ভূমি অধিগ্রহণের পর দীর্ঘ সময় পার হলেও ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি পদ্মা নদীর দুই পাড়ের হাজার হাজার মানুষ। তারা এখন ক্ষোভে ফুঁসছেন। বাড়ি-ঘর হারিয়ে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশায় বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দিচ্ছেন তারা। এর বাইরে বসতভিটা হারানো আরও দুই হাজার পরিবার এখনও প্লট বরাদ্দ পাননি। তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন ধরে তাদের প্লট বুঝিয়ে দেয়া হয়নি। অনেকেই জমি ও বসতভিটা হারালেও প্লট পাচ্ছেন না। এদিকে আবার আরেক চিত্
র। পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার লোভে অনেকে বাড়ি-ঘর হারানোর অসত্য তথ্য দিয়ে ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদন করেছেন। বিভিন্নভাবে দেন-দরবারও করছেন তারা। তাদের প্রতারণার কারণে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রদান ও প্লট বরাদ্দে কালক্ষেপণ হচ্ছে। আবার যারা প্লট পেয়েছেন তারাও সুখে নেই। পুনর্বাসন বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন থাকা সত্ত্বেও মাসের পর মাস ধরে সংযোগ না পেয়ে অন্ধকারে মানবেতর জীবনযাপন করছেন পাঁচ শতাধিক বাসিন্দা। আজ হবে কাল হবে বলে এসব পরিবারকে এখনও বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়নি। তাদের বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই সেতু কর্তৃপক্ষের। এসব কারণে পদ্মাপাড়ের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে অভিযোগ ও ক্ষোভের অন্ত নেই। মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মাওয়া, শরীয়তপুরের জাজিরা ও মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ক্ষতিপূরণ না পাওয়া মানুষের মাঝে ক্ষোভ থাকার বিষয়টি স্বীকার করে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে যাদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে তারা ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদন করতে পারেন। ইতিমধ্যে অনেকেই এ ধরনের আবেদন করেছেন। আমরা ওই সব আবেদন খতিয়ে দেখছি। তিনি বলেন, জমি অধিগ্রহণের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে নগদ টাকা ও প্লট বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। শিগগিরই সবাইকে ক্ষতিপূরণ দেয়া শেষ হবে। এলাকাবাসীর সঙ্গে আলাপ করে এবং সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতুর জন্য ২ হাজার ৩০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে মুন্সীগঞ্জে ৬৭১ একর, শরীয়তপুরে ১ হাজার ১৭০ একর ও মাদারীপুরে ৯৫৬ একর জমি রয়েছে। জমি অধিগ্রহণের ফলে কয়েক হাজার মানুষ জমি ও বাড়িঘর হারিয়েছেন। এদের মধ্যে প্রায় ১৩ হাজার ৭০০ জনকে তালিকাভুক্ত করে ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে সেতু কর্তৃপক্ষ। ইতিমধ্যে ১০ হাজার ৮০০ জন প্রথম পর্যায়ের ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এসব ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে। ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য তিন জেলায় ৯৮০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা বাজেট ধরা হয়েছে। ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে ৮১৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এর বাইরে জমি ও স্থাপনার বর্তমান বাজার দর হিসেবে ৪২৩ কোটি ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে। তবে এলাকাবাসীর অভিযোগ, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি। বিভিন্ন স্তরে কারসাজির মাধ্যমে অন্তত সাত হাজার মানুষকে ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। অপরদিকে জমি অধিগ্রহণের কারণে যারা জমি ও ভিটাবাড়ি হারিয়েছেন এমন পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করা হচ্ছে। প্রথমে সবাইকে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা থেকে পিছিয়ে এসেছে সেতু কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে প্রায় ২ হাজার ৫০০ পরিবারকে পুনর্বাসনের কার্যক্রম চলছে। পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্লট বরাদ্দের জন্য ৪ হাজার ৭০০টি আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। তবে জমি অধিগ্রহণে জমি ও বসতভিটা হারিয়েছেন এমন দাবি করে প্লট বরাদ্দ চেয়ে আবেদনকারীর সংখ্যা অনেক গুণ বেশি। যেসব আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে তারা সবাই প্লট পাচ্ছেন না। আবেদনপত্রের মধ্যে সেতু কর্তৃপক্ষ আড়াই হাজার পরিবারকে প্লট দেয়ার কার্যক্রম চালাচ্ছে। ফলে বাকি আবেদনকারীরা প্লট পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বঞ্চিতদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। সূত্র আরও জানিয়েছে, মাওয়ায় দুটি, শিবচরে একটি ও জাজিরায় দুটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে এ পর্যন্ত প্রায় ৮০০ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। গ্রামের মাঝে পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোকে এক মডেল শহর হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। যেখানে নাগরিক সুবিধার্থে স্কুল, মসজিদ, কমিউনিটি সেন্টার, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, জমি অধিগ্রহণে বাড়িঘর হারানো হাজার হাজার মানুষ ক্ষতিপূরণ পেতে বিভিন্ন দফতরে ছোটাছুটি করছেন। সম্প্রতি মাদারীপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে প্রায় দেড় হাজার ক্ষতিপূরণ প্রত্যাশীকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না