Monday, March 23, 2015

কান্না থামেনি স্বজনহারাদের:প্রথম অালো

টিনের বেড়া ও চালের দুটি ঘর, ৯ শতাংশ জায়গায়। সামনে একচিলতে উঠান। এর কিনারে বাঁশের বাখারি দিয়ে ঘেরা নতুন কবর। ঘরের দরজা খুললেই চোখে পড়ে কবরটি। চোখের পানি শুকায় না ইসমত আরা বেগমের। পেট্রলবোমা হামলায় নিহত স্বামী সৈয়দ আলীর কবর এটি। ইসমত আরা গত শনিবার কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘মাইট্যা আলু সেদ্দ খাইয়া তাঁই বাড়িত থেইকে গেল হয়। এক মুঠ ভাতও মুখত উঠিল না বাহে।’ গত ৬ ফেব্রুয়ারি রাতে গাইবান্ধার তুলসীঘাটে ঢ
াকাগামী নাপু পরিবহন নামের বাসে পেট্রলবোমা হামলায় যে আটজন প্রাণ হারান, সৈয়দ আলী তাঁদের একজন। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চণ্ডীপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ কালির খামার গ্রামে তাঁর বাড়ি। ঢাকায় তিনি রিকশা চালাতেন। বাকি সাতজনের মধ্যে ছয়জনের বাড়িও সুন্দরগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামে। নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর খোঁজ নিতে শনিবার তাঁদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পরিবারগুলোর কান্না থামেনি। নিহতরা ছিলেন খেটে খাওয়া মানুষ। রাজনীতির ধারেকাছে নেই। জীবিকার তাগিদে যাচ্ছিলেন ঢাকায়। উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারিয়ে পথে বসেছে পরিবারগুলো। সৈয়দ আলীর দুই মেয়ে, এক ছেলে। একমাত্র সম্বল ভিটে। এর পরও ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছিলেন। বড় মেয়ে দশম শ্রেণি, ছোট মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি ও ছেলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। ইসমত আরা জানালেন, স্বামী দেড়-দুই মাস পর পর বাড়িতে আসতেন। তবে ঢাকা থেকে প্রতি সপ্তাহে বিকাশে টাকা পাঠাতেন। তাই দিয়ে সংসার চলত। অবরোধ-হরতাল শুরুর সপ্তাহ খানেক আগে বাড়িতে এসে আটকা পড়েন। হাতের টাকাও ফুরিয়ে এসেছিল, চাল কেনার টাকাও ছিল না। কয়েক দিন মেটে আলু সেদ্ধ করে খেতে হচ্ছিল। তাই বাধ্য হয়ে পাশের বাড়ি থেকে ৫০০ টাকা ধার করে ৩০০ টাকার টিকিট কেটে, স্ত্রীর হাতে ১৫০ টাকা দিয়ে তিনি ঢাকায় যাচ্ছিলেন। কথা ছিল, ঢাকায় গিয়ে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে টাকা পাঠাবেন। সেই যাওয়াই যে তাঁর শেষ যাওয়া, তা যেন মেনে নিতে পারছেন না তিনি। এখন তিন এতিম ছেলেমেয়ের পড়ালেখা চলবে কেমন করে, আর সংসারইবা কী দিয়ে চলবে, ভেবে কূল পাচ্ছেন না ইসমত আরা। স্বামীর কবরের পাশে মাটিতে হাত চাপড়ে কাঁদছেন আর কাঁদছেন। বৃদ্ধ মজিদা বেগমকে পাওয়া গেল ছেলে সুমন মিয়ার