Monday, March 23, 2015

‘অজ্ঞাত আসামি’ ও ৫৪ ধারার কাছে অসহায় সাধারণ মানুষ:প্রথম অালো

হরতাল-অবরোধ চলাকালে গত ৪ ফেব্রুয়ারি যশোরের শার্শা থানা-পুলিশ শহিদুল ইসলাম ও আবদুল মজিদকে আটক করে। এ দুজনের বিরুদ্ধে মামলা না থাকায় পুলিশ তাঁদের ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে চালান করার উদ্যোগ নেয়। ৫ ফেব্রুয়ারি আদালতে নেওয়ার উদ্দেশ্যে থানা থেকে তাঁদের বের করা হলেও এক দিন পর শহিদুলের লাশ পাওয়া যায় যশোরে। আর পায়ে গুলিবিদ্ধ মজিদকে পরিবারের সদস্যরা খুঁজে পান হাসপাতালে। মজিদের
এক পা কেটে ফেলতে হয়েছে। যশোরে সন্দেহভাজন হিসেবে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটছে। এ ধারায় গ্রেপ্তারের পর জেল খেটে বের হয়েছেন বা জেলে আছেন এমন সংখ্যাও কম নয়। তবে যশোরের সাধারণ মানুষের কাছে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারের চেয়েও কোনো একটি মামলায় ‘অজ্ঞাত আসামি’ স্থানে নাম ঢুকিয়ে দেওয়া অনেক বেশি আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জেলার মানুষের কাছে ‘অজ্ঞাত’ এখন মামলার একটি ধারা বলেই বিবেচিত হচ্ছে। ৫৪ ধারা ও অজ্ঞাত আসামি নিয়ে পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহারের কাছে অসহায় জেলার রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষ। অবরোধ-হরতালের ৭৫ দিনে এই জেলায় মোট নাশকতার মামলা হয়েছে ৩২টি। এসব মামলায় বিএনপি ও জামায়াতের ১ হাজার ২৩৭ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আর প্রতিটি মামলায় রয়েছেন ‘অজ্ঞাত অনেকে’। নাম উল্লেখ থাকা নেতা ও নাম নেই—এমন অনেককেই এসব মামলায় আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এখন কারাগারে আছেন ২৩৪ জন। আবার অনেকেই জামিন পেয়েছেন। জেলার কয়েকটি থানার ভারপ্রাপ্ত ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এ ধরনের গ্রেপ্তারের কথা অস্বীকার করেননি। তবে ‘গ্রেপ্তার-বাণিজ্যের’ বিষয়ে তাঁদের জানা নেই বলে জানিয়েছেন।¯যশোর কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শিকদার আক্কাস আলী প্রথম আলোকে বলেন, যারা বড় ধরনের সন্ত্রাসী নয়, কিন্তু নাশকতা করতে পারে এমন আশঙ্কা আছে, তাদের আটকে রাখার জন্য ৫৪ ধারা ও অজ্ঞাত আসামির স্থানে নাম দিয়ে কারাগারে রাখা হয়। তিনি বলেন, গত ১৫ দিনে তাঁর থানায় এভাবে ২৫ থেকে ৩০ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। যশোর আদালতে গত রোববার ভাইয়ের জামিনের জন্য আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলেন আমিনুর রশিদ। তাঁর ভাই জামিলুর রশিদকে নাশকতার একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এ মামলায় জামিলুরের নাম ছিল না। আমিনুর জানালেন, ‘অজ্ঞাত ধারায় নাম ঢুকিয়ে দিয়েছে।’ তবে যশোরের মানুষ এ-ও স্বীকার করেন যে পুলিশের ব্যাপক অভিযানের কারণে এবার বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের সময় জেলায় অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করেনি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের নির্বাচন পর্যন্ত সময়ের তুলনায় অনেক গুণ ভালো। মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন মুডুলী মোড় এলাকার বাসিন্দা রুমাইসা আক্তার বলেন, সারা জেলায় পুলিশের এ ধরনের কাজ খুব বেশি তা বলা যায় না। কিন্তু বেশ কিছু ক্ষেত্রে নিরীহ মানুষ ভোগান্তির শিকার হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়-আতঙ্ক কাজ করছে। জেলা শহরের আর এন সড়কে হোমিওপ্যাথি কলেজের সামনে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার পর পুলিশ জড়িত সন্দেহে ১০ থেকে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে। এঁরা সবাই জামিনে ছাড়া পান। কিন্তু ছাড়া পাওয়ার পর জেলগেট থেকেই নাশকতার অন্য একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাঁদের আবার কারাগারে পাঠানো হয়। কিন্তু ওই নাশকতার মামলায় এঁরা আসামি ছিলেন না। আইনজীবী ফরিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, যশোরে ৫৪ ধারার ব্যবহার কিছুটা কম। তবে ‘অজ্ঞাত আসামি’ নিয়ে অনেক নিরীহ মানুষ প্রতিনিয়তই হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ৫৪ ধারা ও অজ্ঞাত আসামি নিয়ে পুলিশ মূলত বাণিজ্য করছে। তাঁর মতে, জামায়াত-শিবিরের প্রকৃত অপরাধীদের ধরা হচ্ছে। তবে বিএনপি বলে যাদের ধরা হচ্ছে, তার অধিকাংশই নিরীহ। যশোরের আট উপজেলায় নয়টি থানা রয়েছে। এগুলো হলো সদর, অভয়নগর, বাঘারপাড়া, ঝিকরগাছা, চৌগাছা, মনিরামপুর, কেশবপুর, শার্শা ও বেনাপোল। তবে সদর, অভয়নগর, মনিরামপুর উপজেলায় গ্রেপ্তারের ঘটনা বেশি। হরতাল-অবরোধে সদরে বোমা বিস্ফোরণ ও গাড়ি পোড়ানোর ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া অভয়নগর ও মনিরামপুরেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যশোর শহরের একজন বাসিন্দা জানালেন, তাঁর ছেলেকে অবরোধের শুরুর দিকে রাতে পুলিশ উপশহর এলাকা থেকে আটক করে। এরপর সন্দেহভাজন হিসেবে চালান দেয়। পরে আদালত থেকে সে জামিন পায়। তবে ধরার পর পুলিশ বলেছিল টাকা দিতে হবে। কিন্তু তখন টাকা না থাকায় আদালতে চালান দেওয়া হয়। জেলা পুলিশের কার্যকলাপ নিয়ে আওয়ামী লীগের কোনো অভিযোগ নেই। দলটির জেলা সভাপতি শহিদুল ইসলাম বলেন, যাচাই-বাছাই করেই পুলিশ গ্রেপ্তার করছে। তবে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাবেরুল হক বলেন, মামলায় এমন লোককে আসামি করা হয়েছে, যাঁদের অনেকে এলাকাতেই থাকেন না। এমনকি মামলায় নিরপরাধ ব্যক্তিদেরও জড়ানো হচ্ছে। বিএনপির কর্মীদের ফাঁসিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

No comments:

Post a Comment