রমজানে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মজুদ সীমিত। এই সীমিত পণ্যের মজুদ নিয়েই রমজানের চাহিদা মোকাবেলায় নামছে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের অন্যতম প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান টিসিবি রমজানকে কেন্দ্র করে বাফার মজুদ গড়ে তুলতে পারেনি। সংশ্লিষ্টদের আশংকা টিসিবির সীমিত মজুদের সুযোগ ও রমজানকেন্দ্রিক বাড়তি চাহিদাকে কেন্দ্র করে এবারের রমজানে অস্থির করে তুলতে পারে নিত্যপণ্যের বাজার। যা
দেশের দরিদ্র ও নিুবিত্ত মানুষের জন্য শাপে বর হতে পারে। এ মুহূর্তে টিসিবির সংরক্ষিত গুদামে মাত্র ১ হাজার ৫২৮ টন ছোলা, ১ হাজার ৯০০ টন চিনি, ভোজ্যতেল সাড়ে চার হাজার টন, ৯০০ টন ডাল ও ১৫০ টন খেজুর রয়েছে। সারা বছর এ প্রতিষ্ঠানের তেমন তৎপরতা না থাকলেও আসছে রমজানকে কেন্দ্র করে এই সীমিত মজুদই দরিদ্র্য ও নিুবিত্ত মানুষের জন্য শবে বরাতের পরদিন থেকে ট্রাক-সেল ও খোলা বাজারের মাধ্যমে বিক্রি করা হবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর যুগান্তরকে বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে টিসিবি ক্রমশই গুরুত্ব হারাতে বসেছে। বিদ্যমান বাজার ব্যবস্থা এখন অনেক বড়। এই বাজার চাহিদায় সীমিত মজুদ দিয়ে কিছুই হবে না। আর টিসিবির কার্যক্রম এখন নামমাত্রই বলা যায়। একে দিয়ে ভবিষ্যতেও ভরসা করে লাভ হবে না। থাকলেই বরং সরকারের অর্থের অপচয় হয়। তিনি দাবি করেন, হয়তো টিসিবির মজুদ কম। কিন্তু দেশে উৎপাদন ও আমদানি কম হচ্ছে না। সরকারকে এ তথ্যটি ফলাও করে প্রচার করতে হবে। বাজার ব্যবস্থায় এসব তথ্য ঢেকে রাখা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এর মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ নেয় অথবা সুযোগ করে দেয়। তিনি বলেন, সরকারে যেই থাকুক সবাই চায় পণ্যমূল্য, মজুদ ও সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে। সে ক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থায় উৎপাদন ও আমদানির মাধ্যমে মজুদ নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত এবং এসব তথ্য জনসম্মুখে উন্মুক্ত রাখা দরকার। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তরা সে কাজটি সময়মতো পালন করে না বলেই বাজার ব্যবস্থায় বিশৃংখলা দেখা দেয়। পণ্যমূল্য অস্থিতিশীল হয়। কৃত্রিম সংকট তৈরির সাহস পায়। তিনি দাবি করেন, পণ্যের বাফার মজুদ থাকলেও কোনো লাভ হবে না, যদি এ তথ্য বাজার ব্যবস্থায় উন্মুক্ত করা না হয়। এদিকে বাজার পরিস্থিতির প্রকৃত চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থার বাস্তবতা নিয়ে অনেকটাই ঘুমিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পবিত্র রমজান আর মাসখানেক দূরে থাকলেও আন্তঃমন্ত্রণালয়কেন্দ্রিক দু-একটি নিয়মিত সভা ছাড়া রমজানকেন্দ্রিক গুচ্ছ ও সাঁড়াশি কার্যক্রম এখনও নেয়নি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের বাজারকেন্দ্রিক কার্যক্রম ওয়েবসাইট পর্যালোচনা করে নিত্যপ্রয়োজনীয় ১১টি পণ্যের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারদরের একটি তালিকা তৈরির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। তাই দায়িত্বশীল অনেক কর্মকর্তাই বলতে পারেন না রমজানকেন্দ্রিক ব্যবহার্য কোন পণ্যের কেমন চাহিদা রয়েছে। এর মজুদই বা কেমন থাকা দরকার, যার সরবরাহ ব্যবস্থা বাড়ানোর মাধ্যমে পণ্যমূল্য স্থিতিশীলতায় সহায়ক হতে পারে। শুধু তাই নয়, এ ব্যাপারে কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মজুদ ও উৎপাদন ব্যবস্থা, বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ এলসি ও কাস্টমসের মাধ্যমে বন্দর থেকে পণ্য খালাসের প্রকৃত পরিমাণও নেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। এতকিছুর পরও মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তাদের অনেকটা আত্মতুষ্টিতেই কাটছে দৈনিন্দিন দাফতরিক কর্মকাণ্ড। তাদের দাবি, ‘দেশে পণ্যের সংকট নেই। দাম স্থিতিশীল আছে। মনিটরিং সেল কাজ করছে।’ অপরদিকে টিসিবির দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে কাগজে-কলমে। বছরের বেশিরভাগ সময়ই এর কার্যক্রম থাকে না। আবার যখন শুরু হয়, কয়েক হাজার ডিলারের মধ্য থেকে টিসিবি পণ্য নিচ্ছে মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন। সেখানেও পণ্যের দাম নির্ধারণ ও বিক্রি নিয়ে আছে নানা মতবিরোধ ও অনীহা। এর নেপথ্য কারণ হিসেবে জানা যায়, বাফার মজুদ গড়ে তোলার জন্য টিসিবির অনুকূলে প্রয়োজনীয় অর্থ কখনোই বরাদ্দ রাখা হয় না। যে পরিমাণ পণ্য টিসিবি আমদানি করে থাকে তা ব্যয় বাবদ অর্থ, অর্থ মন্ত্রণালয়কে কাউন্টার গ্যারান্টি দেখিয়ে ঋণ নিতে হয়। সেটিরও সর্বোচ্চ আওতা মাত্র ৮০০ কোটি টাকা। আবার এ পরিমাণ ঋণের অর্থও প্রচলিত সুদ ব্যবস্থায় পরিশোধ করতে হয়। যে কারণে সংস্থাটি পণ্য সরবরাহ দিলেও তাতে বাজারদরের সঙ্গে খুব একটা তফাৎ তৈরি করতে পারে না। পণ্যের মান নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার সারোয়ার জাহান তালুকদারের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে যুগান্তরকে তিনি এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে জানান, সক্ষমতার মধ্যে টিসিবির কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিশেষ করে রমমজানকেন্দ্রিক পণ্যের বাফার স্টক গড়তে তাদের নভেম্বর থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে ইতিমধ্যে ছোলা ও খেজুরের আমদানি প্রক্রিয়া শেষে এখন পণ্য মজুদ রয়েছে। সীমিত আকারের হলেও তেল, চিনি ও মসুর ডাল সারা বছর ধরেই টিসিবির কার্যক্রমের আওতায় রয়েছে। এসব তেল ও মসুর ডাল ডিলারের চাহিদা অনুযায়ী আগেই আমদানি করা আছে। আর আগে চিনি আমদানি করা হলেও এখন প্রয়োজনীয় চিনি অভ্যন্তরীণ উৎস্য বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের সঙ্গে ‘এমওইউ’ ভিত্তিতে চাহিদা পূরণের কাজ করে যাচ্ছে। এ চুক্তির আওতায় যখন যেকোনো পরিমাণ চিনির চাহিদাপত্র দেয়ামাত্র তারা টিসিবিকে সরবরাহ দিচ্ছে। জানা গেছে, রমজানকেন্দ্রিক টিসিবির কার্যক্রমের আওতায় সারা দেশে ১৭৪টি স্থানে ট্রাক-সেল দেয়া হবে। এর মধ্যে ঢাকায় থাকবে ২৫টি, চট্টগ্রামে ১০টি, অন্যান্য বিভাগীয় শহরে ৫ ও জেলা শহরে ২টি করে ট্রাক-সেল কার্যক্রম চালানো হবে। এ ছাড়া রমজানের প্রথম সপ্তায় দ্বিতীয় কিস্তি ও মাঝামাঝিতে তৃতীয় কিস্তি ছাড় করা হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য (আইআইটি) নাজনীন বেগম যুগান্তরকে বলেন, পণ্যের সীমিত মজুদ কথাটি ঠিক নয়। বাজার নিয়ন্ত্রণে টিসিবির মেকানিজমে যে পরিমাণ মজুদ থাকা প্রয়োজন, তাই রয়েছে। এটি চলমান প্রক্রিয়া। তিনি দাবি করেন, টিসিবি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না এ কথাটিও ঠিক নয়। বিদ্যমান বাজার ব্যবস্থায় দ্রব্যমূল্য যেটুকুই স্থিতিশীল থাকে কিংবা অস্থিতিশীল অবস্থা থেকে স্বাভাবিকতায় ফিরিয়ে আনতে টিসিবিই মুখ্য ভূমিকা রাখছে।
No comments:
Post a Comment