Thursday, March 12, 2015

খণ্ডিত লাশের রহস্যের সূত্র জোড়া লাগে না:কালের কন্ঠ

২০১৩ সালের ১৭ অক্টোবরের ঘটনা। রাজধানীর ভাসানটেকের দামালকোর্ট এলাকার সেনাবাহিনীর ভূমি উন্নয়ন প্রকল্পে পশ্চিম পাশের দেয়ালের ভেতর থেকে এক তরুণীর সাত টুকরো লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনাস্থলে একটি চাপাতি, তিন জোড়া স্যান্ডেল ও একটি বস্তাও পাওয়া যায়। এক বছর পর খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ। সাত মাস পর মামলার ফাইনাল রিপোর্ট (কাউকে অভিযুক্ত না করে) দাখিল করেছেন তদন্ত
কর্মকর্তা ভাসানটেক থানার এসআই শফিকুল ইসলাম। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করেও আমরা নিহতের পরিচয় উদ্ধার করতে পারিনি। হত্যার রহস্যও তাই উদ্ঘাটিত হয়নি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট দাখিল করেছি। কখনো প্রয়োজন পড়লে তদন্ত আবার চালু করা হতে পারে।’ কিভাবে তদন্ত করেছেন- জানতে চাইলে শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে বস্তি ও গার্মেন্টে গিয়ে খোঁজ নিয়েছি। কারো নিখোঁজ হওয়ার কথা শুনিনি। ঈদের ছুটিতে এখানে মেয়েটিকে বাইরে থেকে এনে হত্যা করা হতে পারে।’ এমন চাঞ্চল্যকর অনেক ঘটনার রহস্যই সময়ের অতলে হারিয়ে গেছে। আলামত নষ্ট করতে হত্যাকারীরা লাশ কেটে টুকরো করেছে। এ কারণে তদন্তে খেই হারিয়েছেন তদন্তকারীরা। এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে অনেক লাশের পরিচয়ই উদ্ধার হয় না। কোনো ঘটনায়ই আলামত নিয়ে তদন্ত করে রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। দেশের বিভিন্ন এলাকার এমন দুই ডজন চাঞ্চল্যকর ঘটনা নিয়ে কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে অনুসন্ধান চালিয়ে পাওয়া গেছে একই রকম তথ্য। যেসব ঘটনায় স্বজনরা নিহতকে শনাক্ত করেছে এবং কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেছে, শুধু সেসব ঘটনায়ই খুনি শনাক্ত হয়েছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাজধানীর ফকিরাপুল এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে এক নারীর সাত টুকরো লাশ। এ ঘটনায় মতিঝিল থানায় দায়ের করা হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মফিজুর রহমান গতকাল বুধবার বলেন, ‘আমরা নিহতের পরিচয় ও হত্যার মোটিভ শনাক্ত করার চেষ্টা করছি। এখনো বলার মতো অগ্রগতি হয়নি।’ জানা গেছে, চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের পর ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিট। এরপর সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের ল্যাবে ডিএনএ পরীক্ষা, হাত ও পায়ের ছাপ পরীক্ষা, টেকনিক্যাল ল্যাবে নানা ধরনের পরীক্ষা হয়। জানতে চাইলে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ-হেল-বাকী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টেকনিক্যাল সাপোর্ট নিয়ে অনেক ঘটনারই রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। দু-একটি ঘটনা হয়তো রহস্যই থেকে গেছে। এখন লাশ যতই টুকরো করা হোক, ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব। ফিঙ্গার প্রিন্ট, ফুট প্রিন্ট, ইমেজ অ্যানালাইসিস করে আমরা চেষ্টা করি।’ মস্তকবিহীন মানুষটি কে : ২০১২ সালের ৯ মার্চ রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে দনিয়া স্কুল রোড থেকে এক ব্যক্তির আট টুকরো লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পলিথিনের ব্যাগে ভরা অবস্থায় ছড়ানো-ছিটানো ছিল খণ্ডগুলো, তবে মাথার অংশ মেলেনি। তাঁর পরনে একটি প্যান্ট ছিল। পকেটে সাড়ে তিন হাজার টাকাও ছিল। এ ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানায় হত্যা মামলা করে পুলিশ। থানা সূত্র জানিয়েছে, পরিচয় উদ্ধারের জন্য ডিএনএ নমুনা রাখা হয়। