Thursday, March 12, 2015

এমন কিছুই চেয়েছিলেন রুবেল:প্রথম অালো

জেমস অ্যান্ডারসনকে বোল্ড করে ম্যাচ শেষ করে দেওয়ার পর যখন তিনি উৎসবের মধ্যমণি, রুবেল হোসেনের কি মনে পড়ছিল ঠিক দুই মাস আগে এই দিনে কোথায় ছিলেন? ছিলেন জেলে। বিষণ্ন-একাকী রুবেল কি তখন কল্পনাও করতে পেরেছিলেন দুই মাস পরের অ্যাডিলেডের এই রাত! রুবেলের হাসিতে বিষণ্নতা মিশে থাকে, ‘না, কীভাবে ভাবব? তখন তো বিশ্বকাপে আসতে পারব কি না, এটাই জানতাম না। ভীষণ কঠিন একটা মামলা দিয়েছে আমার নামে!’ বাংলাদেশ দল অস্ট
্রেলিয়া রওনা হওয়ার সপ্তাহ দুয়েক আগে রুবেলের ওই তিন রাতের কারাবাস। জামিনে মুক্তি পেয়ে দলের সঙ্গী হলেও সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন বড় একটা প্রশ্ন। কোনো দিন দুঃস্বপ্নেও যা ভাবেননি, এমন একটা ঝড় বয়ে যাওয়ার পর বিশ্বকাপে কি আদৌ মেলে ধরতে পারবেন নিজেকে? তাঁকে নিয়ে চারদিকে এত আলোচনা-সমালোচনা, এই চাপ সামলানো কি সহজ কথা! বিশ্বকাপে আসা নিয়ে রুবেলের মনে সংশয় ছিল, তবে ওই ‘চাপ-টাপ’ নাকি তাঁকে একটুও ভাবায়নি! দাবি করলেন, ‘ওটা কোনো চাপ ছিল না। আমার একটা বড় সুবিধা হলো, মাঠে নামলে আমি সব ভুলে যাই।’ টিমমেটরাও খুব সাহায্য করেছে। তা করার দুটি উপায় ছিল। প্রসঙ্গটা একদমই না তুলে। অথবা সেটিকে হালকা করে দিয়ে। রুবেলের সতীর্থরা দ্বিতীয়টি পথটাই বেছে নিয়েছেন। রুবেল হাসলেই কেউ না কেউ বলেছেন ‘রুবেল ইজ হ্যাপি’, তাঁর মুখের সামনে অদৃশ্য মাইক্রোফোন নিয়ে কেউ বা ইন্টারভিউ নিয়েছেন, ‘রুবেল, আর ইউ হ্যাপি?’ ব্যাপারটা নিয়ে এমন হাসিঠাট্টায় জেলে ওই তিন রাতের দুঃস্বপ্ন আর মাথার ওপর ঝুলতে থাকা ‘ভীষণ কঠিন মামলা’ আর তাড়িয়ে বেড়ায়নি রুবেলকে। ওই দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার আগেই বিশ্বকাপ নিয়ে নিজের একটা স্বপ্নের কথা জানিয়েছিলেন। কোনো একটা বড় দলের বিপক্ষে ৪-৫ উইকেট নিয়ে জিতিয়ে দেবেন বাংলাদেশকে। যখন তা বলছেন, চোখের সামনে যত না ইংল্যান্ড ভেসেছে, তার চেয়ে বেশি নিউজিল্যান্ড। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দুর্দান্ত রেকর্ড রুবেলের। ২০১০ সালে ‘বাংলাওয়াশ’ সম্পন্ন হয়েছিল তাঁর হাতেই। কাইল মিলসের স্টাম্প ছত্রখান করে দিয়ে স্কোরলাইন ৪-০ করে দিয়েছিলেন তিনিই। ৪ উইকেট নিয়ে ম্যাচ অব দ্য ম্যাচও। তিন বছর পর আরেকটি ‘বাংলাওয়াশ’-এ আরও বেশি উজ্জ্বল। মিরপুরে ২৬ রানে হ্যাটট্রিকসহ ৬ উইকেট। অ্যাডিলেডে বাংলাদেশকে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে তুলে দেওয়া পারফরম্যান্সও ছাড়িয়ে যেতে পারছে না যেটিকে, ‘এটাও চিরদিন মনে থাকবে। তবে আমার কাছে নিজের সেরা বোলিং নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওই ৬ উইকেটের ম্যাচটিই।’ অ্যাডিলেডে একটি ওভারকে অবশ্য সবার ওপরেই রেখে দিচ্ছেন। ইংল্যান্ড ইনিংসের ২৭তম ওভারের ছয়টি বলই তাঁর কথা শুনেছে। চার বলের মধ্যে বেল ও মরগানকে তুলে নিয়েছেন ওই ওভারেই। ৪৯তম ওভারটি যখন করতে এলেন, ইংল্যান্ড তখনো ম্যাচে আছে। কী ভাবছিলেন রুবেল? ‘ওভারটা শুরুর আগে সাকিব ভাই আমাকে বলেছিলেন, আমি জানি তুই পারবি। মাশরাফি ভাইও একই কথা বললেন। আমারও মনে হলো পারব। প্রথম বলটা যখন রিভার্স করল, তখনই নিশ্চিত হয়ে যাই এই ওভারেই একটা কিছু হয়ে যাবে।’ রিভার্স করল মানে কী, রুবেল কি জেনেশুনে রিভার্স সুইং করানোর চেষ্টা করেননি? ‘বলটা ঠিকঠাক বানালে আমার অ্যাকশনের কারণে এমনিতেই আমি রিভার্স সুইং পাই।’ রিভার্স সুইংটা সহজাত হতে পারে, তবে তিন বলে ওই দুটি বোল্ড, যা দেখে তাসমান সাগরের ওপারে স্যার রিচার্ড হ্যাডলি পর্যন্ত মুগ্ধ, তার পেছনে অনেক পরিশ্রম লুকিয়ে। ‘গত কিছুদিন ইয়র্কার নিয়ে আমি অনেক কাজ করেছি। আমার সেই পরিশ্রম সার্থক হয়েছে’—রুবেলের মুখে তৃপ্তির হাসি। সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি দলের এমন একটা সাফল্যে বড় ভূমিকা রাখতে পেরে, ‘আমি সব সময়ই চাই, বাংলাদেশ জিতলে যেন তাতে আমার অবদান থাকে। সবাই যেন বলে, বাংলাদেশ জিতেছে, রুবেল ৩ উইকেট পেয়েছে বা ২ উইকেট পেয়েছে।’ অবলীলায় ১৪০ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যাচ্ছে তাঁর বলের গতি। প্রায়ই তা ১৪৫-১৪৬ ছুঁয়ে ফেলছে। সত্যিকারের এক ফাস্ট বোলার। কিন্তু মাঠের বাইরের রুবেলকে দেখে তা বোঝার সাধ্য কার! ফাস্ট বোলারসুলভ ঔদ্ধত্য দূরে থাক, মুখ থেকে কথাই বেরোতে চায় না। বেরোলেও একেবারে অনুচ্চ স্বরে। সেই রুবেলই বল হাতে পেলে বদলে যান। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে তাঁর উদ্যাপন টেলিভিশনের হাইলাইটস হয়েছে। বোলিংয়ের সময় মুখের হাসিটা বলে দিয়েছে, অ্যাডিলেডের উইকেটে বোলিং করাটা কেমন উপভোগ করছেন। প্রসঙ্গটা তুলতেই মুখে ফিরে এল সেই হাসিটা, ‘এমন উইকেট পেলে বোলিং করতে খুব মজা লাগে। দেখলেন না, আমরা তিন পেস বোলারই ওদিন কেমন ভালো বোলিং করেছি। বাংলাদেশে তো আমরা কখনো উইকেটের সাহায্য পাই না। তা মেনে নিয়ে ওভাবেই নিজেদের প্রস্তুত করি। তবে মাঝেমধ্যে একটু আফসোস তো হয়ই।’ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের পর ড্রেসিংরুমে উদ্যাপনের সময় জেলের ওই স্মৃতি উঁকি দিয়ে গেছে রুবেলের মনে। অনেকের প্রতি কৃতজ্ঞতাও, ‘জেলে সবাই আমার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেছে। সবাই বলেছে, আপনি অবশ্যই ছাড়া পেয়ে যাবেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে ধন্যবাদ দিতে চাই এর পরও আমাকে দলে রাখার জন্য। সাধারণ মানুষও আমাকে অনেক সমর্থন দিয়েছে আর বাগেরহাটের মানুষের কথা কী বলব! তাঁরা আমার জন্য মিছিল পর্যন্ত করেছে।’ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওই ম্যাচ জেতানো বোলিংয়ের পরও বাংলাদেশে বেরোনো মিছিলে রুবেল-রুবেল ধ্বনি উঠেছে বলে শুনেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেওয়ার তোড়জোড়ও নাকি শুরু হয়েছে। সব মিলিয়ে রুবেল এখন সত্যিই ‘হ্যাপি’—এটা কি লেখা যায়? প্রশ্নটা শুনে রুবেল শুধু লাজুক হাসেন।

No comments:

Post a Comment