১৯৯৬ সালের মতো সংবিধান সংশোধন করে নতুন নির্বাচনের পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। গতকাল শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ সংসদ নির্বাচন করার আগে প্রধানমন্ত্রী এটাকে নিয়ম রক্ষা এবং সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার নির্বাচন বলে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি এই নিয়ম রক্ষার নির্বাচনের পর সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের অঙ্গীক
ার করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তাঁর সরকারের সময়ে করা নির্বাচনের উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘১৯৯৬ সালে আমরা নিয়ম রক্ষার নির্বাচন করে সংবিধান সংশোধনের পর পদত্যাগ করে অঙ্গীকার পূরণ করেছিলাম। এখন শেখ হাসিনা যদি তাঁর অঙ্গীকার পূরণ করেন, তাহলেই দেশে শান্তি, স্বস্তি ও সমঝোতার পরিবেশ ফিরে আসবে। মানুষ মুক্তি পাবে।’ বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, তথাকথিত হলেও একটি সংসদের অধিবেশন চলছে। একতরফাভাবে যে বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী তারা পাস করেছে, তা তারা একতরফাভাবে বাতিলও করে দিতে পারে। তাতে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পথ খুলবে। এই সংশোধনীর পর বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা পদত্যাগ করে দ্রুত নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করলেই চলমান সংকটের অবসান ঘটবে। গত ৩ জানুয়ারি থেকে টানা ৬৭ দিন খালেদা জিয়া গুলশানের কার্যালয়ে আছেন। ৫৩ দিন পর গতকাল তিনি দ্বিতীয় দফায় সংবাদ সম্মেলন করলেন। এতে তিনি প্রায় ৪১ মিনিট লিখিত বক্তব্য দেন। তবে, খালেদা জিয়া সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্ন নেননি। সংবাদ সম্মেলন শুরু হয় নির্ধারিত সময় বিকেল চারটার পরিবর্তে পৌনে পাঁচটায়। টানা দুই মাসেরও বেশি অবরোধ-হরতালের মধ্যে খালেদা জিয়ার এ সংবাদ সম্মেলনে কর্মসূচির রদবদল হচ্ছে কি না, তা নিয়ে বেশ কৌতূহল ছিল। খালেদা জিয়া বলেন, ক্ষমতাসীনেরা প্রতিনিয়ত তাঁকে জেল-জুলুম ও ফাঁসির ভয় দেখাচ্ছে। নানাভাবে হেনস্তা করছে। এতে কোনো লাভ হবে না। যৌক্তিক পরিণতিতে না পৌঁছা পর্যন্ত আন্দোলন কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। তিনি আরও বলেন, এই আন্দোলন কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যক্তির বা কোনো দলের বিরুদ্ধে দলের নয়। এই আন্দোলন আদর্শিক এবং মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, ‘শেখ হাসিনার কথা বিশ্বাস করে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর আন্দোলনের কর্মসূচি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল না, তা আমরা অচিরেই বুঝতে পারি। কারণ, আন্দোলন কর্মসূচি স্থগিত করার পর সারা দেশে যৌথ বাহিনীর অভিযানের নামে তারা এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।’ নতুন কিছু নেই, তবু কেন খালেদার সংবাদ সম্মেলন? খালেদা জিয়া দেশবাসীকে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমার আহ্বান, যাঁরা এখনো নিষ্ক্রিয় আছেন, তাঁরা সক্রিয় হোন। নিজ নিজ অবস্থান ও এলাকায় আন্দোলন গড়ে তুলুন।’ জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সাময়িক কষ্ট স্বীকার করার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানান তিনি। বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, বর্তমান সংকটের স্রষ্টা আওয়ামী লীগ এবং সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে শেখ হাসিনা। তাই সংকট সমাধানের চাবিকাঠিও ক্ষমতাসীনদের হাতে। নির্দলীয় সরকারের অধীন দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করলেই কেবল চলমান সংকটের সুরাহা হবে। খালেদা জিয়া বিরাজমান সমস্যার সমাধানে ২০-দলীয় জোটের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট কিছু দাবিও তুলে ধরেন। এগুলো হলো: সারা দেশে গ্রেপ্তার নেতা-কর্মীদের মুক্তি, গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা, পুলিশি ও যৌথ বাহিনীর হয়রানি বন্ধ করা, নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা, বিচারবহির্ভূত