Monday, April 6, 2015

গার্মেন্ট শিল্পে নীরব বিপ্লব:যুগান্তর

কেরানীগঞ্জে গার্মেন্ট শিল্পে নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে। দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রায় ৭৫-৮০ ভাগ পোশাকই যায় কেরানীগঞ্জের গার্মেন্ট পল্লী থেকে। সকাল থেকে রাত অবধি এ গার্মেন্ট পল্লীর পাইকারি দরের পণ্য যাচ্ছে সারা দেশে। ব্যবসায়ীদের কাছে এটি সুলভ মূল্যের রেডিমেট কাপড়ের এক স্বর্গরাজ্য। জিন্সপ্যান্ট, শার্ট, টি-শার্ট, গেঞ্জি, থ্রিপিস, পাঞ্জাবি, বাচ্চাদের পোশাক, আন্ডারগার্মেন্টসহ নানা ধরনের পোশাক তৈরি হয় কেরান
ীগঞ্জের হাজার হাজার কারখানায়। তবে এখানে শার্ট ও জিন্স প্যান্টের কারখানার সংখ্যা বেশি। সংশ্লিষ্টদের মতে, গার্মেন্ট শিল্পে কেরানীগঞ্জই এখন শ্রেষ্ঠ। তারা মনে করেন, এত সুলভ মূল্যের পোশাক দেশের আর কোথাও পাওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য বছরজুড়ে কেরানীগঞ্জে তৈরি পোশাকের চাহিদা থাকে। আর ঈদ, শীত মৌসুমসহ বিভিন্ন জাতীয় উৎসবে চাহিদা বেড়ে যায় দ্বিগুণ। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে কালীগঞ্জের এ পোশাক পল্লী। এটি কেরানীগঞ্জ উপজেলার আগানগর ইউনিয়নের একটি বাণিজ্যিক অঞ্চল। সদরঘাটের নদীবন্দরের ঠিক বিপরীতে এর অবস্থান। সদরঘাট থেকে নৌকায় চড়ে কিংবা বাবুবাজার ব্রিজ পার হয়ে হাতের বাম দিকে গেলেই মিলবে কালীগঞ্জের পোশাক পল্লী। এ অঞ্চলের প্রতিটি ঘর যেন এক একটি কারখানা। বিভিন্ন মার্কেটের নিচে বিক্রয় কেন্দ্র, আর উপরে গড়ে উঠেছে পোশাকের কারখানা। এছাড়া রয়েছে ছোট ছোট টিনের ঘর। এ যেন উন্নত বস্ত্র শিল্পের সাফল্যে ঘেরা নতুন এক বাংলাদেশের চিত্র। শেরপুর জেলা থেকে আগত পাইকারি ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান খান যুগান্তরকে বলেন, ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকারি দরে পণ্য কিনে স্থানীয় মিতু গার্মেন্টে তিনি বিক্রি করেন। রাজধানীর অন্যান্য মার্কেটের তুলনায় কেরানীগঞ্জের গার্মেন্ট পণ্যের দিকে তার আর্কষণ বেশি। কেন না তার মতে, এখানে সুলভ মূল্যে মানসম্পন্ন যেসব পণ্য পাওয়া যায় তা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। বিশেষ করে জিন্স প্যান্ট, শার্ট, টি-শার্ট, গেঞ্জি, ফতুয়া, বাচ্চাদের পোশাক, পাঞ্জাবি অতুলনীয়। একদিকে কম দাম, অন্যদিকে প্রচুর দোকান থাকায় পছন্দমতো যাচাই-বাছাই করে মালামাল কেনা যায়। এ জন্য সারা বছরই তিনি এখান থেকে পণ্য কিনে থাকেন। এর ফলে ব্যবসার প্রসার বাড়াতেও সক্ষম হয়েছেন বলে তিনি জানান। জানা গেছে, স্বল্পমূল্য ও মানের দিক থেকে উন্নত হওয়ায় দেশের অধিকাংশ অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা কেরানীগঞ্জ থেকে তৈরি পোশাক কিনে নেন। ফরিদপুর তিতুমীর বাজার থেকে আসা তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, তারা কেরানীগঞ্জ থেকে তৈরি পোশাক কিনে বিক্রি করেন। কারণ এখানে স্বল্প আয়ের মানুষ থেকে শুরু করে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের চাহিদা অনুযায়ী পোশাক পাওয়া যায়। কেরানীগঞ্জ গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুল আজিজ শেখ যুগান্তরকে বলেন, প্রতিদিন এখানে পাইকারি ক্রেতাদের ভিড় লেগে থাকে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ৩-৪ হাজার