোক বেরোয়, একেকটা শট যেন চিত্রনাট্যেরই একেকটা অঙ্ক, পথ কাছায় সৌরভে-শিহরণে। কিন্তু শেষটা আবার হয় না। ৯ রান বাকি থাকতে ৭২ বলে ৭৪ রানে কাব্যের সমাপ্তি। কিন্তু এও যেন ঠিক আছে। রূপকথাতে কিছু মাটির গন্ধ না থাকলে, কিছু না পাওয়ার চিহ্ন না থাকলে সেটা খুব দূরের হয়ে থাকে। ক্লার্ক তাই আকাশে উঠলেন, দূরের তারার মতো জ্বললেন, আবার মাটিতেও নামলেন। আউট না হলে পুরো এমসিজি দাঁড়িয়ে হাততালিতে ভেজানোর সুযোগটা পায় না। শেষ করে না আসাটা তাই অতৃপ্তির 'ইশ' নয় বরং তৃপ্তির 'আহ'। একজন দাঁড়িয়ে আছেন সেই জীবনের শেষ সীমানায়। যে বা যারা দাঁড়িয়ে হাততালিতে ক্লার্ককে ভেজাল তিনিও তাদের মধ্যে ছিলেন। আসা প্রায় অসম্ভব ছিল, তবু এই দিনে এই ম্যাচে শরীরের সীমাবদ্ধতা কে জয় করে চলে এলেন জীবনের শেষ ক্রিকেট লড়াইটা দেখতে। ঠিক যা চেয়েছিলেন তা হয়তো পেলেন না। ক্লার্কের ক্রিকেট জীবনের পূর্ণতা মার্টিন ক্রোর শারীরিক জীবনের শেষ ইচ্ছাটাকে অপূর্ণ করে রাখে। কিন্তু ক্রো তাতে মন খারাপ করেন না নিশ্চিত। ক্রো-ক্লার্ক সবাই সেই ক্রিকেটের পূজারি যে ক্রিকেট তাঁদের শিখিয়েছে বাস্তব জীবন কোনো না কোনো সময় শেষ হয়। কিন্তু ক্রিকেট কীর্তি আর ক্রিকেট জীবনটা অক্ষয় হয়ে রয়! আরেকজন এসবই দেখলেন স্বর্গ থেকে। ফিল হিউজ। মুগ্ধতায়-স্তব্ধতায় ভাসতে ভাসতে খবর পেলেন, তাঁর থেকে যাওয়া সতীর্থরা কী প্রবল আবেগে তাঁকে ধরে রেখেছে হৃদয়ে। কিভাবে অদৃশ্য থেকে তিনি পরিণত হয়েছেন শক্তিতে। এখানে আরেকবার ক্রিকেট জেতে জীবনের বিরুদ্ধে। তাঁকে ট্রফি উৎসর্গ করে আর জীবনভর কালো ব্যান্ড পরে ক্রিকেট খেলার ঘোষণা দিয়ে আরেকবার ক্লার্ক জানান, ক্রিকেট-ক্রিকেটার আর ক্রিকেট কীর্তির মৃত্যু নেই। না, এটা শুধুই অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বজয় নয়। এটা জীবনের বিরুদ্ধে ক্রিকেটেরও জয়!

No comments:

Post a Comment