Wednesday, March 18, 2015

রং-তুলিতে মুক্তিযোদ্ধার বজ্র-কুসুম রূপ:প্রথম অালো

১৯৭১। মহান মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ছড়িয়ে পড়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে। দেশের ভেতরে দমবন্ধ করা পরিবেশ। নৃশংস পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এ-দেশীয় দোসররা চালাচ্ছে সীমাহীন অত্যাচার আর নির্যাতন। পাখির মতো মরছে মানুষ, ধর্ষিত হচ্ছে নারী, জ্বলছে আগুন, লুট হচ্ছে বাড়িঘর, সম্পদ। রণাঙ্গনে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। পথে পথে দেশত্যাগী মানুষের মিছিল। তারা আশ্রয় নিচ্ছে ভারতের শরণার্থী শিবিরে। বিদে
শের নামীদামি শিল্পীরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়তে কনসার্ট করছেন। অসংখ্য মানুষ হাজির হচ্ছেন সেসব আয়োজনে। সংগৃহীত হচ্ছে তহবিল। পাকিস্তানের আনুগত্য ত্যাগ করে বিদেশের নানা দূতাবাস ছেড়ে বেরিয়ে আসছেন বাঙালি কূটনীতিকেরা। কাজ করছেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। বাঙালির নানা আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় থেকেছে বাংলার শিল্পীসমাজ। মুক্তিযুদ্ধের অগ্নি-তেজে জ্বলছে তাঁদের হৃদয়। মানুষকে অণুপ্রাণিত করতে যে যেভাবে পারেন, কাজ করে চলেছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পরিবেশিত হচ্ছে রক্ত টগবগানো নানা উজ্জীবক সংগীত। এসব গানে সুর করছেন আর কণ্ঠ দিচ্ছেন সমর দাস, সুজেয় শ্যাম, অজিত রায়, আব্দুল জব্বার, রথীন্দ্রনাথ রায়, আপেল মাহমুদের মতো গুণী শিল্পীরা। ওয়াহিদুল হক, সন্জীদা খাতুন, মাহমুদুর রহমান বেনু, শাহীন সামাদ, বিপুল ভট্টাচার্যসহ খ্যাতিমান শিল্পীদের নিয়ে কলকাতায় গড়ে উঠেছে গানের স্কোয়াড। ভারতের বিভিন্ন স্থানে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে গিয়ে গানের অনুষ্ঠান করে যোদ্ধাদের মনোবল চাঙা করছেন তাঁরা, ভারতের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তুলছেন। অনুষ্ঠানের সেট ডিজাইন, ব্যাক সিন তৈরি করছেন শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারের নেতৃত্বে একদল চিত্রশিল্পী। এসব অনুষ্ঠানের ফুটেজ সংগ্রহ করে পরবর্তীকালে ‘মুক্তির গান’ তৈরি করবেন আমাদের গুণী চলচ্চিত্রনির্মাতা প্রয়াত তারেক মাসুদ। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে শিল্পী কামরুল হাসানের নেতৃত্বে একদল শিল্পী মুক্তিযুদ্ধের পোস্টার, কার্টুন, লিফলেট তৈরির কাজে যুক্ত হলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুন্ডু, প্রাণেশ মণ্ডল, নাসির বিশ্বাস ও বীরেন সোম। এই শিল্পীরা আঁকলেন যুগান্তকারী সব পোস্টার, কার্টুন। এর মধ্যে শিল্পী নিতুন কুন্ডু আঁকলেন ‘সদা জাগ্রত বাংলার মুক্তিবাহিনী’ আর শিল্পী প্রাণেশ মণ্ডল ‘বাংলার মায়েরা মেয়েরা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা’। এই দুই পোস্টার হয়ে উঠল আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের অসাধারণ প্রতিকৃতি। মনপ্রাণ-জাগানিয়া মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য শৈল্পিক দলিল সেই যুদ্ধসময়ে তো বটেই, এখনো অনুপ্রাণিত করে দেশের মানুষকে। যুদ্ধকালে যূথবদ্ধ হয়ে যে চিত্রশিল্পীরা কাজ করতেন, তাঁদের দুজন এখনো বেঁচে আছেন—নাসির বিশ্বাস আর বীরেন সোম। রং-তুলিকে হাতিয়ার করে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তাঁরা। শিল্পী নাসির বিশ্বাস সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বললেন, ‘আমরা অনেক পোস্টার করেছিলাম। এর মধ্যে মাত্র ১৫-১৬টি ছাপানো হয়েছিল। এসব পোস্টারের হাজার হাজার প্রিন্ট হয়েছে। মুক্তাঞ্চল, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছাড়াও নানা জায়গায় এ পোস্টার লাগানো হতো। ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে বিদেশেও পাঠানো হতো। এসব পোস্টার দেখে মানুষের মনে আশার সঞ্চার হতো, মানুষ উজ্জীবিত হতো। শুধু পোস্টার নয়, লিফলেট, বুকলেটসহ নানা মাধ্যমে আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রচারকাজ করেছি।’ শিল্পী বীরেন সোম তাঁর সদ্য প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে শিল্পীসমাজ বইয়ে জানাচ্ছেন সে সময়ে তাঁদের যৌথ কর্মপ্রক্রিয়ার কথা, ‘কামরুল হাসান যেকোনো কাজেই একাধিক ডিজাইন করতে বলতেন। আমরা ডিজাইন করে কামরুল ভাইয়ের কাছে জমা দিতাম। তিনি সব ডিজাইন একত্র করে সবাইকে নিয়ে বসে ডিজাইন নির্বাচন করতেন। যেগুলো ভালো হতো সেগুলোকে আবার ডেভেলপ করতে বলতেন। ... কোনো কোনো পোস্টার কয়েকবার ডেভেলপ করার পর চূড়ান্ত হতো। এভাবেই আমরা সবাই মিলে পোস্টারগুলো তৈরি করেছিলাম।’ মুক্তিযোদ্ধার দুটি প্রতিকৃতি—এঁকেছেন দুই শিল্পী। একটিতে নারী মুক্তিযোদ্ধার ছবি, অন্যটিতে পুরুষ। দুটি প্রতিকৃতিতেই যেন বাংলার পলিমাটির পেলব রূপ, অথচ বজ্রমুঠিতে ধরা রাইফেল। চোখেমুখে দৃঢ় প্রত্যয়। চিরন্তন বাঙালি মানসের বজ্র-কুসুম রূপ। এই শিল্পকীর্তি যুগ যুগ ধরে বাঙালির লড়াই, সংগ্রাম আর অগ্রগমনের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।

No comments:

Post a Comment