Sunday, May 3, 2015

ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে সাংবাদিকতা:প্রথম অালো

সরকার গণমাধ্যম সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখার কথা বললেও দেশে এ মাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হওয়ার ঘটনা বাড়ছে। দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে সাংবাদিকতা পেশা। দেশি-বিদেশি কয়েকটি সংস্থার গত পাঁচ বছরের প্রকাশিত প্রতিবেদন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর ও সাংবাদিক আক্রান্ত হওয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে এই চিত্র পাওয়া গেছে। গণমাধ্যম অস্বস্তিকর অবস্থায় থাকার এই প্রেক্ষাপটে আজ ৩ মে ‘বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস’ পা
লিত হচ্ছে। ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দিবসটি ঘোষণা করা হয়। দিবসটি সামনে এলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও পেশাগত দায়িত্ব পালনে নিরাপদ পরিবেশের কথা সামনে চলে আসে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘সাংবাদিকতা প্রসারিত হোক’। গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিকূল পরিবেশেও দেশে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ও অনলাইন নিউজ পোর্টালের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যদিও সরকার-সমর্থক ব্যবসায়ী বা সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরাই বেশির ভাগ চ্যানেল পেয়েছেন। আর অনলাইন পোর্টাল কুটিরশিল্পে রূপ নিয়েছে, এর সংখ্যা সরকারেরও জানা নেই। এ প্রসঙ্গে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু প্রথম আলোকে বলেন, সহস্রাধিক দৈনিক পত্রিকার প্রকাশনা, সরকারি তিনটি টেলিভিশনের পাশাপাশি ২৫টি বেসরকারি চ্যানেল এবং বেতারের পাশাপাশি ১৫টি বেসরকারি এফএম রেডিও সম্প্রচারের ব্যবস্থা করেই সরকার ক্ষান্ত হয়নি। তৃণমূল ও উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর হিসেবে ১৭টি কমিউনিটি রেডিও রয়েছে। জনসংযোগ বিভাগের মাধ্যমে দেওয়া লিখিত বক্তব্যে মন্ত্রী আরও জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা ও তথ্যের অবাধ প্রবাহে বিশ্বাসী। তবে বিভিন্ন সংস্থার সমীক্ষা এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কথা সরকারিভাবে বলা হলেও দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কখনো পুলিশ, কখনো সরকারি দলের কর্মীদের হামলার শিকার হচ্ছেন সাংবাদিকেরা। সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কঠোর সমালোচনা ও প্রচ্ছন্ন হুমকির ঘটনায় গণমাধ্যমে স্বনিয়ন্ত্রণ (সেলফ সেন্সরশিপ) আরোপের ঘটনাও বাড়ছে। বিএনপি-জামায়াত জোট আমলেও জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, বোমা হামলা ও দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে গিয়ে সাংবাদিকেরা নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও পুলিশ ও নিরাপত্তাকর্মীদের আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্য ছিল গণমাধ্যম। সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত পেশাগত কারণে ২৬ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। কিন্তু একমাত্র সমকাল পত্রিকার ফরিদপুর ব্যুরোপ্রধান গৌতম দাস হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকায় ঘটনার প্রায় সাড়ে সাত বছর পর ২০১৩ সালের ২৬ জুন নয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিজমের (আইএফজে) এশিয়া প্যাসিফিক শাখার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, বিচারহীনতা, সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনাগুলো বাংলাদেশে গণমাধ্যমে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আইএফজে বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশে গত এক বছরে সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের তথ্যগুলো সংগ্রহ করেছে, যা আজ ৩ মে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রকাশ করা হবে। এতে দুজন সাংবাদিক হত্যা এবং কমপক্ষে ১৬ জন সাংবাদিকের ওপর হামলার তথ্য থাকছে। সদ্য অনুষ্ঠিত তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গণমাধ্যমকর্মীদের ভয়ভীতি দেখানো, কাজে বাধা দেওয়া, হামলা চালিয়ে লাঞ্ছিত করার ঘটনা নিকট অতীতে দেখা যায়নি। ওই দিন ভোট জালিয়াতির তথ্য ও চিত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে কমপক্ষে ২৫ জন গণমাধ্যমকর্মী নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছেন। নির্বাচনের দিন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সচিত্র ও সরাসরি প্রতিবেদন দেখানোর ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সতর্ক ছিল। কারও কারও ক্ষেত্রে বাইরের চাপ আবার কারও ক্ষেত্রে ভয় কাজ করেছে বলে কথা বলে জানা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সুপার নিউমারারি অধ্যাপক সাখাওয়াত আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘একধরনের বিশেষ রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। তার পরও বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনীয় দেশগুলোর মধ্যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে আমরা মাঝারি পর্যায়ে আছি। কারও কারও তুলনায় কিছুটা ভালো আছি।’ ড. সাখাওয়াত বলেন, দেশে ‘মিডিয়া ফ্রেন্ডলি’ অনেক শক্তি আছে। সাংবাদিকদের মধ্যে বিভেদ ও বিভাজন এতটাই বেশি যে সেই শক্তিগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আবার সাংবাদিকতা ছাড়াও অনেকে নানা উদ্দেশ্যে এ পেশায় ঢুকে পড়েছেন, এটাও গণমাধ্যমের জন্য ক্ষতিকর। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, প্রথম আলোর বাউফল প্রতিনিধি মিজানুর রহমান প্রভাবশালীর ইঙ্গিতে পুলিশের রোষানলে পড়ে মিথ্যা মামলায় জেল খাটছেন, তিনি জামিন পাচ্ছেন না। গত মার্চে ফেনী থেকে প্রকাশিত নিউজ পোর্টাল নতুন ফেনীর সম্পাদক রাশেদুল হাসানকে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দিয়েছে সন্ত্রাসীরা। সাম্প্রতিক সময়ে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনামকে গ্রেপ্তারের হুমকি দেওয়া হয়েছে। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান লড়ছেন বেশ কিছু মামলায়। সম্প্রতি আরও পাঁচটি মামলা দেওয়া হয়েছে ঢাকা, ঝালকাঠি, ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম ও বরিশালে। যুগান্তর-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলমের বিরুদ্ধে ডজন খানেক মামলা আছে বলে তিনি জানিয়েছেন। রাজশাহীতে তিনজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে পুলিশের নাশকতার মামলা ও পরে চাপের মুখে তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। ঢাকা, জগন্নাথ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হাতে সাংবাদিক নিগৃহীত হওয়া, নিউ এজ পত্রিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতাকে পুলিশি নির্যাতন, ফেনী ও চুয়াডাঙ্গায় সাংবাদিকদের পিটিয়ে গুরুতর জখম করার মতো সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো এই পেশা সংশ্লিষ্টদের ক্ষুব্ধ করে তুলছে। সরকারবিরোধী বলে পরিচিত পত্রিকা আমার দেশ এবং দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি বন্ধ হওয়ার পর থেকে ভিন্নমতের গণমাধ্যম সেই অর্থে নেই। বিভিন্ন অভিযোগে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, এনটিভির চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক আলী ফালু, একুশে টিভির চেয়ারম্যান আবদুস সালাম, সাংবাদিক কনক সরওয়ার জেলে আছেন। বিএনপিপন্থী সাংবাদিকদের সংগঠন বিএফইউজের সভাপতি শওকত মাহমুদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ২০১০ সালে সন্ত্রাসী ও দুর্বৃত্তদের হাতে চারজন খুন ও দুজন অপহরণসহ ৩০১ জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদে সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন কয়েকজন মন্ত্রী ও সাংসদ। গণমাধ্যম উন্নয়ন সংস্থা ম্যাস-লাইন মিডিয়া সেন্টারের (এমএমসি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১২ সালে ২১২টি ঘটনায় ৫১২ জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে সাগর-রুনি দম্পতিসহ খুন হয়েছেন পাঁচ সাংবাদিক। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউসের ২০১৩ সালের সমীক্ষায় বলা হয়, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিচারে বিশ্বের ১৯৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৫। এর আগে ওই প্রতিষ্ঠানের হিসাবে ২০১২ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১২। জাতিসংঘ ২০১২ সালকে বিশ্বে সাংবাদিকদের জন্য ‘ভয়ংকর বছর’ বলে অভিহিত করেছিল। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা প্যারিসভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স প্রকাশিত ২০১৫ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৬। সূচকে বাংলাদেশের অবনতির কথা উল্লেখ করে বলা হয়, এর আগে ২০১৩ সালে ১৭৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৪। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১৪ সালে দুজন সাংবাদিক খুন হয়েছেন, ২৩৯ জন সংবাদকর্মী বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন৷ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান গণমাধ্যমের ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাংশ কর্তৃক সাংবাদিক নির্যাতন ও গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তা ঝুঁকির পরিপ্রেক্ষিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, সাংবাদিক নির্যাতনের সাম্প্রতিক ঘটনা সংবিধান স্বীকৃত স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার খর্ব করেছে, যা কোনো সুশাসিত গণতান্ত্রিক দেশে কাম্য নয়। বৈষম্যমূলকভাবে কোনো কোনো সাংবাদিককে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রবেশে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আরোপেরও নিন্দা জানান তিনি। ইফতেখারুজ্জামান এক বিবৃতিতে বলেন, সরকার তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ এবং জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১ প্রণয়ন করেছে। কিন্তু তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধন) আইন, ২০১৩ এর ৫৭ ধারা সংশোধন এবং জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালায় বেশ কিছু ধারা সংযোজন করে গণমাধ্যম এবং ব্যক্তির স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করার ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। এদিকে তথ্য অধিকার আইন তথ্য পাওয়ার অধিকার যেমন নিশ্চিত করেছে, তেমনি সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের প্রামাণিক দলিল আদালতে হাজির করার একধরনের নির্দেশনার মুখোমুখিও হতে হচ্ছে গণমাধ্যমকে। তবে সংকট সমাধানের চেয়ে গণমাধ্যমের সম্প্রসারণই সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই সম্প্রসারণকে ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দিয়ে তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে সরকার প্রণয়ন করেছে তথ্য অধিকার আইন।

No comments:

Post a Comment