খোলা ও বোতলজাত সয়াবিন তেলের লিটার কত দাম হওয়া উচিত, তা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন বাজার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে সম্প্রতি এই ভোজ্যতেলের যে মূল্য উল্লেখ করেছিল, সেটিকে তারা নিজেরাই গতকাল বুধবার ‘ভুল’ বলে দাবি করেছে। ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান তাঁর কার্যালয়ে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সাংবাদিকদের বলেন, ‘২০১০ সালের ব্যয়কাঠামো (কস্ট শিট) অনুসরণ করে আমরা সয়াবিন ও চিনির
দাম নির্ধারণ করেছি। তবে গত পাঁচ বছরে মিলগুলোর বিদ্যুৎ, গ্যাস, পরিবহন খরচ ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা অনেক বেড়েছে। আমরা কাঠামোটি সময় উপযোগী করার চেষ্টা করছিলাম। তবে বিভিন্ন কারণে সেটি হয়ে ওঠেনি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা চলে, আমাদের নির্ধারণ করা দামটি কিছুটা কনজারভেটিভ হয়ে গেছে।’ মিলগুলোর বিদ্যুৎ, গ্যাস, পরিবহন খরচ ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতার বর্ধিত ব্যয় যোগ করলে কমিশনের নির্ধারিত সয়াবিনের দামের চেয়ে কত বাড়তে পারে—জানতে চাইলে চেয়ারম্যান এ সময় বলেন, ২, ৪ থেকে ৫ শতাংশ বাড়তে পারে। তাঁর এই তথ্য (সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ) আমলে নিলে খুচরা বাজারে খোলা ১ লিটার সয়াবিন তেলের দাম ৭০ টাকা ৪৫ পয়সা এবং পাম অয়েল ৫৯ টাকা ৯৫ পয়সা হওয়ার কথা। আর বোতলজাত সয়াবিন ১ লিটার ৮৬ টাকা ১০ পয়সা ও ৫ লিটারের দাম দাঁড়ায় ৪০৫ টাকা ৩০ পয়সা। কমিশনের চেয়ারম্যানের বক্তব্যের প্রায় এক ঘণ্টা পর কারওয়ান বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ৮০ টাকা কেজি দরে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে। সেই হিসাবে ১ লিটারের দাম পড়ে ৭৬ টাকা (১ লিটার = ৯৫০ গ্রাম)। আর পাম তেল ৬৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। তাহলে লিটার দাঁড়াচ্ছে ৬১ টাকা ৭৫ পয়সা। তার মানে খোলা সয়াবিন ও পাম তেল কিনতে প্রতি লিটারে যথাক্রমে সাড়ে ৫ টাকা ও ৫ টাকা বেশি দিচ্ছেন ক্রেতারা। কারওয়ান বাজারে তীর, রূপচাঁদা ও ফ্রেশ ব্র্যান্ডের ১ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৯৫ থেকে ১০০ টাকায়। আর এসব ব্র্যান্ডের ৫ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৪৬০ থেকে ৪৭৫ টাকায়। কমিশনের চেয়ারম্যানের ওই তথ্য আমলে নিলে বোতলজাত ১ লিটার সয়াবিনে ভোক্তারা বেশি দিচ্ছেন যথাক্রমে ৯ থেকে ১৪ টাকা। আর ৫ লিটার সয়াবিন কিনতে গেলে বেশি দিতে হচ্ছে ৫৫ থেকে ৭০ টাকা। এদিকে, ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যানের ওই বক্তব্যের সময় ভোজ্যতেল পরিশোধন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান সিটি, টিকে, মেঘনা ও এস আলম গ্রুপের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের দাবি, বর্তমানে বাজারে যে দামে সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে, সেটিই ঠিক আছে। ট্যারিফ কমিশন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত আমদানি করা অপরিশোধিত সয়াবিনের ফ্রেইট অন বোর্ড (এফওবি) মূল্য ধরে হিসাবটি করেছে। প্রকৃতপক্ষে সিএফআর ভ্যালুটি ধরতে হবে। কারণ, এর সঙ্গে জাহাজ ভাড়া যুক্ত থাকে। প্রতি টনে ৬০ মার্কিন ডলার জাহাজ ভাড়া লাগে। এ ছাড়া মূল্য সংযোজন কর (মূসক) যোগ করতে হবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সব সময়েই তারা ট্যারিফ কমিশনকে সিএফআর মূল্য সরবরাহ করে থাকে। প্রতিষ্ঠানগুলোর এই দাবি ধরলে ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যানের যুক্তি টেকে না। আর কমিশনের কার্যালয়ে উপস্থিত বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনারস অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সচিব নুরুল ইসলাম মোল্লা সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের হিসাবে খোলা সয়াবিনের মিলগেটের মূল্য এখন ৭১-৭২ টাকা। এই তেল ডিলার, পাইকার ও খুচরা বিক্রেতার হার ঘুরে ক্রেতার কাছে পৌঁছায়। এ ক্ষেত্রে তাদের মুনাফা দিতে হয় ৮-১০ টাকা।’ এই হিসাব ধরলে খোলা সয়াবিনের মূল্য দাঁড়ানোর কথা ৮০ টাকার ওপরে। তবে খুচরা বাজারে এখন বিক্রি হচ্ছে ৭৬ টাকায়। আবার কমিশনের চেয়ারম্যানের কথার সূত্র ধরে জানতে চাইলে সেখানে উপস্থিত এস আলম গ্রুপের জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক কাজী সালাউদ্দিন আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত পাঁচ বছরের বিদ্যুৎ-গ্যাস, পরিবহন খরচ ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির হিসাব করলে ট্যারিফ কমিশনের চেয়ে সর্বোচ্চ ১-২ শতাংশ দাম বাড়ার কথা।’ তিনি বলেন, এখন প্রতিযোগিতার বাজার। কেউ ইচ্ছা করলেই বেশি দামে বিক্রি করতে পারবে না। তাই বর্তমানের দাম নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ নেই। গত মঙ্গলবার প্রথম আলোতে ‘বেশি দামেই বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন তেল’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে ট্যারিফ কমিশনের একটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলা হয়, ১ লিটার সয়াবিন তেলের উৎপাদন খরচ ৬৩ টাকা ১০ পয়সা। এর সঙ্গে প্লাস্টিকের বোতলের দাম ১৫ এবং পরিবেশক ও খুচরা ব্যবসায়ীর ৪ টাকা মুনাফা যোগ করলে হয় ৮২ টাকা। আর বোতলজাত ৫ লিটারের দাম আসে ৩৮৬ টাকা। এর সঙ্গে প্লাস্টিকের বোতলের মূল্য ৫০ টাকা, পরিবেশক ও খুচরা ব্যবসায়ীর ১০ টাকা করে ২০ টাকা মুনাফা ধরা আছে। এ বিষয়ে ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান বলেন, এই প্রতিবেদনটি গোপনীয় দলিল। এটি আন্তর্জাতিক দরের সঙ্গে স্থানীয় কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার পরিস্থিতির কী অবস্থা, সেটি সরকারকে জানানোর জন্য করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি জনসম্মুখে প্রকাশ করার জন্য নয়। তা ছাড়া ট্যারিফ কমিশন বাজারদর নিয়ন্ত্রণের কাজ করে না। তিনি জানান, বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন একা নয়, সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সমন্বয়ে প্রতিবেদনটি করা হয়েছে। তাহলে প্রতিবেদনের মাধ্যমে সরকার বিভ্রান্ত হবে কি না, জানতে চাইলে কমিশন চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের বলেন, ‘না। কারণ, আমরা প্রতিবেদনে বলে দিয়েছি, ২০১০ সালের ব্যয় কাঠামো ধরে এটি করা হয়েছে। রোজার পর জাতীয় মূল্য পর্যবেক্ষণ এবং মূল্য নির্ধারণ কমিটির মাধ্যমে ব্যয় কাঠামোটি হালনাগাদ করা হবে।’ তিনি জানান, ‘রোজায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারদর নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কারণ পর্যাপ্ত মজুত আছে।’ সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ব্যয় কাঠামোটি পরিবর্তন না করলে প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে না। তা ছাড়া ট্যারিফ কমিশন খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের মুনাফাও কম ধরছে। সবই পরিবর্তন করতে হবে। তিনি বলেন, সিটি গ্রুপের তীর ব্র্যান্ডের ১ লিটার সয়াবিন তেলের বোতল মিলগেটে ৮৮ ও ৫ লিটার ৪৪০ টাকায় বিক্রি করা হয়। আর খুচরা মূল্য ১ লিটারে ৯৪ ও ৫ লিটারে ৪৬০ টাকা। অর্থাৎ ডিলার, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের জন্য মুনাফা যথাক্রমে ৬ ও ২০ টাকা। এ ক্ষেত্রে ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, কমিশন কেবল ১ লিটারে ২ টাকা কম মুনাফা হিসাব করেছে। কমিশনের চেয়ারম্যানের কার্যালয়ের বাইরে বেশ কিছুক্ষণ সিটি, টিকে, মেঘনা ও এস আলম গ্রুপের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা জানান, এক লিটার সয়াবিনের প্লাস্টিকের বোতল তৈরিতে ১৫ টাকা ও ৫ লিটারের বোতলের খরচ ৫০ টাকার বেশি। কমিশনের প্রতিবেদনেও একই তথ্য দেওয়া হয়েছে। তবে আজিজুর রহমান বলেন, বোতলের দাম নিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে দর-কষাকষি হচ্ছে। কারওয়ান বাজারে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বোতলজাত ৫ লিটার পানির পাইকারি দর হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৫ টাকা। এ ক্ষেত্রে সয়াবিন তেল ব্যবসায়ী ও কমিশনের হিসাব আমলে নিলে প্রশ্ন ওঠে, বোতলের দাম ৫০ টাকা, তাহলে পানির কি কোনো দাম নেই? এদিকে, ভোজ্যতেলের ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে এখন ভোজ্যতেলের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও দর আগের তুলনায় অনেক কম। ফলে এবারের রোজার মাসে দাম আর বাড়বে না। ক্রেতারা স্বস্তিতেই থাকবেন।
No comments:
Post a Comment