প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৮ জুন মন্ত্রিসভা বৈঠকের পর তাঁর সচিবালয়ের দপ্তরে খাদ্যসচিব মুশফেকা ইকফাৎকে ডেকে পলিথিনের ভেতর ভরা পচা গমের নমুনা দেন এবং ক্ষোভ প্রকাশ ক
রেন। পলিথিনের সেই গমগুলো ছিল পোকায় খাওয়া, কালো, ওজনে কম ও ক্ষুদ্র আকৃতির। ভাঙা গমের পরিমাণও ছিল অনেক বেশি। খাওয়ার অনুপযোগী এসব গম কেন আমদানি করা হয়েছে তা তদন্ত করে বের করার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনার পর খাদ্যসচিব সব জেলা প্রশাসককে (ডিসি) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে জেলার খাদ্য গুদাম থেকে গমের নমুনা সংগ্রহ করে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেন। অন্যদিকে গম আমদানি প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে দুটি গোয়েন্দা সংস্থা। খাদ্য অধিদপ্তরের গম আমদানিকালীন মহাপরিচালক (ডিজি) মো. সারওয়ার খানকে গত রবিবার ওএসডি করা হয়। এর আগে গত ২২ এপ্রিল গম আমদানি নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় খাদ্য অধিদপ্তর থেকে তাঁকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মো. সারওয়ার খান গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ব্রাজিল থেকে গম আমদানি বিষয়ে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলতে হলে আমাকে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি ছাড়া আমি কথা বলতে পারি না। তবে গম আমদানির বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা জানতেন।' পচা গম আমদানির বিষয়ে সরকারের অবস্থান জানার জন্য গতকাল দিনভর চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কোনো কর্মকর্তা এ বিষয়ে মুখ খুলছেন না। খাদ্যসচিব মুশফেকা ইকফাৎ সরকারি সফরে দুবাইয়ে থাকায় তাঁর বক্তব্যও পাওয়া যায়নি। গতকাল খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জেনেশুনেই পচা গম খালাস করা হয়েছে। কারণ গমভর্তি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে থাকার সময়ই খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানতে পারেন জাহাজের গম ভালো নয়। বহির্নোঙরে থাকার সময় সিএমএস, খাদ্য আমদানিকারকের ও খাদ্য অধিদপ্তরের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি জাহাজ থেকে স্যাম্পল সংগ্রহ করে। সে সময়ই প্রতিনিধিরা বুঝতে পারেন, এ গম ডাঙায় তোলা হলে তোলপাড় হয়ে যাবে। তাঁদের চোখের সামনেই গমে পোকা ঘুরে বেড়ায়। গম দেখেই তাঁরা বুঝতে পারেন এ গমের আপেক্ষিক ওজন বা পুরুত্ব কম হবে। চট্টগ্রামের গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বহির্নোঙরে পরিদর্শনে যাওয়া সদস্যদের সব অনুমানই সত্য হয়। গমের আপেক্ষিক ওজন হওয়ার কথা ৭৫ কেজি পার হেক্টো লিটার। অর্থাৎ ১০০ লিটার সিলিন্ডারে গম ভর্তি করা হলে সেই গমের ওজন হবে ৭৫ কেজি। তবে ৭৫ কেজি ওজনের নিচে হলেও আমদানি করা গম গ্রহণ করা হয় রপ্তানিকারকের ক্ষতিপূরণ দেওয়া সাপেক্ষে। তবে ওজন ৭২ কেজির নিচে হলে তা আর গ্রহণ করা হয় না। ব্রাজিল থেকে আমদানি করা গমের আপেক্ষিক ওজন ৭২ কেজি দেখানো হলেও এ গমের প্রকৃত ওজন ৭১ দশমিক ৫ কেজি পাওয়া গেছে। খাদ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই ৭১ দশমিক ৫ কেজি ওজন নিয়েও ঘাপলা রয়েছে। সেটাও প্রভাব খাটিয়ে করা হয়েছে। তবে আমদানি করা গমের প্রোটিন ঠিক ছিল। প্রোটিন ঠিক থাকলেও গম কালো হওয়ার কারণে তা কেউ গ্রহণ করবে না। এ ছাড়া গম থেকে আটার পরিমাণও কম হবে। এই অবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দর থেকেই সেই গম ফিরিয়ে দেওয়ার পক্ষে ছিলেন অনেকে। কিন্তু প্রভাবশালীদের চাপে শেষ পর্যন্ত গম গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। গম গ্রহণ করা হবে কি না সেই সিদ্ধান্ত ঢাকার খাদ্য অধিদপ্তরে নেওয়া হলেও খাদ্য মন্ত্রণালয়ও এ বিষয়ে অবগত ছিল। এই গম নিয়ে হইচই হতে পারে জানার পরও খাদ্য অধিদপ্তর কেন গম খালাসের ঝুঁকিতে গেল জানতে চাইলে অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, কোনো