অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়ীদের কোনো শাস্তি হয় না। নিষ্পত্তি হয়নি তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা একটি মামলাও। কর্তৃপক্ষের চরম অসহযোগিতায় বছরের পর বছর অনিষ্পন্ন থাকছে এসব মামলা। জামিন নিয়ে আসামিরা নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে এই অবৈধ ব্যবসা। ফলে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। এই ব্যবসার নেপথ্যে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায়ের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতাসহ সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত থাকায় ম
ামলাগুলো গতিহীন হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। ঢাকা মহানগরের ৪৯টি নিু আদালতে বিচারাধীন ১৯৮টি ভিওআইপি মামলার নথিপত্র বিশ্লেষণ এবং বিচার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে উল্লেখিত সব তথ্য। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত আট বছরে ঢাকা মহানগরীতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ১৯৮টি মামলা করে। উল্লেখিত মামলার মধ্যে প্রায় সাত বছর ধরে চলছে ১৯টি মামলার তদন্ত কাজ। এক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশ অমান্য করে চলেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। এছাড়া ৪০টি মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা হওয়ার পরও আইনি জটিলতায় বন্ধ রয়েছে বিচার কাজ। কারণ বিদ্যমান আইন অনুযায়ী অভিযোগপত্রে বিটিআরসির অনুমোদন থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু পুলিশ সেটি করেনি। টেলিযোগাযোগ আইন অনুযায়ী, ভিওআইপি মামলা পরিচালনার জন্য নিজস্ব আইনজীবী নিয়োগ দেয়ার বিধান রয়েছে কর্তৃপক্ষের। কিন্তু সেটি করা হয়নি। এমনকি এসব মামলার বিষয়ে তেমন কোনো খোঁজ খবরও রাখেন না সংশ্লিষ্টরা। আর ৯৩টি মামলায় ১ হাজার ৩৯৫ সাক্ষীর কাউকেই আদালতে হাজির করতে পারেনি পুলিশ বিভাগ। যদিও আদালত উল্লেখিত সাক্ষীর বিরুদ্ধে অজামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। এছাড়া ৪৬টি ভিওআইপি মামলা তদন্তাধীন। এ মামলাগুলো পুলিশ তদন্ত করছে। কয়েক বছর ধরে এসব মামলায় তদন্ত রিপোর্ট জমা দিচ্ছে না পুলিশ বিভাগ। বিচারাধীন মামলার ৯৩০ আসামি জামিনে আছেন। জানতে চাইলে বিটিআরসির পরিচালক (লিগ্যাল) তারেক সিদ্দিকী মঙ্গলবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘এটা সত্য কথা যে, বিটিআরসি অনেকগুলো মামলার তদন্ত রিপোর্ট আদালতে জমা দিতে পারেনি। যদিও আদালত একাধিকবার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে আদালতে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। বাস্তবতা হল, আমাদের প্রতিষ্ঠানে তদন্ত কর্মকর্তার সংখ্যা হাতেগোনা। যে কারণে সময়মতো তদন্ত রিপোর্ট আদালতে জমা দেয়া সম্ভব হয়নি। তবে শিগগিরই এসব রিপোর্ট আদালতে জমা দেয়া হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যেসব আসামি জামিন পেয়েছেন তাদের খোঁজ-খবর আমরা রাখছি। সাক্ষীদের হাজির করার ব্যাপারে আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব। যাতে করে মামলা নিষ্পত্তি হয়। এক প্রশ্নের উত্তরে তারেক সিদ্দিকী বলেন, আইনে বাধ্যবাধকতা থাকলেও পুলিশ আমাদের কাছ থেকে অনুমোদন না নিয়ে তদন্ত রিপোর্ট আদালতে জমা দিয়ে গুরুতর অন্যায় করছে।’ ঢাকার মহানগর পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোঃ আনিসুর রহমান মঙ্গলবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘মামলার কাগজপত্র না দেখে এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। তবে বিষয়টি খতিয়ে দেখব।’ বিচারাধীন মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০০৭ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে গুলশান থানার ১২টিসহ সর্বমোট ১৯টি মামলা করে কর্তৃপক্ষ। আদালত বারবার তদন্ত কর্মকর্তাদের ভর্ৎসনা করলেও তারা আদালতে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়নি। যে কারণে বছরের পর বছর মামলার বিচার বন্ধ। অন্যদিকে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা বাদী হয়ে যেসব ভিওআইপির মামলা করে, সেসব মামলার কোনো খোঁজ-খবর নেয় না কর্তৃপক্ষ। এমনকি ঢাকার আদালতে বিচারাধীন ভিওআইপি মামলাগুলোর কোনো কাগজপত্রও তাদের কাছে নেই। মামলার সাক্ষীদের আদালতে আনতে কর্তৃপক্ষ কোনো ভূমিকাই রাখে না। তাদের চরম উদাসীনতার কারণে মামলার বিচারকাজ কার্যত বন্ধ রয়েছে। নথি পর্যালোচনায় আরও জানা যায়, গুলশান থানার মামলা নম্বর ১০৩(৯)০৮। মামলার আসামিরা হলেন- সফটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াউদ্দিন ফারুকসহ তিনজন। ২০০৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বাড়ি নম্বর-২২, রোড নম্বর-২৩, ব্লক-বি, বনানী এর ফ্ল্যাট ডি-১ থেকে বিপুল পরিমাণ ভিওআইপি সরঞ্জামাদি জব্দ করে বিটিআরসি। মামলার বাদী হলেন বিটিআরসির সহকারী পরিচালক জিয়ান শাহ কবির। তদন্ত কর্মকর্তা হলেন বিটিআরসির প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোঃ কাউছার আহমেদ। গত ছয় বছরেও তিনি আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেননি। একইভাবে গুলশান থানার ৬৭(১১)০৮ নম্বর মামলার আসামিরা হলেন ব্রডব্যান্ড সলিউশনের স্বত্বাধিকারী এসএম আমিনুল ইসলামসহ (৩৫) তিনজন। তদন্ত কর্মকর্তা হলেন বিটিআরসির প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোঃ কাউছার আহমেদ। তিনিও গত ছয় বছরে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেননি। টেলিযোগাযোগ আইনে বলা হয়েছে, বিটিআরসি মামলা পরিচালনার জন্য নিজস্ব প্যানেল আইনজীবী নিয়োগ করবে। অথচ বিটিআরসির কোনো আইনজীবী এসব মামলা পরিচালনা করেন না। এ ব্যাপারে ঢাকার স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর রফিকউদ্দিন বাচ্চু যুগান্তরকে বলেন, ‘বিটিআরসির কোনো আইনজীবী ভিওআইপির মামলা পরিচালনা করেন না। করলে এসব মামলার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি হতো।’ বিচারাধীন মামলা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১৯৮টি মামলার মধ্যে ৯৩টি মামলায় ১ হাজার ৩৯৫ সাক্ষীর কাউকে আদালতে হাজির করতে পারেনি প্রসিকিউশন তথা পুলিশ বিভাগ। যদিও আদালত প্রত্যেক সাক্ষীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। সাক্ষী না আসার কারণে বিগত ৮ বছরে একটি মামলাও নিষ্পত্তি হয়নি। নথিপত্র পর্যালোচনায় জানা যায়, মিরপুর থানার ৬৮(৬)২০০৮ নম্বর ভিওআইপি মামলাটি ঢাকার বিশেষ জজ-৩ আদালতে বিচারাধীন। এ আদালতে মামলা নম্বর হল ৬৬/০৯। মামলার প্রধান আসামি হলেন জাহিদুল ইসলাম জাহিদ ও মোস্তাফিজুর রহমান। ২০০৮ সালের ২৩ জুন মিরপুরের বড়বাগ এলাকার ২ নম্বর রোডের, সেকশন-২ এর ৬/২৩ নম্বর বাসার চতুর্থ তলা থেকে বিপুল পরিমাণ ভিওআইপি ব্যবসায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি জব্দ করে র্যাব। মামলার বাদী হলেন র্যাব-৪ এর ডিএডি মোশারফ হোসেন। এই দুই আসামির বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। আদালত মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে একাধিকবার গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। অপরদিকে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন দায়রা ৪২৩৯/১০ নম্বর ভিওআইপি মামলার আসামিরা হলেন, রাশেদ আলম, মোঃ আবদুর রহিম রাজ, মোঃ সাইফুল্লাহ ও মোঃ মামুন। ২০০৯ সালের ১৭ মে মোহাম্মদপুরের চানমিয়া হাউজিং এর ৪১/৭ নম্বর বাসা থেকে আসামিদের ভিওআইপি সরঞ্জামাদিসহ গ্রেফতার করে র্যাব। মামলার বাদী হলেন র্যাব-২ এর উপ-পরিদর্শক গাজী শামীমুর রহমান। গত তিন বছর ধরে তার বিরুদ্ধে আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। আদালতে কেন আসেন না এ বিষয়ে গাজী শামীমুর মঙ্গলবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘আদালতের কোনো পরোয়ানা আমি পাইনি। বর্তমানে আমি বরিশালের বাবুগঞ্জ থানার এসআই হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আদালতের পরোয়ানা পেলে অবশ্যই আদালতে আসব।’ পরোয়ানা প্রসঙ্গে ওই আদালতের পেশকার সাইদুর যুগান্তরকে বলেন, ‘পরোয়ানা পাঠিয়েছি। কেন পাননি তা বলতে পারব না।’ বিটিআরসির অনুমোদনহীন অভিযোগপত্র : ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের দায়রা ৯৯৮৭/১০ মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা করে জানা গেছে, ২০১২ সালের ২৮ এপ্রিল আদাবর থানাধীন মনসুরাবাদ আবাসিক এলাকার দুই নম্বর রোডের ১০ নম্বর বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ ভিওআইপি সরঞ্জামাদিসহ গ্রেফতার হন তরিকুল ইসলাম তারিক। মামলাটি তদন্ত করেন ডিবির পরিদর্শক মাহাবুবুর রহমান তরফদার। বিটিআরসির অনুমোদন না নিয়েই ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসেই আদালতে অভিযোগপত্র দেন তিনি। অথচ বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ (সংশোধন) আইন, ২০১০-এর ৭৮-এর ৯ উপ-ধারায় বলা হয়েছে, ভিওআইপি মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয়ার আগে তদন্ত কর্মকর্তাকে বিটিআরসির অনুমোদন নিতে হবে। উল্লেখিত মামলাটি বিচারের জন্য ওই বছরেই ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠান ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত। পরবর্তীতে মহানগর দায়রা জজ মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকার বিশেষ জজ-১ আদালতে পাঠান। বিটিআরসির অনুমোদন না নিয়ে অভিযোগপত্র জমা দেয়ায় ২২ ফেব্র“য়ারি বিচারক দলিল উদ্দিন মহানগর দায়রা আদালতে আবার ফেরত পাঠান। বর্তমানে মামলাটি সেখানেই পড়ে আছে। এ মামলাটির মতো বিটিআরসির অনুমোদন ছাড়া ৪০টি মামলার বিচার কাজ বন্ধ রয়েছে। মহানগর হাকিম আদালতে বিচার হয় না : বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইনের ৭৬-এর ২ ধারায় বলা হয়েছে, ভিওআইপি মামলার বিচার করবেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ও প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট। বিচারিক আদালত সুনির্দিষ্ট করা হলেও ভিওআইপির ৯৩টি মামলা বিচারের জন্য ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। এ বিষয়ে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের পেশকার কাজী নূর আলম যুগান্তরকে বলেন, ‘মুখ্য মহানগর হাকিম এসব মামলা বিচারের জন্য মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠিয়েছিলেন। পরবর্তীতে মামলাগুলো বিভিন্ন বিচারিক আদালতে পাঠানো হয়। টেলিযোগাযোগ আইন সংশোধন হওয়ায় মহানগর দায়রা জজ এসব মামলা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে ফেরত পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন।’ অনুসন্ধানে জানা গেছে, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার সঙ্গে পর্দার আড়ালে ক্ষমতাসীন দলের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। ফলে বিচারাধীন মামলার তদন্ত কাজ নানাভাবে প্রভাবিত হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র অভিযোগ করেছেন। ৩০ জুন মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায় কার কার আত্মীয় জড়িত তা তিনি জানেন। এ সম্পর্কে তার কাছে তথ্য রয়েছে। তিনি অবৈধ এ কর্মকাণ্ড বন্ধে টেলিযোগাযোগমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে নির্দেশ দেন।
No comments:
Post a Comment