বাবা ফারুক হোসেন মালয়েশিয়ায় আছেন দীর্ঘদিন ধরে। মোবাইল ফোনে বাবার কাছে গল্প শুনে মালয়েশিয়াকে স্বপ্নপুরীর মতো মনে হয় আল আমীনের (১৮)। তাঁরও সেখানে যেতে সাধ হয়। কিন্তু কোনোভাবেই মালয়েশিয়া যাওয়ার ভিসা জোগাড় করতে পারেন না তিনি। শেষে স্থানীয় এক দালাল ধরেন। দালাল আশ্বাস দেয়, স্টুডেন্ট ভিসায় যাওয়া যাবে, টাকাও বেশি লাগবে না। আশ্বস্ত হয়ে বাবার পাঠানো টাকা থেকে দেড় লাখ টাকা দালালের হাতে তুলে দেন আল আমীন। দালা
ল তাঁকে টেকনাফে নিয়ে তুলে দেয় ট্রলারে। এরপর কেটে গেছে ১৬ মাস। আল আমীনের আর কোনো খোঁজ মেলেনি। দেশে ও মালয়েশিয়ার সম্ভাব্য সব দপ্তরে ছেলের খোঁজ করেছেন ফারুক হোসেন। কিন্তু কোথাও সন্ধান পাওয়া যায়নি তাঁর। আল আমীনের বাড়ি মাগুরার শালিখা উপজেলায়। তাঁর সঙ্গে আরো পাঁচজন মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য দালাল ধরেছিলেন। একসঙ্গেই বাড়ি ছেড়েছিলেন সবাই। আল আমীনের মতো তাঁদেরও আর খোঁজ মেলেনি। সুখের আশায় আদরের সন্তানকে অজানার পথে পাঠিয়ে এখন পরিবারগুলোর নিত্যসঙ্গী হয়েছে শোক। দাম দিয়ে কেনা যন্ত্রণার ছাপ তাদের চোখেমুখে। শুধু শালিখার এই ছয়জন নন, দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা মানবপাচারকারীরা আরো অসংখ্য পরিবারকে শোকসাগরে ভাসিয়েছে। দালালরা বলেছিল, একবার মালয়েশিয়ায় পা দিতে পারলেই আয় করা যাবে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। সেই লোভের ফাঁদে পড়ে কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দিনমজুর, স্বল্প শিক্ষত বেকার ও ছাত্ররা ধারদেনা করে, ভিটেমাটি বেচে মালয়েশিয়ার পথ ধরেছিল। আবার অনেককে ধরে এনে জোর করে তুলে দেওয়া হয়েছিল পাচারকারীদের ট্রলারে। তারপর অনেকেরই আজ পর্যন্ত আর কোনো খোঁজ মেলেনি। অন্যদের মধ্যে কারো ঠাঁই হয়েছে বন্দিশালায়, কারো বা গণকবরে। কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে জানা গেছে, গাইবান্ধা, যশোর, সাতক্ষীরা, সিরাজগঞ্জ, মাদারীপুর, হবিগঞ্জ, বগুড়া, ঝিনাইদহ, কক্সবাজার ও মাগুরার অন্তত ৫০০ জন মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয়েছে। শুরুতে একবার টাকা দিলেও পথে তাদের আটকে রেখে টাকার জন্য নির্যাতন করত দালালরা। বাড়িতে ফোন করে আরো টাকা চাইত। অনেক পরিবারের পক্ষ থেকে চাহিদা মোতাবেক বাড়তি টাকাও দেওয়া হয়েছে। তবু প্রিয়জনের খোঁজ মেলেনি। পরে পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করার পর পুলিশ এ পর্যন্ত ১৬ দালালকে গ্রেপ্তার করেছে। মাগুরা প্রতিনিধি জানান, মা জরিনা বেগমের ভাষ্য মতে, আরো অনেকের সঙ্গে তাঁদের একমাত্র ছেলে আল আমীন মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য টাকা দিয়েছিলেন দালাল আজিজুল ইসলামকে। আজিজের বাড়ি উপজেলার দীঘি গ্রামে। কথা ছিল স্টুডেন্ট ভিসায় আল আমীনকে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়া হবে। পরে তাঁকে টেকনাফে নিয়ে ট্রলারে তুলে দেয় আজিজ। এর পর থেকে ছেলের আর কোনো সন্ধান মেলেনি। নিখোঁজ অন্যরা হলেন দীঘি গ্রামের কৃষক ইকরাম হোসেন, আড়ুয়াকান্দি গ্রামের মিটুল হোসেন, জুনারী গ্রামের টিটুল হোসেন, শরাফত হোসেন