বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে ১০ হাজার কনস্টেবল নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ আসছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। ইতিমধ্যে গতকাল রবিবার পর্যন্ত দেশের সাতটি জেলা থেকে অভিযোগ জমা পড়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নিয়োগপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার জন্য সংশ্লিষ্ট বিধিমালায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঠাকুরগাঁওসহ সাতটি জেল
া থেকে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের নেতারা নিয়োগবাণিজ্যের অভিযোগ করেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এসব অভিযোগে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগে ব্যাপক অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাত লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে কনস্টেবল পদে নিয়োগ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করা হয়েছে। তবে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তার সব সত্যি নয়। কোনো কোনো এলাকায় জনপ্রতিনিধিরা তালিকা দিয়েছেন। তাঁদের তালিকাভুক্তরা শারীরিক যোগ্যতাসম্পন্ন না হওয়ায় বাদ পড়েছেন। এ কারণে তাঁরা ঢালাও অভিযোগ করেছেন। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে চাকরি দেওয়ার কথা বলে জনপ্রতিনিধিরা প্রার্থীদের থেকে টাকা নিয়েছেন-এমন খবর রয়েছে। আর শেষ পর্যন্ত চাকরি না হওয়ায় এখন ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ আনা হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অনেকেই অনেক অভিযোগ করেন। কেউ মৌখিকভাবে অভিযোগ করেছেন, আবার কেউ লিখিত অভিযোগপত্রও দিয়েছেন। আমরা এসব অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি।’ এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘যে নিয়মে এখন নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে সেটিকে কিভাবে আরো স্বচ্ছ করা যায়, সে ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কাজ করা হচ্ছে।’ এদিকে নিয়োগপ্রক্রিয়ায় পুলিশের অনিয়মের অভিযোগ এনে সংবাদ সম্মেলনও করা হয়েছে। গত শনিবার রাজবাড়ী প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন রাজবাড়ী-১ আসনের সংসদ সদস্য কাজী কেরামত আলী ও সংরক্ষিত আসনের এমপি কামরুন্নাহার চৌধুরী। তাঁরা বলেন, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজবাড়ীতে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগে অনিয়ম হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা পড়া অভিযোগগুলো এখনো আমাদের কাছে আসেনি। অভিযোগ হাতে পাওয়ার পর এ বিষয়ে তদন্ত করা হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘শুধু লিখিত অভিযোগ নয়, পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলেও তদন্ত করা হয়ে থাকে। গতকাল পর্যন্ত দুটি পেপার কাটিং পাওয়া গেছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে।’ নিয়োগবিধি পরিবর্তন হচ্ছে : সূত্র জানায়, তিনটি ধাপে পুলিশে নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। কনস্টেবল পদে নিয়োগ দেন জেলা পুলিশ সুপার। সাব-ইন্সপেক্টর নিয়োগ দেয় পুলিশ সদর দপ্তর। আর সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) নিয়োগ দেওয়া হয় বিসিএসের মাধ্যমে। প্রতিটি জেলায় পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের জন্য পাঁচজনের একটি কমিটি করা হয়ে থাকে। কমিটির প্রধান থাকেন জেলার পুলিশ সুপার। অন্যদের মধ্যে থাকেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও সহকারী পুলিশ সুপার। এ ছাড়া সিভিল সার্জন মনোনীত একজন চিকিৎসক ও পুলিশ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক মেডিক্যাল টিমে অন্তর্ভুক্ত থাকেন। তবে পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে থাকেন পুলিশ সুপারই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, নিয়োগ বোর্ডে শুধু পুলিশ কর্মকর্তারা থাকায় নিয়োগে স্বচ্ছতার অভাব থেকে যাচ্ছে। নিয়োগ বোর্ডে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি রাখা হলে হয়তো এত অভিযোগ আসত না। আর অভিযোগ এলেও সত্যটা সহজেই জানা যেত। এ অবস্থায় বিভিন্ন জেলা থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর সরকারের তরফ থেকে নিয়োগ বিধিমালায় পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এসপিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহ পুলিশ লাইনস মাঠে কনস্টেবল পদে জনবল নিয়োগের জন্য প্রাথমিক বাছাই শুরু হয়। এরপর লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয় ২৭ ফেব্রুয়ারি। ডাক্তারি পরীক্ষার পর চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয় ২৮ ফেব্রুয়ারি। এতে ১১০ জন পুরুষ ও ১৭ জন নারীকে চূড়ান্তভাবে মনোনীত করা হয়। অপেক্ষমাণ তালিকায় রাখা হয়েছে দুই নারীসহ ১০ জনকে। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংসদ সদস্য আবদুল হাই ঝিনাইদহের এসপি আলতাফ হোসেনের বিরুদ্ধে নিয়োগ-বাণিজ্যের অভিযোগ করেছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কাছে। কনস্টেবল নিয়োগে ঠাকুরগাঁওয়ের পুলিশ সুপার আবদুর রহিম শাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি ও নিয়োগ-বাণিজ্যের অভিযোগ করেন ঠাকুরগাঁও-২ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দবিরুল ইসলাম। অভিযোগে বলা হয়েছে, পুলিশ সুপার আবদুর রহিম শাহ চৌধুরী গানম্যান ও তাঁর অনুগতদের দিয়ে পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি দেওয়ার নামে অবৈধভাবে মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন করেছেন। কারো কারো কাছ থেকে সাত লাখ টাকা করে উৎকোচ আদায় করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম রাব্বানী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের গোলাম মোস্তফা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের আবদুল ওদুদ বিশ্বাস স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কাছে গত ৮ মার্চ লিখিত অভিযোগ করেন। তাতে বলা হয়েছে, গত ১৭ ফেব্রুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পুলিশ সুপার ছয়-সাত লাখ টাকা করে নিয়ে জামায়াত ও বিএনপির লোকদের নিয়োগ দিয়েছেন। ফলে দলীয় নেতা-কর্মীদের কাছে জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাঁদের ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এসব বিষয়ে জানার জন্য ঝিনাইদহ, ঠাকুরগাঁও ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের এসপিদের মোবাইল ফোনে গতকাল যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কেউ ফোন ধরেননি। পরীক্ষা নেওয়া হয় যেভাবে : দেশের ৬৪ জেলায় আট হাজার ৫০০ পুরুষ ও এক হাজার ৫০০ নারীসহ ১০ হাজার ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল নিয়োগ দেওয়ার জন্য গত ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলায় পরীক্ষা নেওয়া হয়। প্রথমে শারীরিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। শারীরিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের একই দিনে ৪০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মনস্তাত্ত্বিক ও মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে চূড়ান্তভাবে মনোনয়ন করা হয়। এখন নিয়োগপত্র দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
No comments:
Post a Comment