Friday, March 27, 2015

রংপুরে মাদকের বিস্তার, কিশোরেরাও আসক্ত:প্রথম অালো

চেম্বারের ভেতরে বসে ডাক্তার সাহেব গঞ্জিকায় দম দিচ্ছেন। বাহিরে রোগীরা অপেক্ষমাণ। একটু পরেই তিনি রোগী দেখা শুরু করবেন। ঠিক তখনই বেরসিকের মতো বিনা নোটিশে পুলিশের আবির্ভাব। ওরা একটু ‘সেলিব্রেট’ করছিল জেএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ার আনন্দে। পান করছিল ফেনসিডিল। সরবরাহকারী তাদেরই স্কুলের কতিপয় ‘বড় ভাই’। পুলিশের কবলে পড়ল আট-নয়জনের এই দলটিও। এবার পুলিশ অভিযানে গেল একটি ছাত্রী হোস্টেলে। আবর্জনা রাখার জায়গা থ
েকে পাওয়া গেল ফেনসিডিলের ৪০টি খালি বোতল। এই তিনটি ঘটনাই রংপুর শহরের। তথ্যটি জানালেন খোদ রংপুরের জেলা প্রশাসক ফরিদ আহাম্মদ। এ থেকেই শহরে মাদকের বিস্তারের ভয়াবহতা আঁচ করা যায়। তিনি আরও জানান, পুলিশি অভিযানের পাশাপাশি তাঁরা ভ্রাম্যমাণ আদালত করে মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করে বিভিন্ন মেয়াদের সাজা দিচ্ছেন। কারণ, অনেক সময় পুলিশি অভিযানে গ্রেপ্তারকৃতরা আদালতে জামিন নিয়ে বের হয়ে আসেন। প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত গত ছয় মাসে ১৯০ জন মাদক বিক্রেতাকে বিভিন্ন মেয়াদের সাজা দিয়েছেন। এর মধ্যে ব্যবসায়ী চক্রের অন্যতম হোতা ‘হাওয়া’ নামের এক নারীকে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এই হাওয়াকে এর আগে ১১ বার পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। জেলা প্রশাসক আরও যে তথ্য দিলেন তা রীতিমতো ভয়াবহ। এখন নাকি রংপুর শহরে স্কুলের শিশুদের দিয়ে মাদক বিক্রি করানো হচ্ছে। স্কুল বা পাড়ার বড় ভাইয়েরা তাদের মাদক সেবনে উৎসাহিত করছে এবং ১০ বোতল ফেনসিডিল বিক্রি করতে পারলে তাদের জন্য এক বোতল ‘ফ্রি’। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ফিরে দেখা : গত বছর ২৭ আগস্ট প্রথম আলোর শেষ পাতায় ‘হাত বাড়ালেই মাদক’ শিরোনামে রংপুর শহরে মাদকের বিস্তার নিয়ে একটি সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। সে সময় শহরে মাদকের যে ভয়াবহ চিত্র দেখেছি, আট মাস পরে এসে মনে হলো অবস্থার কোনো বিশেষ উন্নতি তো হয়ইনি বরং আরও অবনতি ঘটেছে। গত বছর প্রথম আলোয় ওই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ায় পুলিশ প্রশাসন ব্যাপক তৎপর হয়েছিল। শহরের অন্তত আটটি স্থানে বসানো হয়েছিল চেকপোস্ট। মাদকের অনেক চেনা আখড়ায় চালানো হয়েছিল অভিযান। মাদকসেবীরা টাকা জোগাড় করতে ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি করে বেড়াত। শহরের ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে গিয়েছিল ব্যাপক। সন্ধ্যার পরে তো বটেই, দিনের বেলাতেও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটত অহরহ। পুলিশি অভিযানে ছিনতাইকারীদের ধরপাকড়ের পাশাপাশি পাড়ায় পাড়ায় মাদক প্রতিরোধ কমিটি করে ব্যাপক সমাবেশ করা হয়েছিল। ছিনতাইকারীদের দাপট ইদানীং বেশ কমেছে। তবে মাদকের অবস্থা যথাপূর্বং। সারা শহরেই মাদক: মাদক বিক্রেতারা এখন তাদের কৌশল পাল্টেছে বলে মন্তব্য করলেন রংপুর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের গ্রন্থাগারিক আবু আজাদ রহমান। তিনি জানালেন, বইয়ের ভ্যান নিয়ে চলাচলের সময় বিভিন্ন এলাকার মোড়ে মাদকসেবীদের জটলা চোখে পড়ে, বাতাসে ভেসে আসে গাঁজার গন্ধ। কোথায় যে মাদক