ও ইসলাম আলী। ইকরাম ও মিটুলও টাকা দিয়েছিলেন আজিজকে। অন্যরা টাকা দিয়েছিলেন জুনারী গ্রামের দালাল দোলন মোল্যা, রাজু মোল্যা ও নাজমুল হোসেনকে। দালালরা একেকজনের কাছ থেকে নিয়েছিল দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। নিখোঁজ ইকরামের ছেলে সোহেল বলেন, ‘আমার বাবাকে মালয়েশিয়ায় নির্মাণ শ্রমিকের কাজ দেওয়ার কথা বলে আজিজুল দুই লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়েছে। বাবা নিখোঁজ হওয়ার পর আমরা একাধিকবার আজিজুলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। সে প্রথমে নানা কথা বলে ঘুরিয়েছে। পরে ঢাকার উত্তরার একটি বাসায় ডেকে নিয়ে আমাকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। বর্তমানে আজিজ পলাতক।’ মাগুরা সদর উপজেলার ডেফুলিয়া গ্রামের নিখোঁজ ইমরান শেখ, ইমরান মোল্যা ও শাহিন হোসেনও দেড় মাস ধরে নিখোঁজ রয়েছেন। রাজ্জাক ও রানা নামের দুই দালালের মাধ্যমে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে তাঁরা নিখোঁজ হন। পুলিশ দালাল রানাকে আটক করেছে। মাগুরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের প্রবাসীকল্যাণ শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী কমিশনার নাকিব হাসান তরফদার জানান, ভুক্তভোগীদের উচিত নিখোঁজ স্বজনদের বিষয়টি প্রশাসনকে জানানো। পাশাপাশি দালালচক্রকে ধরে পুলিশে দেওয়া। সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানান, অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত দেড় বছরে সাতক্ষীরার অর্ধশাতাধিক যুবক মনবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় নিখোঁজ হয়েছেন। এর মধ্যে কলারোয়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের ২৫ যুবক রয়েছেন। নিখোঁজ ব্যক্তিরা হলেন কলারোয়া উপজেলার বসন্তপুর গ্রামের সুমন, সাহেদ আলী, সাইফুল ইসলাম, রাজু আহম্মেদ, আব্দুস সাত্তার, সোহাগ হোসেন, বাবু, আলামিন, কবিরুল ইসলাম, আজমুল, হোসেন, আরিফ হোসেন, আব্দুর রহিম, খলশি গ্রামের মহিদুল ইসলাম, ওফাপুর গ্রামের সিরাজুল ইসলাম, আব্দুর রাজ্জাক, জাকির হোসেন, আব্দুল্লাহ, তরুলিয়া গ্রামের জামিরুল ইসলাম, কামারালী গ্রামের গোলাম রসুল, শুভংকরকাটি গ্রামের সজিবুর রহমান, ঘরচালা কাশিয়াডাঙ্গা গ্রামের রাসেল রানা সুমন, শহিদুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম, সবুজ হোসেন, আলমগীর হোসেন, গয়ড়া গ্রামের ইলাই বকস, ছলিমপুর গ্রামের আমিনুল। এ ছাড়া তালা উপজেলার চারজন, দেবহাটা উপজেলার একজন ও সাতক্ষীরা সদর উপজেলার একজন নিখোঁজ আছেন বলে তাঁদের পারিবারিক সূত্র দাবি করেছে। কলারোয়ার বসন্তপুর গ্রামের জলাল মোড়লের স্ত্রী সালেহা খাতুন মেলী জানান, দেড় বছর আগে শুভংকরকাটি গ্রামের করিম ময়রার মেয়ে তাঁর ছেলে বাবুকে বিদেশে গিয়ে মাসে লাখ টাকা আয় করার লোভ দেখায়। স্থানীয় শেখ আমানুল্লাহ কলেজে অনার্সপড়ুয়া বাবু একপর্যায়ে লেখাপড়া বন্ধ করে দেন। সংসারে সচ্ছলতা আনতে অবশেষে ছেলের কথায় তিনি রাজি হন। ভিটেমাটি বিক্রি করে তাঁকে সাগরপথে বিদেশে পাঠানো হয়। যশোরের মণিরামপুর উপজেলার পারখাজুরা গ্রামের সাত্তার মোড়লের ছেলে আজিজ মোড়ল