কবরের পাশেই। ২০ বছরের যুবক সুমন রংমিস্ত্রির চাকরি করতেন ঢাকায় গৃহনির্মাণ প্রতিষ্ঠানে। বাড়িতে টিনের ঘরের বদলে ইটের ঘর করতে টাকা পাঠাচ্ছিলেন। সেই ঘর প্রায় জানালা পর্যন্ত উঠেছে। ছেলেকে হারিয়ে মজিদার কথা বলার মতো অবস্থাও নেই। তাঁর আত্মীয়রা জানালেন, ছেলের মৃত্যুর পর তাঁর মাথা ঠিক নেই। সুমনের বাবা শাজাহান মিয়া বাড়িতে ছিলেন না। বাড়িতে মন টেকে না, তাই বাজারের ওদিকেই থাকেন বেশি। জানা গেল, সুমন বাড়িতে এসেছিলেন খালাতো ভাইয়ের বিয়েতে। অবরোধ-হরতালে আটকা পড়েছিলেন। ওদিকে অফিস থেকেও ফেরার তাড়া আসছিল। তাই ঝুঁকি নিয়েই রওনা হয়েছিলেন সেদিন। সুমনের বাড়ি চণ্ডীপুরের পশ্চিমপাড়ায়। আত্মীয়রা জানালেন, সুমনরা তিন ভাই-বোন। বড় ভাই ও বোনের বিয়ে হয়েছে। তাঁরা আলাদা। সুমনই বাবা-মায়ের দেখভাল করতেন। জমিজমা নেই, তাঁর আয়েই সংসার চলত। নতুন ঘর হলে ছেলের বিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি ছিল বাবা-মায়ের। বাড়ির পাশে বাঁশঝাড়ের কিনারে সুমনের কবরের পাশেই এখন দিনের বেশি সময় কাটে মজিদার। এই গ্রামগুলোতে সরকারি কবরস্থান নেই। পরিবারের কেউ মারা গেলে বসতবাড়ির এক পাশে দাফন করা হয়। যাঁদের নিজের জমি নেই, তাঁদের কবর দেওয়া হয় আত্মীয়স্বজনের বাড়ির কবরের পাশে। তেমন আত্মীয় না থাকলে সরকারি খাসজমি বা সড়কের পাশে হয় কবর। কবর দেওয়ার জায়গা না থাকায় ফারাজিপাড়া গ্রামের সোনাভান ও তাঁর ১০ বছরের ছেলে সুজনের কবর হয়েছে আত্মীয়ের বাড়ির উঠানের পাশে। সোনাভানের স্বামী তারা মিয়া ও ছোট মেয়ে তানজিনাও (৫) মারাত্মক দগ্ধ। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে। এই পরিবারটির একটিই টিনের ঘর। এখন সেখানে আছে সোনাভানের কিশোর বয়সী বড় দুই সন্তান তাপসী রাবেয়া ও সুলতান। তাদের কাছে জানা গেল, তারা ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ করে। বাবা-মা কায়িক শ্রমিক। তাঁরাও ঢাকায় কাজ করতেন। বাড়িতে নতুন ঘর তৈরি করেই বাবা-মা ছোট দুই ভাইবোন ও চাচাতো ভাই আশরাফুলকে নিয়ে ঢাকায় ফিরছিলেন। ঘটনাস্থলে মা ও এক ভাই মারা গেছে। বাবা ও বোনের অবস্থাও ভালো নয়। দগ্ধ আশরাফুল চিকিৎসার পর এখন সুস্থ। দুঃসংবাদ পেয়ে তারা ঢাকা থেকে এসেছে। এই শোক-বিপর্যয়ের ধাক্কা সামলে উঠতে পারছে না দুই ভাইবোন। কথা বলতে বলতে কাঁদছিল তারা। বলরাম বর্মণ ১০ বছরের মেয়ে শিল্পীকে এক হাতে বুকে চেপে অন্য হাতে বাসের জানালার কাচ ভেঙে যখন লাফ দিতে যাচ্ছেন, তখন পেছন থেকে কার যেন ধাক্কা লাগে। মেয়ে পড়ে যায়। সে শক্ত করে বাবার লুঙ্গি চেপে ধরেছিল। ফলে লুঙ্গিটি খুলে যায়। এই বর্ণনা দিয়ে বলরাম বলছিলেন, পড়ার পর তাঁর হুঁশ ছিল না। হুঁশ ফিরলে