বিক্রয় হয় আর কোথায় হয় না, তা বলাই দুঃসাধ্য। লাইট হাউস নামে শহরের একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের সহকারী কাউন্সেলর কে এম ফরিদ জানালেন, ক্রেতাদের আর বিক্রেতাদের কাছে যেতে হচ্ছে না। মোবাইল ফোনে নিজের অবস্থানের কথা বলে দিলেই বিক্রেতা বা তার লোক মাদক পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছে। তাঁর কাছেই জানা গেল এখন ইয়াবা বড়ি চলছে সবচেয়ে বেশি। জিনিসটি ছোট। পরিবহন ও সেবনেও সুবিধা। হেরোইন আর ফেনসিডিলের চেয়ে দামেও কম। রংপুরে প্রতি বড়ি ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়। ফেনসিডিলের বোতল ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা। তাঁদের নিরাময় কেন্দ্রে যারা আসছে, তাদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ। তারাই জানিয়েছে এসব তথ্য। লাইট হাউস ছাড়াও রংপুর শহরে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ১০টি। এসব নিরাময় কেন্দ্রে মাসে গড়পড়তা শদুয়েক আসক্ত ভর্তি হন। এ ছাড়া অনেক নিরাময় কেন্দ্রে প্রতি শুক্রবার নিয়মিত ‘কাউন্সেলিং’ হয়। তাতেও ৫০-৭০ জনের মতো উপস্থিত থাকেন। কে এম ফরিদ ও অন্য একটি নিরাময় কেন্দ্রের পরিচালক গুলশান আরা ইয়াসমিন জানান, মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চললেও পরিস্থিতির বিশেষ হেরফের হয়নি। কেন্দ্রগুলোতে নিরাময়প্রত্যাশীদের ভিড় লেগেই আছে। জেলা পুলিশ সুপার মো. আবদুর রাজ্জাক জানান, মাদকের বিরুদ্ধে যে নিয়মিত অভিযান চলছিল, তা অব্যাহত আছে। গ্রেপ্তারও হচ্ছে অনেক। এতে মাদকের প্রকোপ কমেছে। পুলিশের বিশেষ শাখার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত মাদক, ছিনতাই, চুরি এসবের অভিযোগে জেলায় ২ হাজার ২০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক দিলারা রহমান বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের অভিযান, ভ্রাম্যমাণ আদালতের পাশাপাশি তাঁদেরও নিজস্ব কার্যক্রম চলছে। প্রতি মাসে অন্তত ১২টি করে অভিযান তাঁরা পরিচালনা করছেন। এই অভিযানে টিটু নামে রংপুরে ইয়াবা চক্রের হোতাকে আটক করা হয়েছে। রংপুরে ইয়াবার আসক্তিই বেশি। তাঁদের লোকবলের স্বল্পতা রয়েছে, সীমাবদ্ধতার মধ্যে দিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। সামাজিক আন্দোলন: মাদকের ভয়াবহতা তুলে ধরা ও মাদক সেবনের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য শহরে বিচ্ছিন্নভাবে সামাজিক আন্দোলন চলছে। তবে ব্যাপক ও নিয়মিত যে সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন, তা যথাযথভাবে গড়ে উঠছে না বলে মনে করেন সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি অধ্যাপক মলয় কিশোর ভট্টাচার্য। জেলা প্রশাসক ফরিদ আহাম্মদ জানান, গত অক্টোবরে প্রথম আলোর সংবাদটি প্রকাশের পর ৩৩টি ওয়ার্ডে সচেতনতা তৈরির বিষয়ে কাজ করা তাঁর পক্ষে সুবিধাজনক হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি কমিটি করা হয়েছে। এ ছাড়া জেলার বিভিন্ন এলাকার ৩৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদকবিরোধী সমাবেশ করেছেন। তার পরেও রংপুর শহরে যেভাবে মাদকের বিস্তৃতি ঘটছে, তার কবল থেকে শিশু-কিশোর থেকে পরিণত-প্রবীণেরাও রেহাই পাচ্ছেন না। মাদক শহরবাসীর একটি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

No comments:

Post a Comment