বাবুসহ বসন্তপুর গ্রামের আরো ১৩ যুবককে সাগরপথে মালয়েশিয়ার কথা বলে নিয়ে যায়। তবে দেড় বছর পার হলেও তাঁদের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এই গ্রামের নিখোঁজ ১৪ যুবকের মধ্যে একই পরিবারের আছেন চারজন। কলারোয়ার কামারালী গ্রামের আব্দুল খালেক জানান, ছয় মাস আগে মানবপাচারকারীরা তাঁর ছেলে মজিবুর রহমানকে সাগরপথে মালয়েশিয়ার কথা বলে নিয়ে যায়। সাগরে নৌকার মধ্যে কয়েক দিন অনাহারে থাকার পর তিনি মারা যান। পরে দালালদের হাতে-পায়ে ধরে অতিরিক্ত আরো সাড়ে তিন লাখ টাকা দিয়ে ছেলের লাশ বাড়ি নিয়ে আসেন। এ ঘটনায় তিনি উপজেলার শুভংকরকাটি, মুরারীকাটি ও যশোরের ঝিকরগাছা গ্রামের তিন মানবপাচারকারীর বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় আব্দুল লতিফ নামের এক পাচারকারীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও অজ্ঞাত কারণে সে জামিনে বাড়ি ফিরে এসে উল্টো তাঁকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে কয়েকজন পাচারকারীর নাম বেরিয়ে এসেছে। তারা হলো কলারোয়ার দেয়াড়া গ্রামের আজগর আলী, যুগীখালী গ্রামের আবুল বাশার, কামরুল ইসলাম, কামারালী গ্রামের আব্দুল মান্নান, বাননালি গ্রামের রফি দালাল, ওফাপুর গ্রামের আফিল উদ্দীন, সাহাজান আলী, লাল্টু, মির্জাপুর গ্রামের আব্দুল লতিফ, কাদপুর গ্রামের আব্দুল লতিফ, জয়নগর গ্রামের প্রবাসী আলতাফের স্ত্রী, ধানদিয়ার কবিরুল ইসলাম ওরফে লিবিয়া কবিরুল, খোরদো গ্রামের ওবায়দুর, মফিজুল ইসলাম খোকন, দলুইপুর গ্রামের রবিউল ইসলাম, ছলিমপুর গ্রামের মিরাজ হোসেন ও দেয়াড়া গ্রামের তোজাম উদ্দীন। সম্প্রতি থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার জঙ্গলে গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পর থেকে পাচারকারীরা গা ঢাকা দিয়েছে। জেলা পুলিশের তথ্য কর্মকর্তা এসআই কামাল হোসেন জানান, মানবপাচারকারীদের নামের তালিকা পুলিশের কাছে নেই। তবে কাজ শুরু হয়েছে। সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, মালয়েশিয়ার নাম করে বাড়ি ছাড়ার পর জেলার অন্তত তিন শতাধিক মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছে। স্থানীয় একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ডিডিপি এ হিসাব দিয়েছে। মুক্তিপণ দিতে না পারায় নিহত হয়েছে আরো অন্তত ৩০ জন। নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন এনায়েতপুর থানার রূপনাই গ্রামের সুলতান হোসেন, ফুলজার হোসেন, শাহ আলম, কুদ্দুস, তপা, চরকাদহ গ্রামের আলামিন, রূপসী গ্রামের মাহাদের চন্দ্র, খুকনী গ্রামের আইয়ুব আলীর ছেলে মোরছালিন, খুকনী উত্তরপাড়ার রায়হান আলী, জালালপুরের সাইফুল ইসলাম, আব্বাস আলী, শাহজাহান, জাবেদের ছেলে শাহিন, শিবপুরের আবু বক্কার ও খোকশাবাড়ী গ্রামের ইব্রাহিম। বেলকুচি, শাহজাদপুর, কাজিপুর, উল্লাপাড়া ও কামারখন্দ উপজেলায়ও এ রকম আরো অনেক মানুষ নিখোঁজ রয়েছে। প্রিয় স্বজনদের খোঁজ না পওয়ায় প্রতিটি পরিবারেই চলছে আহাজারি। অনেক পরিবার এলাকার দালালদের কাছে চাহিদা অনুয়ায়ী টাকা দিয়েও স্বজনদের ফিরে পাচ্ছে না। উল্টো তাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে মুখ না খুলতে। এনায়েতপুর থানার জালালপুরের হজরত আলী বাড়ি বিক্রি করে দুই লাখ ৩০ হাজার টাকা খোকশাবাড়ীর রউফ দালালের কাছে দিলেও এখনো তাঁর ছেলে আব্বাস আলীর হদিস পাননি। আব্বাসের সহযাত্রী মনিরুল মালয়েশিয়া পৌঁছে ফোন করে জানিয়েছেন, আব্বাসকে অসুস্থ অবস্থায় দালালরা সাগরে ফেলে দিয়েছে। এ কথা শোনার পর পরিবারে চলছে হাহাকার। রূপসী গ্রামের তোতা মিস্ত্রি জানান, দালাল সাদ্দাম তাঁর ছেলে মহাদেব চন্দ্রের খোঁজ দেবে এমন কথা বলে টাকা নিলেও এখন পর্যন্ত কোনো খোঁজ দেয়নি। মানবপাচারকারী দালালদের মধ্যে আছে এনায়েতপুরের জেন্নত আলী মোল্লা, তাঁর ভাই বিশু মোল্লা, মেয়ের জামাই শরিফ উদ্দিন, আব্দুর রউফ, আজমত আলী, ফজল হক, শাবু বেপারী, তাঁর ছেলে রাসেল, আব্দুস সামাদ, রহিম উদ্দিন, আইয়ুব আলী, খোকশাবাড়ীর সাদ্দাম বেপারী, ফজলুল হোসেন, সোনাতলার ফরিদ, হজরত আলী মেম্বার, দ্বাদশপট্টি গ্রামের কালাম, ভাঙ্গাবাড়ী গ্রামের হোসেন দালাল, গোপীনাথপুরের আব্দুল হালিম ও খামার গ্রামের আলমাস দালাল। এর বাইরেও শতাধিক সহযোগী দালাল রয়েছে। আকাশ পথে প্রতারণা করে মানব পাচার করে খোকশাবাড়ী গ্রামের আলতাফ হোসেন শেখ, ব্রাহ্মণগ্রামের হাসান দালাল, মণ্ডলপাড়ার জহুরুল ইসলাম ও ইয়াকুব হোসেন। দালালদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৯টি। সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুভাষ চন্দ্র সাহা জানান, আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যেই পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানান, মালয়েশিয়ায় মানবপাচারকারী চক্রের একটি নেটওয়ার্ক ঝিনাইদহে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় রয়েছে। ইতিমধ্যে চক্রের খপ্পরে পড়ে জেলার বিভিন্ন গ্রামের অন্তত ৩০ যুবক সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে পাচারের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে বেশির ভাগের আর খোঁজ মেলেনি। নিখোঁজ যুবকদের স্বজনরা এসব অভিযোগ করেছে। তারা বলছে, যে কয়জনের খোঁজ পাওয়া গেছে তারা থাইল্যান্ডের কারাগারে মানবেতর জীবন যাপন করছে। পাচারের ঘটনায় ঝিনাইদহ সদর থানায় এ পর্যন্ত তিনটি মামলা হয়েছে। পুলিশ আসামিদের মধ্যে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। বাকিরা পলাতক। গত রবিবার সদর উপজেলার শুড়পাড়া, রামচন্দ্রপুর, গাড়ামারা গ্রামসহ বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে। নিখোঁজ যুবকদের একজন শুড়াপাড়া গ্রামের হাসান আলী। তার বাবা আবদুর রহমান বলেন, ‘শুড়াপাড়ার হারুন শাহ বিদেশে মানুষ পাচারের সঙ্গে জড়িত। সে তিন মাস আগে হাসান ও একই গ্রামের আবদুর রাকিবকে মালয়েশিয়ায় পাঠানোর জন্য নিয়ে যায়। এর পর থেকে তাদের সঙ্গে আমাদের আর কোনো যোগাযোগ নেই। পাঠানোর সময় দুই হাজার করে টাকা নিয়েছিল। পরে আড়াই লাখ টাকা দাবি করে। হারুন শাহর বিরুদ্ধে গত ১৯ মে ঝিনাইদহ সদর থানায় মামলা করেছি। আসামি এখনো গ্রেপ্তার হয়নি।’ রামচন্দ্রপুর গ্রামের এস এম হারুন জানান, মানবপাচারকারী চক্রের দালাল গাড়ামারা গ্রামের হাসান আলী, আতিয়ার রহমান, রামচন্দ্রপুরের জগত আলী, হামিদ হোসেন, সোনারদাড়ি গ্রামের শরিফুল ইসলাম, ড্যাফলবাড়িয়া গ্রামের শামসুল ও বিল্লাল মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য টাকা দিয়েছিল রাজনগরের মোফাজ্জেল হোসেন ও বেড়াশুলার নুরুল হোসেনকে। কিন্তু রওনা দেওয়ার পর থেকে তারা সবাই নিখোঁজ রয়েছে। একই সঙ্গে রওনা দিয়েছিল গাড়ামারা গ্রামের মাসুদ রানা, নাজমুল হোসেন, লাল চাঁদ, ফকির হোসেন ও আলমগীর হোসেন। দালালদের কাছে সবাই এক লাখ থেকে দুই লাখ ২০ হাজার করে টাকা দিয়েছিল। তাদেরও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। স্বজনরা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এ ছাড়া হরিণাকুণ্ডু উপজেলার সড়াবাড়িয়া গ্রামের আলমগীর হোসেন, খায়রুল, আজাদ, বকুল শেখ ও হাশেম বিদেশে যাওয়ার জন্য দালালকে টাকা দিয়েছিল। রওনা দেওয়ার পর থেকে প্রায় ছয় মাস ধরে তারা সবাই নিখোঁজ। শৈলকুপা উপজেলার ব্রাহিমপুর গ্রামের সাবু হোসেন, আবদুল মতলেব ও তরুণ মালয়েশিয়ায় যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে রওনা হয়। স্বজনরা তাদের কারো কোনো খোঁজ পাচ্ছে না। ঝিনাইদহের এসপি আলতাফ হোসেন জানান, মানবপাচারের ঘটনায় ঝিনাইদহ সদর থানায় তিনটি মামলা হয়েছে। সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার বলাকীপুর ও চুনারুঘাটের বাল্লা সীমান্তবর্তী এলাকার গাজীপুর ইউনিয়নের পাঁচ গ্রামের ২০ যুবক নিখোঁজ রয়েছে। আরো প্রায় ২০ জন ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের কারাগারে আছে। নিখোঁজ যুবকদের স্বজনরা বলছে, গাজীপুর ইউনিয়নের টেকেরঘাট গ্রামের সেলু মিয়া, আশরাফ উল্লা, লাভলু মিয়া, ময়না মিয়া, মতলিব মিয়াসহ ১০ জন, গোবরখলা গ্রামের মোজাম্মেল, রাসেল, গাজীপুর গ্রামের জসিম, মুক্তাজিল, দীঘিরপাড় গ্রামের জসিম মিয়া, বজুর্ম গ্রামের সাইফুল মিয়া, আলীনগর গ্রামের নয়ন মিয়া, বানিয়াচংয়ের বলাকীপুর গ্রামের জমির আলী, সমুজ আলীসহ ৩০ যুবক সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য আড়াই মাস আগে দালালদের টাকা দিয়েছিল। গাজীপুর ইউনিয়নের কেদারাকুট গ্রামের দালাল হিরাই মিয়া (মালয়েশিয়ায় থাকে), তার ভাই বাচ্চু মিয়া, তার চাচাতো ভাই আব্দুল আলী, রিয়াজ, বোনের স্বামী মাসুক, মোহাম্মদ আলী, মহিবুর রহমান এ টাকা নিয়েছিল। দুই লাখ থেকে পাঁচ লাখ পর্যন্ত টাকা নিয়েছিল তারা। রওনা দেওয়ার পর থেকে ৩০ জনের মধ্যে ২৫ জনই নিখোঁজ রয়েছে। বগুড়া অফিস জানায়, দুপচাঁচিয়া উপজেলার চামরুল ইউনিয়নের বেলাল, রবিউল, মনজুর, মিজানুর, শাহজাহান ও নজরুলের পরিবারে কান্না থামছে না। জমি বিক্রি করে দালাল ধরে মালয়েশিয়ার যাওয়ার জন্য আড়াই মাস আগে বাড়ি ছেড়েছিলেন তাঁরা। এরপর তাঁদের জিম্মি করে পদে পদে আরো টাকা নিয়েছে দালালরা। তবে টাকা দেওয়ার পরও ছয়জনের কোনো খোঁজ মিলছে না। সম্প্রতি থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় জঙ্গলে গণকবর ও বন্দিশালার খবর প্রকাশের পর পরিবারগুলোতে চলছে আহাজারি। জানা গেছে রওনা দেওয়ার এক মাসের মাথায় সাগরে ট্রলার থেকে মোবাইল ফোনে ছয়জন পরিবারকে জানান, দালালকে দুই লাখ করে টাকা দিলে তাঁদের মালয়েশিয়া উপকূলে পৌঁছে দেবেন। এ কথা শুনে