মর্মে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে তাদের ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কাছে আপিল আবেদন করতে বলা হয়েছে। ক্ষতিপূরণ পেতে এসব মানুষ ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে আপিল করেছেন। সেখানে শুনানি হয়েছে। ক্ষতিপূরণ পেতে তারা ঢাকা-মাদারীপুর ছোটাছুটি করছেন। শিবচর উপজেলার হাজী শুক্কুর হাওলাদার কান্দির সেলিম হাওলাদার জানান, চরজানাজাত মৌজার ৬৬৯ দাগের ১০ কাঠা জমি ভাড়া নিয়ে সেখানে বসতভিটা নির্মাণ করে পরিবারসহ ১৮ বছর ধরে বসবাস করছেন। এ পর্যন্ত তিনি কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি। এমনকি ক্ষতিপূরণ পাবেন, এমন কোনো আশ্বাসও পাননি। তিনি বলেন, অনেক দিন ডিসি অফিসে দৌড়াদৌড়ি করেছি। এখন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার অফিসে শুনানি করে এসেছি। একই অভিযোগ করেছেন ৭৪৭ খতিয়ানের ২২৭ দাগের বাসিন্দা রফিক হাওলাদার। তিনি বলেন, ৪ কাঠা জমিতে বসতবাড়ি করে ২০ বছর ধরে বসবাস করলেও সরকার তরফে কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি। ক্ষতিপূরণ পেতে মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ও ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কাছে আবেদন করেও কোনো লাভ হয়নি। উত্তর বাখরের কান্দি গ্রামের বাসিন্দা আবদুল কাদির মোড়ল অভিযোগ করেছেন, তিনি জমির ক্ষতিপূরণ পেলেও বাড়িঘর ও মুরগি ফার্মের ক্ষতিপূরণ পাননি। এদিকে প্রতিশ্র“তি পেয়েও প্লট বুঝে পাচ্ছেন না দেড় হাজারের বেশি মানুষ। পদ্মার দুই পাড়ে ৫টি পুনর্বাসন কেন্দ্রে প্রায় আড়াই হাজার প্লট তৈরি করা হয়েছে। প্রায় ৭০০ পরিবারকে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। নানান জটিলতার কারণে বাকি প্লট ক্ষতিগ্রস্তদের বরাদ্দ দেয়া হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, মাদারীপুরের শিবচরে একমাত্র পুনর্বাসন কেন্দ্র বাখেরের কান্দি পুনর্বাসন কেন্দ্রে প্লটের সংখ্যা ৫৪৪টি। এ পুনর্বাসন কেন্দ্রে প্লটের জন্য ২ হাজার ৪৪৬ জন আবেদন করেছিলেন। প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন ১৪৯ পরিবার। লৌহজং উপজেলায় দুটি পুনর্বাসন কন্দ্রে ৭৫১টি প্লট রয়েছে। বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৩৪৭টি। শরীয়তপুরের জাজিরায় দুটি পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে নাওডোবা পুনর্বাসন কেন্দ্রে মোট ৫২৪টি প্লটের মধ্যে ১৭২ জনকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। মাঝিরঘাট পুনর্বাসন কেন্দ্রের ৪৯৭টি প্লটের মধ্যে ৮টি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্লট বরাদ্দ পাওয়ার আশায় শত শত মানুষ ধরনা দিচ্ছেন। এ সুযোগে প্লট পাইয়ে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে স্থানীয় একটি মহল ক্ষতিগ্রস্তদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এদিকে প্লট পেয়ে স্বস্তি প্রকাশ করলেও সুখে নেই পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দারা। মডেল টাউনে অন্ধকারে বাস করছেন তারা। বাসিন্দারা জানান, আশপাশে সর্বত্র বিদ্যুৎ থাকলেও তারা থাকেন অন্ধকারে। তারা আরও বলেন, আবাসন প্রকল্পে বিদ্যুৎ সরবরাহের কাজ শেষ। কিন্তু কেউই বিদ্যুৎ সংযোগ পাননি। বিদ্যুতের জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করে এবং সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়নি। এতে স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের হেরিকেন ও মোমবাতির আলোতে পড়াশোনা করতে হয়। সরেজমিন শিবচরের বাখেরকান্দি, কুমারভোগ ও জসলদিয়া পুনর্বাসন কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, পরিকল্পিত শহরের আদলে গড়ে তোলা হয়েছে পুনর্বাসন কেন্দ্র। সেখানে নতুন টিনশেড ও বাহারি নকশার বিল্ডিং গড়ে উঠছে। পুনর্বাসন কেন্দ্রে বিদ্যুতের লাইনও আছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের কর্মকর্তাদের অফিসে বিদ্যুৎ, এসি ও ফ্যান সবই চলছে। ওই অফিসের পাশেই বসবাসকারীরা অন্ধকারে বসবাস করছেন। বাখেরকান্দি পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দা রমিজ উদ্দিন বলেন, সাত মাস ধরে এই পুনর্বাসন কেন্দ্রে অন্ধকারের মধ্যে বসবাস করছি। দেখা হলেই সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা আজ, কাল সংযোগ দেয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু মাসের পর মাস গেল, বিদ্যুৎ পাইনি। ওই পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দা পাচ্চর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী বিথী আক্তার বলেন, বিদ্যুতের আলোতে ছোট থেকে বড় হয়েছেন। কিন্তু পুনর্বাসন কেন্দ্রে আসার পর থেকে অন্ধকারে লেখাপড়া করতে হচ্ছে। এতে পরীক্ষায় খারাপ ফল করার আশংকা প্রকাশ করেন তিনি। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, বিদ্যুৎ না থাকায় বাসায় ফ্যান, টিভি ও ফ্রিজ ব্যবহার করতে পারছেন না। এতে প্রচণ্ড গরমে নারী ও শিশুরা বেশি কষ্ট পাচ্ছেন। বাধ্য হয়ে অনেকেই আÍীয়স্বজনের বাসায় অবস্থান করেছেন। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, পল্লী বিদ্যুৎ বোর্ড পুনর্বাসন কেন্দ্রে বাড়িতে বাড়িতে সংযোগ দেয়ার কথা রয়েছে। পল্লী বিদ্যুতের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ও আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন না করায় পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দারা বিদ্যুৎ সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন।
No comments:
Post a Comment