দেখেন বাস জ্বলছে। লোকজনের চিৎকার-চেঁচামেচি। শিল্পী ও তার মায়ের খোঁজ নেই। চণ্ডীপুর পশ্চিমপাড়ার বলরাম জেলে। বছরের প্রায় ছয় মাস তিস্তা নদীতে মাছ ধরেন। নদী শুকিয়ে গেলে মাস ছয়েক তিনি ও স্ত্রী সাধনা বর্মণ মুন্সিগঞ্জে গিয়ে খেতমজুরের কাজ করেন। বড় দুই ছেলেমেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়েটি সুন্দর বলে নাম রেখেছিলেন শিল্পী। কাজের জন্যই তাঁরা মুন্সিগঞ্জের পথে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। বলরাম বলেন, সাধনার হাত, পা ও পিঠের দিকটা পুড়ে যায়। রংপুরে চিকিৎসার পর গত সপ্তাহে তিনি বাড়ি ফিরেছেন। মেয়েটিকে রক্ষা করতে না পারায় বুক ফেটে যাচ্ছে তাঁদের। পশ্চিম সীচা গ্রামের হালিমা বেগম ঢাকায় গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন। তাঁর স্বামী সাহেব উদ্দিন অনেক আগে মারা গেছেন। দুই ছেলেমেয়ের বিয়ে হয়েছে। নাতি সাজু মিয়া ঢাকায় দিনমজুরের কাজ করে, রিকশাও চালায়। তাঁরা জীবিকার তাগিদে যাচ্ছিলেন ঢাকায়। হালিমা ঘটনাস্থলেই ও সাজু রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। নাপু পরিবহনে পেট্রলবোমা হামলার ঘটনায় আরও মারা গেছেন গাইবান্ধা সদরের বারোবলদিয়া গ্রামের দিনমজুর আবুল কালাম আজাদ। তাঁর দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। এই পরিবারটিও পথে বসেছে। নিহতদের পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাহায্য বলতে এ পর্যন্ত তাঁরা লাশ পরিবহন ও দাফনের জন্য জেলা প্রাশাসন থেকে ২০ হাজার টাকা পেয়েছেন। এরপর সহায়তা হিসেবে জেলা প্রশাসন থেকে পরিবারপ্রতি আরও ১০ হাজার টাকা এবং পরে সদর আসনের সাংসদ ও জাতীয় সংসদের হুইপ মাহাবুব আরা বেগম ১০ হাজার টাকা করে দিয়েছেন। ফারাজিপাড়ার তারা মিয়ার পরিবারের দুজন—স্ত্রী ও ছেলে মারা গেলেও পেয়েছেন ১০ হাজার টাকাই। তারা মিয়া রংপুর মেডিকেলে চিকিৎসাধীন। তাঁর দুই সন্তান সুলতান ও তানজিলা জানায়, তাদের পক্ষে সাহায্য আনতে যাওয়ার মতো কেউ ছিল না। সে কারণে শুধু মায়ের নামের সাহায্যের টাকা পেয়েছে। তাদের পরিবারের আরও একজনের মারা যাওয়ার বিষয়টি সাংসদকে জানানো হয়েছে। ওই ঘটনার ৪০ দিন পর শনিবার যখন এই প্রান্তিক মানুষদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন তাঁদের বলার বিষয় ছিল একটিই—কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে সবাই তাঁদের ভুলে গেছেন। কিন্তু তাঁরা ভুলতে পারছেন না সংসারের প্রধান অবলম্বন, প্রিয় মুখটিকে। তাঁরা তো কারও স্বার্থে আঘাত করেননি। হাড়ভাঙা খেটে কষ্টেসৃষ্টে দিন কাটাচ্ছিলেন। কেন কেড়ে নেওয়া হলো তাঁদের প্রাণ?

No comments:

Post a Comment