বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের লাগাতার অবরোধ এবং মাঝেমধ্যে হরতাল কর্মসূচির আড়াই মাসে কয়েক শ পেট্রলবোমা হামলা বা পেট্রল ঢেলে আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটেছে। মামলা হয়েছে পাঁচ শর বেশি। তবে একটিরও চার্জশিট হয়নি এখনো। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও পেট্রলবোমা হামলা বা পেট্রল ঢেলে আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটছে; যদিও তীব্রতা আগের চেয়ে কমেছে। অন্যদিকে অবরোধ শুরুর পর সারা দেশে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের ঘটনায় ২১ মার্চ পর্যন্ত এ
ক হাজার ৭১৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসবের মধ্যে এক হাজার ৬৬৫টি মামলার তদন্ত এখনো চলছে। মাত্র ৫২টি মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, গত ৬ জানুয়ারি থেকে গতকাল রবিবার পর্যন্ত (৮৩ দিন) দেশের বিভিন্ন স্থানে ৭৭ জন পেট্রলবোমা হামলা বা পেট্রল ঢেলে আগুন লাগানোর ঘটনার শিকার হয়ে মারা গেছে। আহত হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। আহত-নিহতদের অধিকাংশই পরিবহন শ্রমিক, দিনমজুর। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হামলাকারীদের বেশির ভাগকেই এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি। এসব মামলার বেশির ভাগ আসামি ২০ দলীয় জোটের নেতা-কর্মী। কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়েছে। তাদের কেউ কেউ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, খুঁটিনাটি খতিয়ে পেট্রলবোমা হামলা বা পেট্রল দিয়ে আগুন লাগানোর ঘটনার মামলাগুলোর তদন্ত করা হচ্ছে। ফলে চার্জশিট দিতে দেরি হচ্ছে। আসামিদেরও চিহ্নিত করা হয়েছে বলে তাঁদের দাবি। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কালের কণ্ঠকে বলেন, সংশ্লিষ্ট যেসব মামলা আছে সেগুলোর চার্জশিট দিতে একটু সময় লাগছে। পুলিশের চেষ্টার কমতি নেই। দ্রুত চার্জশিট দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি হুমায়ুন কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, রেঞ্জের বিভিন্ন থানায় দায়ের হওয়া পেট্রলবোমা হামলা বা পেট্রল দিয়ে আগুন লাগানোর মামলার তদন্ত প্রায় শেষ। শিগগির চার্জশিট দেওয়া হবে। বেশির ভাগ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম বলেন, মামলাগুলো সূক্ষ্মভাবে তদন্ত করা হচ্ছে। এ কারণে একটু সময় লাগছে। চার্জশিট দ্রুতই দেওয়া হবে। রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি ইকবাল বাহার জানান, পেট্রলবোমা হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত চলছে। শিগগির চার্জশিট দেওয়া হবে। যাত্রাবাড়ী থানার ওসি অবনী শংকর কর জানান, ২৩ জানুয়ারি রাতে বাসে পেট্রলবোমা হামলা মামলার তদন্ত করছে ডিবি। আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। এ প্রসঙ্গে ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, তদন্ত চলছে। যারা ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। শিগগির চার্জশিট দেওয়া হবে। খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করে দায়ের হওয়া মামলার তদন্তও চলছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেওয়া পুলিশের হিসাব : অবরোধ শুরুর পর গত ২১ মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে নাশকতার এক হাজার ৭১৭টি মামলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৫২টির তদন্ত শেষ হয়েছে; অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেওয়া হয়েছে। এসব মামলার জ্ঞাত আসামি আড়াই হাজার; অজ্ঞাতপরিচয় আসামি কয়েক হাজার। রেলপথে ৩৫টি ও নৌপথে ছয়টি নাশকতার ঘটনা ঘটে। বাকিগুলো সড়ক-মহাসড়কে। সারা দেশে দুই হাজার ২৮৬টি ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। ২১ মার্চ পর্যন্ত আড়াই মাসে নাশকতায় কতজন মারা গেছে, কতজন আহত হয়েছে, কত মামলা হয়েছে, কতগুলো পেট্রলবোমা হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে প্রভৃতি বিষয়ে তথ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। পুলিশ বলছে, ৭৫ দিনে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছে ৫২ জন; তাদের মধ্যে একজন পুলিশ সদস্য। নাশকতার ঘটনায় মোট ৩৩৫ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। পুলিশের ওই পরিসংখ্যানে ছয়টি মেট্রোপলিটন এলাকা ও সাতটি রেঞ্জের হিসাব দেখানো হয়েছে। এতে দেখা যায়, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় (ডিএমপি) তিনজন, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় (সিএমপি) দুজন, রাজশাহী মেট্রোপলিটন এলাকায় (আরএমপি) একজন অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছে। খুলনা মেট্রোপলিটন এলাকা (কেএমপি), বরিশাল মেট্রোপলিটন এলাকা (বিএমপি) ও সিলেট মেট্রোপলিটন এলাকায় (এসএমপি) কেউ আগুনে মারা যায়নি। সাতটি রেঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে রংপুরে। সেখানে আগুনে পুড়ে মারা গেছে ১৫ জন। এ ছাড়া ঢাকায় তিনজন, চট্টগ্রামে ১৪ জন, রাজশাহীতে সাতজন, খুলনায় দুজন, বরিশালে চারজন ও সিলেট রেঞ্জে একজন অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছে। আন্দোলনের ৭৫ দিনে ২৬১টি যানবাহনে পেট্রলবোমা ছোড়া হয়েছে; অন্যান্য উপায়ে অগ্নিসংযোগ করা হয় ৬২৫টি গাড়িতে। ৬৪টি স্থাপনায় আগুন দেওয়া হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে ৪৬৬টি যানবাহন। পরিসংখ্যানে আরো দেখা যায়, সারা দেশে এ সময়ে অগ্নিদগ্ধ হয়ে আহত হয়েছে ২৮১ জন। ককটেল হামলা ও অন্য ধরনের হামলায় আহত হয়েছে ৫৪৯ জন। ৭৫ দিনে মোট ৭৩ জন মারা গেছে; আহত হয়েছে ৮৩০ জন। নিহতদের মধ্যে অগ্নিদগ্ধ ৫২ এবং নাশকতার ঘটনার জের ধরে অন্য ঘটনায় ২১ জন। পুলিশের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, গত ১৭ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন ও মৎস্য ভবনের মাঝামাঝি এলাকায় পুলিশ সদস্যদের বহনকারী একটি গাড়িতে পেট্রলবোমা ও হাতবোমা ছোড়া হয়। এতে কনস্টেবল শামীম মিয়াসহ ১৩ পুলিশ আহত হন। তাঁদের রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৫ ফেব্রুয়ারি মারা যান শামীম।
No comments:
Post a Comment