সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারণায় অংশ নিয়ে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা যাতে আচরণবিধি লঙ্ঘন না করেন, সে জন্য নির্বাচন কমিশন থেকে গত ২০ দিনেও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে কোনো চিঠি দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে চট্টগ্রামে তিন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে কমিশন অনাগ্রহী বলে ইঙ্গিত মিলছে। কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, মন্ত্রী পদমর্যাদার ব্যক্তিরা যাতে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ না নেন, সে
জন্য অতীতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও সংসদ সচিবালয়ে এ ধরনের চিঠি দেওয়া হয়েছে, যাকে প্রশাসনিক পরিভাষায় ডিও লেটার হিসেবে বর্ণনা করা হয়। কিন্তু এবার সে ধরনের কোনো চিঠি পাঠানো হয়নি। যে কারণে মন্ত্রীরা আচরণবিধি লঙ্ঘন করে চলেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেনের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী বা সমমর্যাদার ব্যক্তিরা নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেবেন না, নির্বাচন কমিশন থেকে এ ধরনের নির্দেশনা জারি করা হলে আচরণবিধি লঙ্ঘনের প্রবণতা কমে যেত। চট্টগ্রামের রিটার্নিং কর্মকর্তা গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ আনায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। রিটার্নিং কর্মকর্তা মতামত চেয়ে চিঠি পাঠালেও গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত এ-সংক্রান্ত নথি কমিশনে ওঠেনি। অভিযোগ আছে, কমিশন এ বিষয়ে কোনো মতামত না দিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চায় এবং দায়িত্বটি রিটার্নিং কর্মকর্তার ঘাড়ে চাপাতে চায়। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহ নেওয়াজ গতকাল মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেছেন, প্রার্থীরা আচরণবিধি মেনে চলবেন। কেউ আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে রিটার্নিং কর্মকর্তা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন। এ বিষয়ে কমিশন থেকে নির্দেশনা দেওয়ার কিছু নেই। কোনো বিষয়ে আইনের ব্যাখ্যা চাওয়া হলে সেটা কমিশন দেবে। নির্বাচনী আচরণবিধিতে বলা আছে, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী বা তাঁদের সমমর্যাদার সরকারি সুবিধাভোগী কোনো ব্যক্তি, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, চিফ হুইপ ও হুইপরা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন না। বিধিতে আরও বলা আছে, প্রার্থী বা প্রার্থীর পক্ষে কোনো ব্যক্তি আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে তিনি সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ২৯ মার্চ হালিশহরের একটি কমিউনিটি সেন্টারে সন্দ্বীপবাসীর মতবিনিময় সভায় আওয়ামী লীগ-সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আ জ ম নাছিরের উপস্থিতিতে তাঁর পক্ষে ভোট চান মোশাররফ হোসেন। এ ছাড়া ৩১ মার্চ নাছিরের ‘নির্বাচনী কৌশল’ ঠিক করতে স্থানীয় পেনিনসুলা হোটেলে রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়। এতে গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন, ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উপস্থিত ছিলেন। এরপর সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. নাসির উদ্দিন চৌধুরী ও দাপ্তরিক কর্মকর্তা আলাউদ্দীন আল মামুনকে দিয়ে দুটি অভিযোগ তদন্ত করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা আবদুল বাতেন। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সমমর্যাদার ব্যক্তিরা উপস্থিত থেকে নির্বাচনী কর্মকৌশল ঠিক করেন। তবে পেনিনসুলার বৈঠকে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের উপস্থিতির কারণে আচরণবিধি লঙ্ঘন হয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়। তাই এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের পরামর্শ চেয়ে রোববার চিঠি পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনার জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তা আ জ ম নাছিরকে সতর্ক করেছেন। কমিশন সচিবালয়ের আইন শাখা সূত্র জানায়, অভিযোগ-সংক্রান্ত চিঠিটি কমিশনে উত্থাপনের জন্য সোমবার তা নথিভুক্ত করা হলেও গতকাল পর্যন্ত তা কমিশনের টেবিলে উত্থাপন করা হয়নি। কমিশনের কিছু নির্বাচনী কর্মকর্তা জানান, পেনিনসুলা হোটেলের বৈঠকটি প্রমাণযোগ্য নয়। তবে হালিশহরে সভায় গণপূর্তমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, তা আমলযোগ্য। কমিশন সচিবালয় সূত্র জানায়, নথি উত্থাপনের আগেই কমিশনারদের কেউ কেউ মৌখিকভাবে এ বিষয়ে মতামত তুলে ধরেছেন। তাঁরা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে কোনো ধরনের নির্দেশনা দিতে চান না। যে কারণে এ-সংক্রান্ত নথিটির চলার গতি মন্থর হয়ে গেছে। কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, মন্ত্রী বলেই কমিশন এ বিষয়ে কোনো মতামত না দিয়ে তা রিটার্নিং কর্মকর্তার ওপর চাপাতে চায়। কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের কেউ কেউ মনে করেন, রিটার্নিং কর্মকর্তা ইচ্ছে করলে কমিশনের মতামত না নিয়েই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কিন্তু দায়িত্বটি তিনি নিজে না নিয়ে কমিশনে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ২০১০ সালের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে রিটার্নিং কর্মকর্তা জেসমিন টুলি কমিশনের মতামত না নিয়েই তৎকালীন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তবে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, রিটার্নিং কর্মকর্তা যা করেছেন, তা সঠিক। কারণ, একজন রিটার্নিং কর্মকর্তা উপসচিব পদমর্যাদার। তিনি সরকারের একজন মন্ত্রীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলে বা তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে তা শোভনীয় হবে না। সে জন্য এসব ক্ষেত্রে কমিশনের পরামর্শ চাওয়া বাঞ্ছনীয় এবং মন্ত্রীদের সতর্ক করার দায়িত্বটিও কমিশনের নেওয়া উচিত। ভারতেও এ ধরনের রেওয়াজ প্রচলিত আছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রিটার্নিং কর্মকর্তা আবদুল বাতেন কোনো মন্তব্য করেননি।
No comments:
Post a Comment