দেশ থেকে টাকা পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না। গড়ে প্রতিবছর তা বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন সংস্থার হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রতিবছর দেশে যে পরিমাণে বিদেশী বিনিয়োগ আসছে তার চেয়ে বেশি অর্থ দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ২০০১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এক যুগে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে ৯০৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। একই সময়ে দেশ থেকে পাচার হয়েছে ২ হাজার ১৩ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। অর্থাৎ এই সময়ে বিদেশী বিনিয়োগের চেয়ে দেশ থেকে ১ হাজার
১০৯ কোটি ৯৯ লাখ ডলার বেশি পাচার হয়েছে। শতকরা হিসাবে ১২২ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেশি অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এদিকে ইউএনডিপির হিসাবে স্বাধীনতার চার দশকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে একই সময়ে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। ২ লাখ কোটি টাকা বেশি পাচার হয়েছে। শতকরা হিসাবে প্রায় ২০০ শতাংশ বেশি পাচার হয়েছে। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটির হিসাবে ২০০১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এক যুগে বাংলাদেশ থেকে ২ হাজার ১৩ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। যা দিয়ে ৬টি পদ্মা সেতু বানানো সম্ভব। আলোচ্য সময়ে দেশে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে ৯০৩ কোটি ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৭২ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। অর্থাৎ যে পরিমাণ এফডিআই দেশে এসেছে তার চেয়ে দ্বিগুণের বেশি অর্থ দেশ থেকে পাচার হয়েছে। জিএফআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে দেশ থেকে পাচার হয়েছে ১৭৮ কোটি ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ১৪ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। ২০১১ সালে পাচার হয়েছিল ২৮০ কোটি ৫০ লাখ ডলার বা ২২ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। ২০১০ সালে পাচার হয়েছিল ২১৯ কোটি ১০ লাখ ডলার বা ১৭ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা। ওই এক বছরে দেশ থেকে টাকা পাচার বেড়েছে ২৮ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে প্রতিবছর গড়ে ১৬৭ কোটি ৭৮ লাখ ডলার বা ১৩ হাজার ৪২২ কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার হয়েছে। প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, আলোচ্য সময়ে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে ২০১১ সালে। এর আগে সর্বোচ্চ পরিমাণ টাকা পাচার হয়েছিল ২০০৬ সালে, যার পরিমাণ ২৬৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার। ২০০৭ সালে পাচার হয়েছে ২৫৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার। জিএফআইয়ের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০২-১১ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটেছে চীনে, যার পরিমাণ ১ লাখ আট হাজার কোটি ডলার। দ্বিতীয় স্থানে আছে রাশিয়া, পাচার হয়েছে এক লাখ ৮৮ হাজার কোটি ডলার। তৃতীয় স্থানে নাম রয়েছে মেক্সিকো, পাচার হয়েছে ৪৬ হাজার ১৮৬ কোটি ডলার। চতুর্থ স্থানে রয়েছে মালয়েশিয়া, পাচার হয়েছে ৩৭ হাজার কোটি ডলার। পাচার হওয়া শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় ভারতের অবস্থান পঞ্চম। এ দেশ থেকে গত ১০ বছরে ৩৪ হাজার ৩৯৩ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৪৭তম। সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাংকের পদ্ধতি প্রয়োগ করে একটি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক আবদুল আউয়াল সরকার। প্রতিবেদনে তিনি বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করে পাচার করা টাকা সম্পর্কে নানা তথ্য পেয়েছেন। ওই সব তথ্যে পাচার করা টাকার অংক আরও বেশি বা কম হচ্ছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, চোরাচালান, পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বেশি মূল্য দেখানো এবং রফতানির ক্ষেত্রে কম দেখানো এবং হুন্ডি- প্রধানত এ চারটি পথে দেশ থেকে প্রতিবছর ওই সব টাকা পাচার হচ্ছে। টাকা পাচারের কারণ হিসেবে দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, মুদ্রার অতিমূল্যায়িত বিনিময় হার, আর্থিক খাতের অদক্ষতা, করনীতিতে বৈষম্য, মুদ্রার