Tuesday, May 26, 2015

বিচার পায় না লাঞ্ছিত নারী:প্রথম অালো

গত ১৪ বছরে ধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের ঘটনায় ঢাকায় সরকার পরিচালিত ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) এসেছেন ৫ হাজার ৩২১ জন নারী। সাজা হয়েছে ৪৩ জনের। নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। বিচার না পেয়ে আত্মঘাতী হচ্ছেন কেউ কেউ। কেউ একঘরে হওয়ার ভয়ে আপস-মীমাংসা করে ফেলছেন। ঘটনার শিকার নারী ও তাঁদের স্বজন, আইনজীবী এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, ধর্ষকেরা সাধারণত সমা
জের প্রভাবশালী অংশ থেকে আসা। নির্যাতনের শিকার নারী বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সুবিচার পান না বা না পাওয়ার আশঙ্কা থেকে আইনের আশ্রয় নিতে চান না। দেশের প্রতিনিধিত্বশীল দুটি মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি ও ব্র্যাকের হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস বলছে, গত এক বছরে যেসব ধর্ষণের মামলা হয়েছে, তার একটিরও নিষ্পত্তি হয়নি। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের আওতায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল শের-ই-বাংলা, খুলনা, সিলেট এম এ জি ওসমানী, রংপুর ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২২ হাজার ৩৮৬ জন ধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের ঘটনায় চিকিৎসা নিতে আসেন। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে পাঁচ হাজার তিনটি। রায় ঘোষণা হয়েছে ৮২০টি, শাস্তি হয়েছে ১০১ জনের। শতকরা হিসাবে রায় ঘোষণার হার ৩ দশমিক ৬৬ এবং সাজা পাওয়ার হার দশমিক ৪৫ শতাংশ। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অগ্রযাত্রা সত্ত্বেও কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটছে জানতে চাইলে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত ৫০-৬০ বছরে নারীর অগ্রগতি আমাদের দেশে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সামাজিক ঘটনা। কিন্তু কিছু মানুষ এই অগ্রগতি রুদ্ধ করে নারীকে গৃহকোণে আবদ্ধ করতে চায় এবং নারীকে ভোগ্যবস্তুর চাইতে বড় কোনো মূল্য দিতে পারে না। তারাই এসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটায়। আমাদের সম্মিলিতভাবে এদের প্রতিরোধ করতে হবে।’ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেছেন, আইনের সুষ্ঠু ও সময়োচিত প্রয়োগ দরকার। একজন নারী হয়তো সাহস নিয়ে একটা মামলা শুরু করলেন, অপর পক্ষ থেকে এই বলে চাপ দেওয়া হয় যে আপস করে ফেললে কিছু টাকা পাওয়া যাবে। ধর্ষকের শাস্তি হবে, ধর্ষণের শিকার নারীর তাতে কী লাভ হবে? আইন সক্রিয়ভাবে চলে না। তাকে চালাতে হয়। যাঁরা চালান, তাঁদের অনেকে নারীবিদ্বেষী, নারীর স্বাধীনতাকে অশ্রদ্ধা করেন। পুলিশের ওপর প্রচুর কাজের চাপ। অন্যান্য কাজের পর যখন এ ধরনের অভিযোগ আসে, তখন তাঁদের অনেকেই এটাকে ‘ঝামেলা’ বলে মনে করেন। ধর্ষণের শিকার নারীরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর, ধর্ষকেরা প্রভাবশালী। রাজবাড়ীর পাংশায় এ বছরের ১২ জানুয়ারি সরিষা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সোহরাব হোসেনের ছোট ভাই সাফিন হোসেনসহ চারজনের বিরুদ্ধে আদিবাসী মা ও মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এলাকাবাসীর সহযোগিতায় থানায় মামলা হলে ধর্ষকেরা পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয় বলে জানান ঘটনার শিকার নারী। গতকাল রোববার পর্যন্ত ওই