উপায় ছিল না। আমদানি করা এসব গম দিয়ে সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালনা করা হয়। সরকার সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, বিজিবি, পুলিশ, আনসার, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য সংস্থার সদস্যদের মধ্যে রেশন হিসেবে যে আটা সরবরাহ করে তা অভ্যন্তরীণ ও বিদেশ থেকে সংগ্রহ করা গম থেকে প্রস্তুত করা হয়। এসব গম দিয়ে টিআর-কাবিখার প্রকল্পও চালানো হয়। এসব কর্মসূচি পরিচালনার জন্য মাসে এক লাখ টন গম প্রয়োজন হয়। গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সরকারের গমের মজুদ তলানিতে নেমে যায়। এ কারণে নীতিনির্ধারকরা বাধ্য হয়ে গম খালাসের পক্ষে অবস্থান নেন। সেই গম খালাসের পর আটা করার জন্য মিল মালিকদের কাছে পাঠানো হয়। সেই আটা প্রথমে পুলিশকে সরবরাহ করা হয়। তখন পচা গমের বিষয়টি নিয়ে পুলিশ সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে নালিশ করে। বিষয়টি খুব স্পর্শকাতর বলে জানান তিনি। কারণ এসব গম সশস্ত্র বাহিনীতে রেশন হিসেবে ব্যবহার করার কথা। পুলিশ মেনে নিলেও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন। এ কারণেই দোষীদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। একজন মিল মালিক বলেন, '১০০ টন গম থেকে সাধারণত ৭৫ টন আটা হয়। কিন্তু ব্রাজিল থেকে আনা ওই গম থেকে আটা হচ্ছে ৭০ টন। তাহলে বাকি পাঁচ টন আটা আমি কোথায় পাব? এই গমে ভূষির পরিমাণ অনেক বেশি হচ্ছে। আটা দেখতেও ভালো নয়, দুর্গন্ধও ছড়ায়।' আমদানি-প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত একজন কর্মকর্তা বলেন, পুরো বিষয়টি ঘটেছে অদক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্য। কারণ ইউক্রেন থেকে সরকারিভাবে গম আনার কথা ছিল। কিন্তু বিষয়টি জটিল করে ফেলে সংশ্লিষ্টরা। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি সিন্ডিকেটের কারণে। সময়ক্ষেপণ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত যখন ইউক্রেন থেকে সরকারিভাবে গম না পাওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হলো, তখন আন্তর্জাতিক টেন্ডারে যাওয়া হয়। ৪০০ কোটি টাকা দামের দুই লাখ টন গম আমদানির কার্যাদেশ পায় ইমপেক্স ইন্টারন্যাশনাল এবং ওলাম ইন্টারন্যাশনাল নামের দুটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ইমপেক্স দেড় লাখ এবং ওলাম ইন্টারন্যাশনাল পায় ৫০ হাজার টন গম সরবরাহের দায়িত্ব পায়। ইমপেক্স ইন্টারন্যাশনাল নেদারল্যান্ডসের একটি কম্পানির উপমহাদেশীয় এজেন্ট। খাদ্য অধিদপ্তরের গম আমদানি-প্রক্রিয়ায় ইমপেক্ষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গম সংগ্রহের জন্য গত নভেম্বরে প্রথম দফায় টেন্ডার আহ্বান করা হয়। কার্যাদেশ পাওয়া একটি কম্পানি কিছু গম ইউক্রেন থেকে সংগ্রহ করে। কিন্তু ইউক্রেন থেকে গম বোঝাই করে জাহাজ যখন তুরস্কে পৌঁছে তখন আইনি জটিলতায় পড়ে যায়। জাহাজটিকে আটক করে তুরস্ক সরকার। অগত্যা ব্রাজিলের দিকে হাত বাড়ায় ওই কম্পানি। ব্রাজিলে গত মৌসুমে অতিবৃষ্টি হওয়ার কারণে গম কালো হয়ে যায়। তবে দেশটিতে ভালো গমও আছে। সেই গম না এনে খাওয়ার অনুপযুক্ত গম বাংলাদেশে আনা হয়। ব্রাজিল থেকে যে ধরনের গম এসেছে তা বাংলাদেশে আগে কখনো আসেনি। গম আমদানির অনুমতি পাওয়া কম্পানি দুটির আঞ্চলিক অফিস দেশের বাইরে হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে তাদের কোনো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। কালের কণ্ঠ'র সংশ্লিষ্ট জেলা প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, এরই মধ্যে খাগড়াছড়ি থেকে ১১ প্যাকেট, বান্দরবান থেকে চার প্যাকেট, ঝিনাইদহ থেকে ছয় প্যাকেট, নীলফামারী ও লালমনিরহাট থেকে দুই প্যাকেট করে এবং সিরাজগঞ্জ থেকে পাঁচ প্যাকেট গম সচিবালয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া ময়মনসিংহ, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর ও জয়পুরহাট থেকেও গমের নমুনা পাঠানো হয়েছে।
No comments:
Post a Comment