Wednesday, September 17, 2014

রিয়াজউদ্দিন বাজারে ইয়াবার আড়ত:কালের কন্ঠ

মরণনেশা ইয়াবার আড়তের সন্ধান পাওয়া গেছে চট্টগ্রাম মহানগরের রিয়াজউদ্দিন বাজারে। সড়কপথে কড়াকড়ির কারণে কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে বঙ্গোপসাগর দিয়ে ট্রলারযোগে ইয়াবা পৌঁছে যাচ্ছে বন্দর নগরে। আর তা মজুদ হচ্ছে খাতুনগঞ্জ, ফিশারিঘাট ও রিয়াজউদ্দিন বাজারে। একাধিক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এখানে বসে সারা দেশে ইয়াবা পাচার করছে। পাচারের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রাইভেট কার। চট্টগ্রামের ‘আড়ত’ থেকে ইয়াবার চালান যাচ্ছে ঢাকা,
ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। চোরাকারবারিদের নিয়োগ করা পেশাদার ইয়াবা বহনকারীরা দুই থেকে চার হাজার টাকার বিনিময়ে ইয়াবা গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছে। সর্বশেষ গত রবিবার ভোরে বঙ্গোপসাগরে একটি ট্রলারে তল্লাশি চালিয়ে দুই লাখ ২০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে নৌবাহিনী। এর আগে কোতোয়ালি থানা পুলিশ উদ্ধার করে সাড়ে ১৭ হাজার ইয়াবা। সেই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলা তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ রিয়াজউদ্দিন বাজারে এই ‘আড়তের’ সন্ধান পায়। ইয়াবার উৎস, গন্তব্য ও পাচারকারী চক্রের সন্ধানে কাজ করছেন এমন কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার ধারণা, উদ্ধার করা ইয়াবা নগরের রিয়াজউদ্দিন বাজার, খাতুনগঞ্জ কিংবা আছদগঞ্জের কোনো আড়তে আসছিল। বন্দর নগরের ইয়াবা কারবারিদের মধ্যে অন্যতম হিসেবে উঠে এসেছে রিয়াজউদ্দিন বাজারের মঞ্জুর আলম ওরফে কানা মঞ্জুরের নাম। পুলিশের তালিকায় নাম রয়েছে খাতুনগঞ্জ ও ফিশারিঘাটের আরো বেশ কিছু ব্যবসায়ীর। দেশের অন্যতম বৃহৎ ভোগ্যপণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জের আছদগঞ্জের আড়ত থেকে পৌনে তিন লাখ ইয়াবা উদ্ধার, খাতুনগঞ্জের কয়েকজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ইয়াবা পাচারকারী চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ এবং সর্বশেষ রিয়াজউদ্দিন বাজারে আড়তের সন্ধান পাওয়ায় বিস্মিত হয়েছেন খোদ নগর পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কমিশনার বনজ কুমার মজুমদার। গত সোমবার কালের কণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘রিয়াজউদ্দিন বাজারে ইয়াবার আড়তদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের নাম প্রকাশ পাচ্ছে। তবে পাচারকারী চক্র যত শক্তিশালীই হোক তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আসতে হবে।’ খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ, ফিশারিঘাট ও সর্বশেষ রিয়াজউদ্দিন বাজারের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের একটি শক্তিশালী চক্রের সন্ধান পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে এম মহিউদ্দিন সেলিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমানে ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীদের চক্রটি খুবই শক্তিশালী। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে এখনো সুনির্দিষ্ট মামলা না হওয়ায় এ বিষয়ে কোনো তথ্য দেওয়া যাবে না। আমরা ধারাবাহিকভাবে পুরো চক্রকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চালাচ্ছি।’ যেভাবে আড়তের সন্ধান পায় পুলিশ : কোতোয়ালি থানা পুলিশ গত ২২ জুলাই চৈতন্যগলি বিছমিল্লাহ কমপ্লেক্সের ষষ্ঠ তলার একটি কক্ষে অভিযান চালিয়ে ১৭ হাজার ৫০০ পিস ইয়াবা বড়িসহ আতিকুল ইসলাম আতিক নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে। আতিক পুলিশকে জানান, তিনি মঞ্জুর আলম ওরফে কানা মঞ্জুর মালিকানাধীন জাহেদ ট্রেডার্সের কর্মী। ওই দোকান মালিকই ইয়াবার ব্যবসা করেন। এ বিষয়ে দায়ের করা মামলায় আতিককে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক জহির হোসেন। তদন্ত টিমে সম্পৃক্ত করা হয় উপপরিদর্শক মোহাম্মদ কামরুজ্জামানকেও। তদন্তকারী দুই কর্মকর্তা জানান, তদন্ত শুরুর পর তাঁরা জানতে পারেন জেলার সাতকানিয়া উপজেলার রূপকানিয়া গ্রামের আব্দুল করিমের ছেলে মঞ্জুর আলম রিয়াজউদ্দিন বাজারের ডিম গলিতে সিগারেটের ব্যবসার আড়ালে একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে ইয়াবা পাচার করেন। পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তারের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু ইতিমধ্যে মঞ্জুর আলম ওরফে কানা মঞ্জুর উচ্চ আদালত থেকে চার সপ্তাহের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নেন। এরপর কানা মঞ্জুর নানাভাবে পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে এক কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে মামলাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টাও চালান। এমনকি তাঁর পূর্ব পরিচিত পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক শেখ ওবাইদুর রহমান, অন্য একজন উপপরিদর্শক ও কথিত সাংবাদিকের মাধ্যমে তদবিরও করেন। উপপরিদর্শক কামরুজ্জামান জানান, উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেওয়ার সময় মঞ্জুর হলফনামায় দাবি করেন, তিনি নন; প্রকৃত ইয়াবা ব্যবসায়ী মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু। তাঁর বাবার নাম আবু তাহের। এই মঞ্জু পতেঙ্গায় ১০০ ইয়াবা বড়িসহ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। এখন তিনি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি। এবার পতেঙ্গা থানায় গ্রেপ্তারকৃত মঞ্জুকে দুই দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে কোতোয়ালি পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি ইয়াবার আড়তের তথ্য জানান। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের দ্বিতীয় দিন গত সোমবার দুপুরে কোতোয়ালি থানায় কালের কণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালেও তিনি বিস্তারিত তথ্য দেন। পরে বিকেলে মহানগর হাকিম সৈয়দ মাশফিকুল ইসলামের আদালতে আট পৃষ্ঠার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন তিনি। মঞ্জু জানান, ১৩ আগস্ট রিয়াজউদ্দিন বাজারের ডিম গলির সিগারেটের পাইকারি দোকান জাহেদ ট্রেডার্সের মালিক কানা মঞ্জুর তাঁকে এক হাজার ইয়াবা দিয়ে পতেঙ্গা থানায় এক ক্রেতাকে পৌঁছে দিতে বলেন। পরে তিনি ওই ক্রেতাকে ইয়াবা বুঝিয়ে দেওয়ার সময় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। তিনি আরো জানান, প্রায় ৯ মাস ধরে কানা মঞ্জুর তাঁকে ইয়াবা পাচারকারী হিসেবে ব্যবহার করছেন। তাঁর দেওয়া ইয়াবা তিনি ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাচার করেছেন। প্রতিবার ইয়াবা পাচার করলে মঞ্জু খরচ বাদ দিয়ে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা পান। মঞ্জু জানান, ধৃত আতিক কানা মঞ্জুরের দোকানের ব্যবস্থাপক। যে কক্ষটি থেকে ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে সেটির মালিক জানে আলম। কক্ষ মালিকের কাছ থেকে কানা মঞ্জুরের নির্দেশে তিনি মাসিক সাড়ে চার হাজার টাকায় ভাড়া নিয়েছেন। তবে কক্ষের ভাড়া পরিশোধ করতেন কানা মঞ্জুর। ওই কক্ষে জাহেদ ট্রেডার্সের কর্মীরা রাত যাপন করতেন এবং ইয়াবা সংরক্ষণ করা হতো। আর আতিক ইয়াবা গণনা ও পাচারের জন্য ভাগ করে দায়িত্বপ্রাপ্ত পাচারকারীদের হাতে তুলে দিতেন। জাহেদ ট্রেডার্সের মালিক কানা মঞ্জুরের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় ২০১১ ও ২০১২ সালে ইয়াবা পাচারের দায়ে দুটি মামলা হয়। মামলা দুটি বিচারাধীন। এরপর সাড়ে ১৭ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় দায়ের করা মামলায়ও তাঁকে আসামি করা হয়। সর্বশেষ পতেঙ্গায় ইয়াবাসহ মঞ্জু গ্রেপ্তার হওয়ার মামলায়ও কানা মঞ্জুরকে আসামি করা হচ্ছে বলে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে। আর তাহলে