পাইকারি ব্যবসায়ীর সরগরম পরিবেশ এখানকার নিত্য ঘটনা। এখানে ছোট-বড় মিলিয়ে ৭ থেকে ৮ হাজার শো রুম রয়েছে। আর এসব শো রুমে পোশাক সরবরাহের জন্য কারখানা রয়েছে প্রায় ৪ হাজার। এসব কারখানায় প্রায় আড়াই লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। পরোক্ষভাবে কারখানা মালিক, শ্রমিক ও ক্রেতা-বিক্রেতার সংখ্যা হিসাব করলে তা কোটি মানুষের সঙ্গে সেতুবন্ধন তৈরি করেছে। দিন দিন এর ব্যাপ্তি ও পোশাকের চাহিদাও বাড়ছে। তিনি বলেন, এখানকার লেনদেনও কম নয়। প্রতিদিন গড়ে ৩ কোটি টাকার লেনদেন হলেও মৌসুমে ৭ কোটি টাকা পার হয়ে যায়। এ ব্যবসায়ী নেতা আরও জানান, সম্প্রতি রাজনৈতিক অস্থিরতায় কেরানীগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ অবস্থায় ব্যাংকের সুদের হার মওকুফসহ ব্যবসায়ীদের ঋণের আওতা ও সুবিধা আরও বাড়াতে হবে। নতুবা যে ক্ষতি হয়েছে তাতে কিছু ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন। এতে করে মূলত দেশেরই ক্ষতি হবে বলে মনে করেন তিনি। জানা গেছে, এক সময় কেরানীগঞ্জের পূর্ব আগানগর, কালীগঞ্জ, খেজুরবাগ এলাকায় তৈরি পোশাকের কারখানা বেশি ছিল। তবে দিন দিন চাহিদা বাড়ায় কেরানীগঞ্জের চর কালীগঞ্জ, কালীগঞ্জ বাজার, চৌধুরী নগর, ইস্পাহানী এলাকাসহ কম-বেশি সব এলাকাতেই কারখানা ছড়িয়ে পড়েছে। এছাড়া সারা দেশে শার্ট ও পাঞ্জাবির রয়েছে ব্যাপক খ্যাতি। তাই এসব পণ্যের কারখানারও কমতি নেই এখানে। কারখানাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখা যায়, যেন রাতদিন এক করে কাজ কারছেন এখানকার শ্রমিকরা। অথচ শ্রমিক অসন্তোষের কথা খুব একটা শোনা যায় না। গার্মেন্ট শিল্পের শ্রমিকদের ন্যায্যমজুরি ও বেতন-ভাতা নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে অশান্তি বিরাজ করলেও এখানে তার বিপরীত চিত্র। কেরানীগঞ্জে বেতনভাতা, ওভারটাইম আর বোনাস নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে কোনোরকম অসন্তোষ নেই বললেই চলে। কালীগঞ্জের সর্দার ম্যানশন মার্কেটে অবস্থিত তকী গার্মেন্টের মালিক মনিরুল ইসলাম বলেন, এখানে শার্ট তৈরি করে বিক্রি করি। পাইকাররা সারা বছরই শার্ট কিনে থাকেন। তিনি জানান, শ্রমিকদের ন্যায্যমজুরি যেমন দেয়া হয় তেমনি একই সঙ্গে বিভিন্ন ভাতা ও বোনাস পান শ্রমিকরা। ফলে তাদের মধ্যে আন্দোলন বা বিক্ষোভ করার চিন্তাও আসে না। তিনি বলেন, কম মূল্যে এসব শার্ট সরবরাহ করা হয় বলে চাহিদাও বেশি। তবে ঈদ ও শীতের মৌসুমে বিক্রি আরও বেড়ে যায়। এ প্রসঙ্গে আলম শপিং প্লাজার সুমাইয়া গার্মেন্টের ম্যানেজার নূর হোসেন যুগান্তরকে বলেন, সারা দেশের পাইকারি ব্যবসায়ীরা তাদের কাছ থেকে পোশাক সংগ্রহ করেন। আর সুলভ মূল্যের কারণে দোকানদাররাও সহজে ক্রেতা আকর্ষণ করতে পারছেন। ঈদ ও জাতীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে জমজমাট হয়ে উঠে এখানকার পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। স্থানীয় গার্মেন্ট শ্রমিক আজাদ বলেন, ‘এখানে আমরা মালিক-শ্রমিক এক সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করি। এমন অনেক মালিক রয়েছেন যারা শ্রমিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে এখন সফল ব্যবসায়ীর খাতায় নাম লেখাতে সক্ষম হয়েছেন। এ জন্য তারা শ্রমিকের কষ্টটাও বুঝতে পারেন।’  

No comments:

Post a Comment