সব হত্যার বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করে দায়ীদের শাস্তি দেওয়া। এ ছাড়া সভা-সমাবেশ, মিছিলসহ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সরকারের অধীনে অনতিবিলম্বে জাতীয় সংসদের নির্বাচনের জন্য দ্রুত সংলাপের আয়োজন করা। বর্তমান পরিস্থিতিতে যেসব বন্ধুরাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক সংগঠন, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের সদস্য উদ্বেগ প্রকাশ করে সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কথা বলেছেন, তাঁদের ধন্যবাদ জানান সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, সামনে মহান স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে, জনগণের স্বাধীনতা এবং মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হলে জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই। খালেদা জিয়া বলেন, অনেক বিবাদ-বিসংবাদের পর প্রায় সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছিল, কোনো দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। তারই আলোকে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় পরিলক্ষিত ত্রুটি-বিচ্যুতি মতৈক্যের ভিত্তিতেই সংশোধনের সুযোগ ছিল। ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ (ভুল শোধরানোর জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা)-এর মধ্য দিয়ে যেকোনো পদ্ধতিই সংশোধিত ও পরিশোধিত হতে পারে। আওয়ামী লীগ তা না করে একতরফা সিদ্ধান্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান করে। এতে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোনো সুযোগই রাখা হয়নি। সংকটের মূল উৎস সেখানেই। দীর্ঘ বক্তব্যে খালেদা জিয়া সারা দেশে নেতা-কর্মীদের বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুন, অপহরণ, নির্যাতন, গ্রেপ্তার, মামলা-হামলা ও সাদাপোশাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেআইনিভাবে তুলে নেওয়ার অভিযোগ করেন। তিনি নিহত, আহত ও গুম হওয়া ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বলেন, ‘দিন পরিবর্তন হলে আমরা অবশ্যই আপনাদের পাশে দাঁড়াব।’ আন্দোলন কর্মসূচিতে নাশকতার জন্য ক্ষমতাসীনদের দায়ী করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমরা জনগণের ভোটের অধিকারসহ গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য আন্দোলন করছি। জনগণ আমাদের সঙ্গে আছেন। তাই আমরা তাঁদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে পারি না। সাধারণ মানুষকে বোমা মেরে ও পুড়িয়ে হত্যা এবং এ নিয়ে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে ক্ষমতাসীনেরাই সুবিধা পাবে। কাজেই ক্ষমতাসীনেরা সুবিধা পায়, এমন কোনো অপকর্মে আমাদের কেউ জড়িত থাকার প্রশ্নই ওঠে না।’ বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, দলের যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমদকে গ্রেপ্তার করার পর তিন দিনেও সরকার স্বীকার করেনি। এখন পর্যন্ত তাঁর কোনো হদিস নেই। নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্নার ব্যাপারেও সরকার প্রথম অস্বীকার করে পরে নাটক সাজিয়ে ২১ ঘণ্টা পর তাঁকে গ্রেপ্তার দেখায়। তিনি বলেন, সম্প্রতি ক্ষমতাসীনেরা বিরোধী দলের বক্তব্য-বিবৃতি সংবাদমাধ্যমে প্রচার না করার নির্দেশ দেয়। তার পরও বিএনপি ও ২০ দলের পক্ষে সালাহ উদ্দিন আহমদের দেওয়া বক্তব্য-বিবৃতি প্রচারিত হতে থাকায় তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া দলের নেতাদের মধ্যে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, তরিকুল ইসলাম, রিয়াজ রহমান, রুহুল কবির রিজভী আহমেদসহ দলের গ্রেপ্তারকৃত ও নির্যাতিত নেতাদের নাম উল্লেখ করে তাঁদের মুক্তি ও হয়রানি বন্ধের দাবি করেন। তিনি জানান, গত দুই মাসে দলটির প্রায় ১০ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং কয়েক লাখ কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরীন সুলতানা, প্রেস উইংয়ের দুই সদস্য শামসুদ্দিন দিদার, শায়রুল কবির খান প্রমুখ।
No comments:
Post a Comment