Tuesday, May 12, 2015

কার্বাইডে ফল পাকালেও শাস্তির বিধান নেই!:প্রথম অালো

আম, কলা, পেঁপেসহ বিভিন্ন ফল পাকানোর কাজে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করা হলেও তা নিয়ন্ত্রণের কার্যকর উদ্যোগ নেই। শিল্পে ব্যবহারের জন্য এই রাসায়নিক আমদানি করা হলেও হাতবদল হয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ফল পাকানোর কাজে তা ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিদ্যমান কার্বাইড বিধিমালা অনুযায়ী, শিল্পক্ষেত্রের বাইরে যেকোনো নাগরিক বাধাহীনভাবে চার কেজি পর্যন্ত কার্বাইড পরিব
হন, মজুত এবং যেকোনো কাজে ব্যবহার করতে পারবে। এই সুযোগটিই অসাধু ব্যবসায়ীরা নিচ্ছেন বলে সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন। ফলে কার্বাইডের ব্যবহার বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে জানান, মাত্র ১৪-১৫ কেজি কার্বাইড দিয়ে ১০০ টন আম পাকানো সম্ভব। পানিতে মিশিয়ে তরল কার্বাইড ফলের ওপর ছিটানো হয়। এভাবে পাকানো ফল খেলে ক্যানসার, কিডনি বিকল হওয়াসহ জটিল রোগ সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। কার্বাইড দিয়ে পাকানো ফল খেলে শিশু ও গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল অনুষদের ডিন অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ। এর ফলে শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া অতিরিক্ত কার্বাইড মেশানো ফল খেলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে ডায়রিয়া ও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদে যকৃৎ ও কিডনির ক্ষতি হতে পারে। ওয়েল্ডিং কারখানায় লোহা ঝালাইয়ের কাজে ব্যবহৃত এসিটিলিন গ্যাসের উপাদান হিসেবে ক্যালসিয়াম কার্বাইড আমদানি করা হয়। কিন্তু হাতবদল হয়ে এটি ফল পাকানোর ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হচ্ছে। এই রাসায়নিকের অপব্যবহার রোধে ১৭ মে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক ডেকেছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। সেখানে ক্যালসিয়াম কার্বাইডের অপব্যবহার বন্ধে ‘কার্বাইড বিধিমালা-২০০৪’ এর শর্তাবলি সংশোধনী নিয়ে আলোচনা হতে পারে। বৈঠকে আইন, শিল্প, বাণিজ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড়াও বিনিয়োগ বোর্ড ও বিস্ফোরক অধিদপ্তরের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আহসানুল জব্বার প্রথম আলোকে জানান, ক্যালসিয়াম কার্বাইড ক্ষতিকর কাজে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। এর ব্যবহার ও আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং বিধি সংশোধন নিয়ে ১৭ মে আন্তমন্ত্রণালয়ের বৈঠক ডাকা হয়েছে। কার্বাইড বিধিমালা ২০০৪-এর কতিপয় শর্তের সংশোধনী প্রস্তাব জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি লিখিতভাবে পাঠিয়েছেন যুগ্ম সচিব ও বিনিয়োগ বোর্ডের পরিচালক মো. মাহবুব কবীর। চিঠির অনুলিপি বিস্ফোরক অধিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শককেও দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। চিঠিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, ক্যালসিয়াম কার্বাইড ফল পাকানোর কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে বিদ্যমান বিধি অনুযায়ী, যেকোনো নাগরিক বাধাহীনভাবে চার কেজি পর্যন্ত কার্বাইড পরিবহন, মজুত এবং যেকোনো কাজে ব্যবহার করতে পারবে। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বিধিমালায় ত্রুটিপূর্ণ বিধান থাকায় খোলা বাজারে কার্বাইড ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে ফল পাকানোর কাজে এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে। এ অবস্থায় বিধি সংশোধন করে লাইসেন্সবিহীন আমদানিকারক ও অনুমোদিত শিল্পে ব্যবহারকারী ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির কাছে কার্বাইড বিক্রয় ও সরবরাহ নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো হয়েছে। যুগ্ম সচিব মো. মাহবুব কবীর বলেন, ‘জনস্বার্থে আমি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে চিঠি পাঠিয়েছি। সরকার ফরমালিন আমদানি, পরিবহন, মজুত ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে কঠিন বিধান প্রণয়ন করেছে, যার সুফল দেশবাসী পাচ্ছে। এখন কার্বাইড আমদানি, পরিবহন, মজুত ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনুরূপ কঠিন বিধিবিধান তৈরি সময়ের দাবি।’ মো. মাহবুব কবীর জানান, ২০০৪ সালে তৈরি কার্বাইড বিধিমালায় কিছু ত্রুটি আছে, যে কারণে এই রাসায়নিক যেকোনো ব্যক্তি পরিবহন, মজুত ও ব্যবহার করতে পারবে। শিল্পকাজে ব্যবহার ছাড়া তৃতীয় কোনো ব্যক্তির কাছে তা হাতবদল হওয়া উচিত নয়। ২০০৪ সালের বিধিমালায় কার্বাইড হাতবদল ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো কঠিন শাস্তির বিধান রাখা হয়নি। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ১ হাজার ৮৬৯ টন কার্বাইড আমদানি হয়। আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৩৩৪, ফেব্রুয়ারিতে ১৮০ এবং মার্চে ৪৫ টন আমদানি হয়। বাংলাদেশে ক্যালসিয়াম কার্বাইডের প্রকৃত ব্যবহার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা মন্ত্রণালয় ও বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কাছে নেই। শিল্পে ব্যবহারের জন্য ১১টি প্রতিষ্ঠান কার্বাইড আমদানি করছে। এর কিছু অংশ চলে যাচ্ছে ফল বিক্রেতাদের কাছে। এই রাসায়নিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে প্রকৃত ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। কাস্টম হাউস সূত্র জানায়, ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা ও টাঙ্গাইলের ১১টি প্রতিষ্ঠান কার্বাইড আমদানি করে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে চট্টগ্রামের বিএসআরএম স্টিল, ফয়েজুন এসিটিলিন প্ল্যান্ট ও দীন হাবিব লিমিটেড, ঢাকার লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেড, খুলনার অক্সিজেন লিমিটেড, টাঙ্গাইলের বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্যাসেজ লিমিটেড, নারায়ণগঞ্জের ইউনিয়ন অক্সিজেন লিমিটেড, ডায়মন্ড স্টিল প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড, সালাহউদ্দিন অক্সিজেন লিমিটেড, ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেড এবং এ কে অক্সিজেন লিমিটেড। এ বিষয়ে কার্বাইড আমদানিকারক দীন হাবিব লিমিটেডের মালিক মো. হাবিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শিল্পে ব্যবহারের জন্য কার্বাইড আমদানি করি। কিন্তু মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বাণিজ্যিকভাবেও কার্বাইড আমদানি হতে পারে, যা ফল বিক্রেতাদের কাছে চলে যাচ্ছে। সরকার চাইলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত এবং শাস্তির আওতায় আনতে পারে।’

No comments:

Post a Comment