ঘটনায় সবাইকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। ১৬ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কালিয়াকৈরের ভান্নারা এলাকার ড্যাফোডিল আইডিয়াল হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক সুজন মাহমুদ এক কিশোরীকে ধর্ষণ করেন। গ্রাম্য সালিসে মাতব্বরেরা ওই শিক্ষককে জুতাপেটা ও দেড় লাখ টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়ার রায় দেন। ওই শিক্ষক পরিবারটিকে হুমকিধমকি দিয়ে বরিশালে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন বলে অভিযোগ ওঠে। ঘটনাটি পত্রিকায় প্রকাশের পর গ্রামের মাতব্বরদের পুলিশ আটক করে। কিছুদিন পর এঁরা জামিনে বেরিয়ে আসেন। শিক্ষকও বহাল তবিয়তে এলাকায় আছেন। শুধু মেয়েটি ও তার পরিবার এলাকাছাড়া। ১৯ মার্চ রাজধানীর দোলাইরপাড় এলাকায় আওয়ামী স্বাধীনতা লীগের কার্যালয়ে প্রেমিক ও বন্ধুকে বেঁধে এক কিশোরীকে ধর্ষণ করেন আওয়ামী স্বাধীনতা লীগের দুই নেতাসহ কয়েকজন। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ দুজনকে গ্রেপ্তার করে। ঘটনার শিকার কিশোরীটির সঙ্গে কোনো কথা বলা সম্ভব হয়নি। স্থানীয় থানা থেকে যোগাযোগের যে নম্বর দেওয়া হয়, কিশোরীটিকে আর সেই নম্বরে পাওয়া যায়নি। এলাকাবাসীও কিছু জানাতে পারেনি। গত ২৪ এপ্রিল সশস্ত্র একদল যুবক বাড়ির দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে কলেজে পড়ুয়া এক মেয়েকে ধর্ষণের পর হত্যা করে। ধর্ষকদের কোপে মেয়েটির মা ও প্রতিবেশী নিহত হন। আহত হন শ্রমিক ভাই। গতকাল পর্যন্ত এ ঘটনায় শ্রীপুর থানার পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এ বছরের মে মাস পর্যন্ত ধর্ষণের অন্তত ৩০টি ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ধর্ষণের শিকার ১৫ জন ছিল শিশু। এর বাইরে সংখ্যালঘু, দলিত জনগোষ্ঠীর বাসিন্দা, বিধবা, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। শ্রমজীবী নারী বাসে, ট্রাকে এমনকি নৌকায় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষকেরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারের স্বজন, স্কুল কমিটির প্রধান, শিক্ষক, সশস্ত্র সন্ত্রাসী, সন্ত্রাসীর সন্তান। লোকলজ্জা, প্রাণের ভয়, একঘরে হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় অনেক নারী ধর্ষণের ঘটনা চেপে যান। বেশির ভাগ নারী যখন আইনের আশ্রয় নিতে যান, তখন আলামত নষ্ট হয়ে যায়। আইনে ধর্ষণের শিকার নারীকে প্রমাণ করতে হয় তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়ায় অনেক সময় মামলা টেকে না। ধর্ষণের মামলা লড়েন এবং এ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এমন অন্তত ছয়জন আইনজীবীর সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। উত্তরাঞ্চলের আটটি জেলায় ধর্ষণের শিকার নারীদের সহযোগিতা দিয়েছেন এবং ১৪ বছরের অভিজ্ঞতা আছে এমন একজন আইনজীবী বলেন, পুলিশ প্রভাবশালীদের পক্ষ নিয়ে আসামি ধরতে দেরি করে। অহেতুক আসামির সংখ্যা বাড়িয়ে সব আসামির কাছ থেকে টাকাপয়সা আদায় করে। ঘটনার শিকার নারী ও তাঁর স্বজনদের পুলিশ বোঝায়, ধর্ষকদের সঙ্গে পেরে ওঠা যাবে না, মেয়ের ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে, বিয়ে হবে না ইত্যাদি। আইনজীবীরা আরও বলেছেন, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বারবার পরিবর্তন হওয়ায় অভিযোগপত্র দিতে দেরি হয়। মামলা যখন আদালতে গড়ায়, তখন তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ডাকা হয়। অন্য জায়গায় বদলির কারণে তিনি সময়মতো আদালতে উপস্থিত হতে পারেন না। রংপুরে ধর্ষণের শিকার এক নারী ২০১৩ সালের ১৮ মার্চ মামলা করেন। এ বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি ও ৭ মের পর পরবর্তী শুনানির তারিখ পড়েছে ১ নভেম্বর। দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেকে মামলা চালান না। এ বিষয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী রফিক-উল হক প্রথম আলোকে বলেছেন, দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে বিচারব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার দরকার। ঢাকার বাইরের অনেক আইনজীবী বলেছেন, আদালতে মামলাজট আছে, সত্য। তবে কোনো কোনো কৌঁসুলি টাকা না পেলে নানা ছলচাতুরী করে মামলা ঝুলিয়ে দেন। সাক্ষী হাজির থাকলেও তাঁকে আদালতে না তোলার মতো ঘটনা ঘটান অনেকে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টে এ ধরনের মামলা এলে আমি নিজে যাই। আর যদি যেতে না পারি, তাহলে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এগুলো নিষ্পত্তি করতে বলি।’ পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রশাসন)ðমোখলেসুর রহমান বলেন, নারী যখন বিচার চাইতে আসেন, তখন তিনি যেন সুবিচার পান, সেই ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া আছে প্রতিটি থানায়। নারীর ক্ষোভ-বিক্ষোভের প্রতি পুলিশ যেন সর্বোচ্চ সহানুভূতি দেখায়, সেই নির্দেশনাও আছে। অনিরাপদ যানবাহন: গত শনিবার খিলগাঁও থেকে ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফেরার পথে স্বামীকে নেশাদ্রব্য খাইয়ে স্ত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানোর অভিযোগ ওঠে। চালক তেলিয়াপাড়ায় ওই নারী ও তাঁর স্বামীকে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। গত ৯ ফেব্রুয়ারি সাভারে চলন্ত বাসে দুই তরুণীকে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বাসচালক সাদ্দাম ও তাঁর সহকারী মাসুদ ধর্ষণের চেষ্টা চালান। টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরে বাবাকে নৌকায় বেঁধে দুই মেয়েকে যমুনা নদীর চরে নিয়ে ধর্ষণ করে কয়েক দুর্বৃত্ত, ১২ মে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয় পোশাকশ্রমিক ধর্ষণের শিকার হন চলন্ত বাসে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক আবুল হোসেন বলেছেন, ‘সমাজ ও সরকারের সব কটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নারী যখন বিচারপ্রার্থী হবেন, তখন তাঁকে আশ্বস্ত করা যে ধর্ষণের ঘটনার দায় তাঁর নয়। ধর্ষণের শিকার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে চিকিৎসা ও সুবিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। অ্যাসিডে পুড়লে পানি ঢালতে হবে—এ কথাটি যেভাবে প্রচার করা হয়েছে, একইভাবে নারী যেন আলামত সংরক্ষণ করেন, সে ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। যাঁরা মামলা লড়েন তাঁরা বলছেন, শুধু ধর্ষণের জন্য আলাদা একটি ট্রাইব্যুনাল করা দরকার। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সর্বোচ্চ ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির কথা বলা আছে। কিন্তু নানা কারণে সেটি হচ্ছে না। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির অন্যতম পরিচালক তৌহিদা খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, এখন যে অবস্থা, তাতে শুধু ধর্ষণের বিচারের জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল দরকার। দোষীদের নিয়মিত বিচার না হলে এ অপরাধ কমবে না। {প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন গাজীপুর প্রতিনিধি মাসুদ রানা ও রাজবাড়ী প্রতিনিধি এজাজ আহমেদ}

No comments:

Post a Comment