ছয় যুবকের প্রত্যেক পরিবার দুই লাখ করে টাকা দেয় দালাল আবু বক্করকে। এরপর থেকে দালাল আবু বক্কর গা ঢাকা দিয়েছে। আবু বক্করের বাড়িও কোলগ্রামে। তার ছেলে রবিউল ইসলাম ও একই গ্রামের তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে রনি এক বছর আগে গ্রামের আরেক দালাল মালয়েশিয়ায় চাকরিরত জাহিদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করে সাগরপথে মালয়েশিয়া যায়। এরপর থেকে রবিউল ও রনি মালয়েশিয়া থেকে গ্রামের যুবকদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করতে থাকে। এভাবে দুই কিস্তিতে ১৫ জন লোকের কাছ থেকে টাকা নেয় আবু বক্কর। মালয়েশিয়া পাঠানোর কথা বলে গত ৬ মার্চ ওই গ্রামের ছয়জন ও অন্য এলাকার চারজনকে নিয়ে যায়। নিখোঁজ বেলালের বাবা আবদুস সামাদ গত রবিবার দুপচাঁচিয়া থানায় আবু বক্কর, তার স্ত্রী হোসনে আরা, তোফাজ্জলের স্ত্রী মিনা বেগম, রবিউল ইসলাম ও রনি হোসেনকে আসামি করে মামলা করেন। মামলার পর পরই পুলিশ ওই দিন হোসেন আরা ও মিনা বেগমকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ। মাদারীপুর প্রতিনিধি জানান, দালাল ধরে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয়েছেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার আমগ্রাম ইউনিয়নের তেলিকান্দি গ্রামের সাত যুবক। তাঁদের পরিবারে চলছে কান্নার রোল। নিখোঁজ ব্যক্তিরা হলেন হান্নান মাতুব্বর, জহিরুল মাতুব্বর, রাসেল মোল্যা, হানিফ শেখ, ওবায়দুর খাঁ, অহিদুল খাঁ ও বিনাদ খাঁ। পারিবারিক সূত্র জানায়, ১৫ মার্চ মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা বলে ওই সাতজনকে ঢাকা নিয়ে যায় উপজেলার বাজিতপুর ইউনিয়নের পাখুল্যা গ্রামের দালাল সাদেক বয়াতি ও এহছাক মল্লিক। এরপর থেকেই সাতজন নিখোঁজ। বিনাদ খাঁর মা ফরিদা বেগম বলেন, ‘দালালরা বিনাদকে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ২০ হাজার টাকা নেয়। টাকা দেওয়ার পর ১৫ মার্চ বিনাদকে নিয়ে যায় তারা। এরপর থেকে ছেলের আর খোঁজ মেলেনি। কক্সবাজারের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার মরিচ্যা পালং হাই স্কুলের প্রায় ২০ শিক্ষার্থী মালয়েশিয়ায় পাচার করে দালালচক্র এখন গা ঢাকা দিয়েছে। স্কুলটির ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির পাচার হয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাত্র তিনজনের খোঁজ মিলেছে। বাকিদের ঘরে চলছে আহাজারি। অভিযোগ রয়েছে, অভিভাবকরা এ ঘটনায় থানায় মামলা করতে গেলেও পুলিশ মামলার পরিবর্তে জিডি করেছে। অভিযোগ রয়েছে, উপজেলার হলদিয়া পালং ইউনিয়নের মরিচ্যা বাজারের ফজল-নুর শপিং কমপ্লেক্সে একটি কম্পিউটার বসিয়ে এক বছর ধরে স্থানীয় পাগলিরবিল গ্রামের বশির আহমদ নামের এক যুবক পাচারের কাজ করছে। কম্পিউটারে আকর্ষণীয় গেমসহ নানাভাবে ভুলিয়ে কিশোরদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে সে। পরে কৌশলে তাদের পাচার করে। শপিং কমপ্লেক্সের মালিক ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সিকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বশিরকে আমার মার্কেট থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছি।’ গত কয়েক দিন ধরে বশির গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে। পাচারের ঘটনায় বশিরের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছেন একজন অভিভাবক। নিখোঁজ ছাত্র মনজুরের বাবা ইলিয়াস বলেন, বশিরকে হাতেনাতে ধরে ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে দেওয়া হয়েছিল। তার মোবাইলে যাবতীয় প্রমাণ রেকর্ড থাকায় সেই মোবাইলটিও চেয়ারম্যানের কাছে জমা রাখা হয়। কিন্তু চেয়ারম্যান মোবাইলসহ বশিরকে ছেড়ে দেন। হলদিয়া পালং ইউপির চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন মিন্টু কালের কণ্ঠকে জানান, ‘বশিরের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ায় ছাত্র পাচারের অভিযোগ ওঠার বিষয়টি আমি সিরিয়াসলি নিয়েছি। তবে সে পালিয়ে যেতে পারবে না চিন্তা করেই মোবাইলটি ফেরত দিয়েছি।’ মরিচ্যা পালং হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সাক্ষ্য মিত্র বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার স্কুল থেকে অনেক ছাত্র পাচার হয়েছে, এটা সত্যি। তবে এ পর্যন্ত পাচার হওয়া ছাত্রদের ছয়জন অভিভাবক তাঁদের সন্তানের জন্য সনদ নিয়েছেন। অন্যরা হয়তো ঝামেলার আশঙ্কায় আইন-আদালতের আশ্রয় নিতে চান না। গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, নানা লোভ দেখিয়ে গাইবান্ধার বেশ কিছু যুবককে মালয়েশিয়া পাঠিয়েছে দালালচক্র। সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউপির সদস্য মজিবর রহমান থানায় মামলা করার পর রেজাউল করিম নামে চক্রের এক সদস্যকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। রেজাউল ও তার ছেলে লাবলু মিয়ার (পলাতক) বিরুদ্ধে সদর উপজেলা, পলাশবাড়ী উপজেলার মনোহরপুর ইউনিয়নের কুমেদপুরসহ পার্শ্ববর্তী বাদিয়াখালী, বোনারপাড়া, নাকাইহাট এলাকার যুবকদের মালয়েশিয়া পাঠানোর নাম করে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। ইউপি সদস্য মজিবর রহমান জানান, রেজাউল করিম ও লাবলু তাঁর ছেলে মাহমুদুল হাসান নয়নকে মালয়েশিয়ায় চাকরি দেওয়ার কথা বলে চার লাখ টাকা নেয়। গত ফেব্রুয়ারিতে তারা নয়নকে বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। দুই মাস পর নয়ন মালয়েশিয়া থেকে জানায়, তাকে মারধর করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এরপর থেকে তার সঙ্গে পরিবারের আর যোগাযোগ হয়নি। লাবলুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সে নয়নকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আরো ৪০ হাজার টাকা দাবি করে। তাই বাধ্য হয়ে তিনি মামলা করেছেন। মজিবর রহমান সাংবাদিকদের জানান, তাঁর জানামতে রেজাউল ও লাবলু জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আরো ২০-২৫ জন যুবকের কাছ থেকে মালয়েশিয়ায় পাঠানোর কথা বলে কোটি টাকা নিয়েছে। নয়ন ছাড়াও একই এলাকার শাহ আলম, মোতাল্লেব মিয়া, আলমগীর হোসেন বাবু, আবুল কালাম, সাইদুর রহমান, আনারুল ইসলাম, বাবু মিয়া, আব্দুর রশিদসহ বেশ কয়েকজনকে মালয়েশিয়া পাঠানোর কথা বলে নিয়ে যায় রেজাউল ও লাবলু।
No comments:
Post a Comment