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে প্রায় সাত কোটি ভোটারের আঙুলের ছাপও যাচাই করা হয়। সব চেষ্টাই ব্যর্থ। যাত্রাবাড়ী থানার বর্তমান ওসি অবনী শঙ্কর কর বলেন, এ ঘটনা তাঁর জানা নেই। তবে নথিপত্র দেখে থানার সেরেস্তাদার এএসআই ইউনুস আলী জানান, মামলার তৃতীয় তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আশরাফ আলী ২০১৩ সালে ৭ সেপ্টেম্বর ‘কিছু পাওয়া যায়নি’ উল্লেখ করে ফাইনাল রিপোর্ট জমা দিয়েছেন। ২৯ কঙ্কাল ঘিরে রহস্য : ২০১৩ সালের ২৩ আগস্ট যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার স্তূপ থেকে ২৯ টুকরো কঙ্কাল উদ্ধার করে পুলিশ। মৃধাবাড়ী এলাকার ময়লার ডাম্পিং স্টেশনে ডিসিসিকর্মীর পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা কঙ্কালগুলো দেখতে পান। এ ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানায় পুলিশ মামলা করে। এরপর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত হয়। পরে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা পাঠানো হয় ঢাকা মেডিক্যালের ডিএনএ ল্যাবরেটরিতে। যাত্রাবাড়ী থানার ওসি অবনী শঙ্কর কর গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেহাবশেষগুলো মেডিক্যাল বর্জ্য বলে ধারণা করা হচ্ছে। ডিএনএ রিপোর্টে এমনই এসেছে। তবে কোথা থেকে, কারা এসব দেহাবশেষ আবর্জনার সঙ্গে ফেলেছে, তা বের করা যায়নি। গত মাসে মামলার ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে।’ পাঁচ বছরে কিছুই উদ্ধার হয়নি : ২০০৯ সালের ২৯ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ার আমলাপাড়া এলাকার ড্রেন থেকে দুটি বস্তায় এক যুবকের ১২ টুকরো লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নরসিংদীর মাধবদী থানার নরেন্দ্রপুর গ্রামের সোবহান মেম্বারের বাড়ির ভাড়াটিয়া মাহমুদা বেগম নিহত ব্যক্তিকে তাঁর স্বামী সিরাজুল ইসলাম বলে দাবি করেন। আদালতের নির্দেশে ২০০৯ সালের ২৯ মে মাহমুদা বেগম ও তাঁর ছেলে মিজানুর রহমানের নমুনা সংগ্রহ করে ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। তবে এই ডিএনএ পরীক্ষায় নিহত ব্যক্তি সিরাজুল ইসলাম নন বলে জানা যায়। ছয় বছরেও হত্যার রহস্য বা নিহতের পরিচয় আর জানা যায়নি। নারায়ণগঞ্জ সদর থানার ওসি মঞ্জুর কাদেরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা তদন্ত করে কিছুই পাইনি। মামলাটি সিআইডিতে গেছে।’ পা দুটিও মিলিয়ে দেখা হয়নি : ২০১৩ সালের ১২ এপ্রিল রাজধানীর উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরে (আব্দুল্লাহপুর এলাকায়) একটি বাস কাউন্টারের পাশে ব্যাগের ভেতর থেকে এক তরুণীর দুই পা কাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এর চার দিন আগে আশুলিয়া এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় পা দুটি। আট দিন পর তাকে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয় জুরাইন কবরস্থানে। এ ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করে পুলিশ। তবে নিহতের পরিচয় উদ্ধার তো দূরের কথা, পা দুটি একজনের কি না, তাও খতিয়ে দেখেনি পুলিশ। উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আশরাফুল কবির খান বলেন, ‘মেয়েটির পরিচয়ও পাইনি। আমরা ডিএনএ নমুনা রেখেছিলাম। তবে পা একরকম নয় বলে মিলিয়ে দেখা হয়নি। মামলাটি ডিবিতে গেছে।’ হিমাগারে বিপ্লব হত্যা মামলা : ২০০৭ সালের ৯ এপ্রিল রংপুরের কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের গণিত বিভাগের ছাত্র হাসিবুল ইসলাম বিপ্লবের ২৮ খণ্ড লাশ উদ্ধার করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলে থাকা মামলাটি এখন হিমাগারে। ১৭ জন তদন্ত কর্মকর্তা বদল হলেও কোনো কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। শনাক্ত হয়নি খুনি। মামলার ১৬তম তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সুরেশ চন্দ্র বলেন, ‘মামলাটি তদন্তাধীন আছে। এখনো কিছু বের হয়নি।’ ১৩ টুকরো নারী কে? : গত বছরের ১০ আগস্ট তুরাগের চণ্ডালভোগ ব্রিজের পাশ থেকে তুরাগ থানার এসআই আল-আমিন একটি কাপড়ের ব্যাগে তরুণীর দেহের পাঁচটি টুকরো উদ্ধার করেন। একই দিন উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর রোডের ২ নম্বর বাড়ির পাশে আরেকটি ব্যাগ থেকে আরো আটটি টুকরো উদ্ধার করেন উত্তরা (পশ্চিম) থানার এসআই হযরত আলী। তুরাগ থানার ওসি আবির মাহমুদ বলেন, ময়নাতদন্তে লাশের অংশগুলো মিলিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে, ১৩ টুকরো একই তরুণীর। মাথাটি উদ্ধার করতে পারলে তার পরিচয় পাওয়া সহজ হতো এবং তদন্ত কাজ দ্রুত শেষ করা যেত। স্বজনের অভিযোগেই রহস্য উন্মোচন : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিহতের পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতেই বেশির ভাগ খণ্ডিত লাশের খুনিকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। স্বজনরা মর্গে গিয়ে বা ছবি দেখে লাশ শনাক্ত করার উদ্যোগ না নিলে মেলেনি পরিচয়। এ সময়ের সুযোগ নিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছে খুনিরা। ২০১৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর হাজারীবাগের ওয়াসপুর থেকে তরুণীর মস্তকবিহীন খণ্ডিত লাশ উদ্ধার করা হয়। ঘটনার ব্যাপারে হাজারীবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) এস এম মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘নিহত মেয়েটির পরিচয় ও হত্যার মোটিভ পাওয়া গেছে। তবে হত্যার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা যায়নি। মামলা সম্প্রতি ডিবিতে গেছে।’ ২০১২ সালের ১২ নভেম্বর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে এক যুবকের খণ্ডিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার দুই দিন পর নিহতের পরিচয় শনাক্ত করে স্বজনরা। এরপর এক হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে অন্য আসামিরা পলাতক। মামলাটি বর্তমানে সিআইডিতে তদন্তাধীন বলে জানান দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি। ২০১২ সালের ২ মে রাজধানীর পরীবাগের নাহার প্লাজা থেকে তরুণীর ২৬ টুকরো লাশ; গত বছরের ১২ ও ৩১ জানুয়ারি উত্তরা থেকে দুই গৃহকর্মীর খণ্ডিত লাশ; ২০১৩ সালের ২৩ জুন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় শিশু ইমন হোসেনের ৯ খণ্ড লাশ; একই বছরে ১৯ এপ্রিল কামরাঙ্গীর চরের ব্যবসায়ী মনিরের সাত টুকরো লাশ; ৩০ জুলাই মানিকগঞ্জে গৃহবধূ জোসনা সূত্রধরের লাশ; ৩১ মে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার সীমান্তবর্তী গড়গড়ি ইউনিয়নের আব্দুল জব্বারের ২২ টুকরো লাশ; ৫ এপ্রিল সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার নন্দিরগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার প্রফুল্ল নমশূদ্রের চার টুকরো লাশ এবং ৩ মে যশোরের নওয়াপাড়া বাজারের সার ব্যবসায়ী ও শ্রীধরপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফরিদ হোসেনের খণ্ডিত লাশ উদ্ধারের পর পরিবারের অভিযোগে হত্যার রহস্য উন্মোচিত হয়েছে।

No comments:

Post a Comment