চলাচলে কঠোরতা আরোপ, ভারতীয় অর্থনীতির প্রভাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার নিয়ে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান গবেষণা করেছে। তাদের প্রত্যেক গবেষণাতেই দেশ থেকে টাকা পাচারের ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। সুইস ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেশ থেকে টাকা পাচারের ঘটনার তথ্য বেরিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তার প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৯৪ সালে ১০৬ কোটি ডলার, ১৯৯৬ সালে ১৮২ কোটি ৩০ লাখ ডলার, ১৯৯৮ সালে ১২২ কোটি ডলার, ২০০০ সালে ১১৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার, ২০০১ সালে ১৬৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার, ২০০২ সালে ১৪৩ কোটি ১৬ লাখ ডলার, ২০০৬ সালে ৮৯ কোটি ১০ লাখ ডলার এবং ২০০৭ সালে ১৩২ কোটি ৮০ লাখ ডলার পাচার করার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, অর্থ পাচার রোধে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি এখন অনেক বেড়েছে। ফলে ব্যাংকের মাধ্যমে মুদ্রা পাচার নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এ ছাড়া কাস্টমসের কার্যক্রম অটোমেশন করা হয়েছে। তাই মিস ইনভয়েসিং করা আগের চেয়ে অনেক কঠিন হয়ে গেছে। ফলে অর্থ পাচার আগের চেয়ে কমেছে। আমদানির নামে পাচার : শিল্প বিনিয়োগে মন্দার মধ্যেও শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। তাদের মতে, শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির নামে দেশ থেকে টাকা পাচার করা হচ্ছে। কেননা যেভাবে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি হয়েছে, সেভাবে শিল্পের উৎপাদন বাড়েনি। তাহলে আমদানি করা ওই সব শিল্প উপকরণ কোথায় গেল? কৃষিতে গত কয়েক বছর ধরে বাম্পার ফলন হওয়ার পরও সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপকভাবে চাল আমদানি বেড়েছে। সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, তারপরও কেন চাল আমদানি হচ্ছে- এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সম্প্রতি যুগান্তরকে বলেন, শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল এবং চাল আমদানির নামে টাকা কোথায় যাচ্ছে তা খতিয়ে দেখা দরকার। এ পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক তদন্তে দেখা গেছে, যেসব কনটেইনারে শিল্পের যন্ত্রপাতি থাকার কথা, সেখানে পাওয়া গেছে ছাই, ইট, বালি, পাথর, সিমেন্টের ব্লকের মতো নানা বস্তু। এ ছাড়া চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে শুল্ক গোয়েন্দাদের তদন্তে খালি কনটেইনার আমদানির ঘটনাও ধরা পড়েছে। রফতানির নামে পাচার : ভুয়া রফতানি এলসি (ঋণপত্র) এবং ক্রয় চুক্তির মাধ্যমে টাকা পাচার বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে এ ধরনের বেশ কিছু ঘটনা ধরা পড়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ, বংশাল শাখা ও বেসিক ব্যাংকের শান্তিনগর শাখা থেকে এ ধরনের পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। ওই সব শাখার মাধ্যমে পণ্য রফতানি করেও তার মূল্য দেশে আসেনি। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে ওই অর্থ পাচার হয়ে গেছে। এর মধ্যে বেসিক ব্যাংকের মাধ্যমে ১৯৯ কোটি টাকা, কমার্স ব্যাংকের মাধ্যমে ১৫৭ কোটি টাকার রফতানি আয় দেশে না আসার তথ্য মিলেছে। রফতানি আয় দেশে না আসার ঘটনা অন্যান্য ব্যাংকের ক্ষেত্রেও রয়েছে। মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম : গত বছর মালয়েশিয়ান সরকারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বিদেশীদের জন্য মালয়েশিয়ান সরকারের সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী দেশ। এভাবে দেশ থেকে বিদেশে টাকা নিতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এ ধরনের কোনো অনুমোদন দেয়া হয় না। তারপরও বাংলাদেশ মালয়েশিয়ায় কীভাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী দেশ হল- এ প্রসঙ্গে ড. মইনুল হোসেন জানান, নিশ্চিতভাবে ওই সব টাকা পাচার করা হয়েছে। কানাডায় বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী বসবাস করেন এমন একটি এলাকার নাম হয়েছে বেগমপাড়া। বিশেষ দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতারা ওখানে টাকা পাচার করে সম্পদ গড়ে তুলেছেন। হংকংয়ে অনেক বাংলাদেশী ব্যবসায়ীর অফিস রয়েছে। সেখানে তারা পুঁজি পাচার করে নিয়মিত ব্যবসা করছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
No comments:
Post a Comment