সব মিলিয়ে কানা মঞ্জুরের বিরুদ্ধে ইয়াবা পাচার মামলার সংখ্যা দাঁড়াবে চারটি। তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, কানা মঞ্জুরের দূর সম্পর্কের আত্মীয় মঞ্জু। এই সুবাদে কক্ষটি ভাড়ায় তিনি মধ্যস্থতা করেন। ওই কক্ষ থেকে ইয়াবা উদ্ধারের পর মঞ্জুরকে ফাঁসিয়ে দিতেই তাঁকে পতেঙ্গা থানায় ইয়াবাসহ ধরিয়ে দেন কানা মঞ্জুর। এরপর উচ্চ আদালত থেকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পান তিনি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। সোমবার আদালতে মঞ্জু জবানবন্দি দেওয়ার পর পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। ইয়াবার ‘আড়তদার’ হিসেবে পুলিশের খাতায় যেসব ব্যবসায়ীর নাম : নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত সিন্ডিকেটের সদস্য এবং বর্তমানে ইয়াবা পাচারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ফিশারিঘাটের কামাল সওদাগর, পতেঙ্গার আবদুর নূর, আনোয়ারার কামু ও হাসান মাঝি, পটিয়ার চান মিয়া, খাতুনগঞ্জের বশর, আবু ছৈয়দ, ওসমান গণি ও আতিক; রিয়াজউদ্দিন বাজারের কানা মঞ্জুর, পাখি গলির কালাম, টেকনাফে অবস্থানরত বাঁশখালীর সেলিম, পটিয়ার জোবায়ের ও সাইফুল, টেকনাফের স্থায়ী বাসিন্দা বর্তমানে নগরীর চান্দগাঁও থানা এলাকায় বসবাসরত একটেল রমজান এবং বাইট্টা আইয়ুব। দাম ও বিক্রির কৌশল : মঞ্জুরুল আলম পুলিশকে জানিয়েছে, সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন ইয়াবার দাম পাইকারি বাজারে কমেছে। ওয়াই কে নামের ইয়াবা পাইকারি বাজারে ‘চাম্পা’ ও আর সেভেন ‘বড়টা’ নামে পরিচিত। পাইকারি বাজারে চাম্পা বিক্রি হচ্ছে প্রতি হাজার ৭৫ হাজার টাকায়। এক হাজার ইয়াবা কিনতে হলে ক্রেতাকে প্রথমে ২৫ হাজার টাকা (তিন ভাগের এক ভাগ) মূল্য বিকাশে পরিশোধ করতে হয়। বাকি টাকা ইয়াবা বুঝে পাওয়ার পর নগদ পরিশোধের শর্ত থাকে। কানা মঞ্জুর ইয়াবা নিয়ে একাধিক পাচারকারীকে দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠিয়ে থাকেন। তবে একজন পাচারকারী অন্য পাচারকারীকে চেনে না। প্রভাব বিস্তারকারী পুলিশ ও সাংবাদিক : কানা মঞ্জুরের জাহেদ ট্রেডার্সের কর্মীদের থাকার কক্ষ থেকে সাড়ে ১৭ হাজার ইয়াবাসহ ব্যবস্থাপক আতিক গ্রেপ্তার হওয়ার পর মামলাটি ধামাচাপা দিতে একাধিক পুলিশ ও সাংবাদিক কানা মঞ্জুরের পক্ষে তদবির করেন। পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শককেও তদবিরে ব্যবহার করা হয়। পরে একাধিক মোবাইল নম্বর থেকে সাংবাদিক পরিচয়েও তদবির করা হয়। সাংবাদিক পরিচয়ে তদবির করা ফোন নম্বরগুলো অবশ্য বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। আর সহকারী উপপরিদর্শক শেখ ওবাইদুর রহমান বলেন, ‘আমি এখন বান্দরবান জেলায় কর্মরত আছি। তবে সিএমপিতে বদলি হয়েছি।’ কানা মঞ্জুরের পক্ষে কোতোয়ালি থানায় তদবির করতে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি এই বিষয়ে আসলেই কিছু জানি না।’ কানা মঞ্জুরের ভাষ্য : ইয়াবার ‘আড়তদার’ হিসেবে অভিযুক্ত জাহেদ ট্রেডার্সের মালিক কানা মঞ্জুর কালের কণ্ঠের প্রশ্নের জবাবে তাঁর ইয়াবা-সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। ইয়াবাসংক্রান্ত দুটি মামলা আদালতে বিচারাধীন থাকার বিষয় স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমাকে ইয়াবা মামলায় জড়ানো হয়েছে।’ নিজের প্রাইভেট কারে করে বিভিন্ন জেলায় ইয়াবা পাচার এবং আবু তাহেরের ছেলে মঞ্জুরুল আলমকে ইয়াবা পাচারে ব্যবহারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি ওই মঞ্জুকে চিনি না। প্রাইভেট কারে ইয়াবাও বহন করিনি।’ জাহিদ ট্রেডার্সের ভাড়া করা কক্ষ থেকে সাড়ে ১৭ হাজার ইয়াবা উদ্ধারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ধৃত আতিক আমার দোকানের কর্মী নন; ওই কক্ষটিও আমি ভাড়া করিনি। এর পরও পুলিশ আমার নাম দেওয়ায় আমি উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন নিয়েছি।’

No comments:

Post a Comment