Thursday, August 21, 2014

বাড়ছে দুর্ভোগ, ত্রাণ অপ্রতুল:প্রথম অালো

টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। অবনতি হয়েছে বন্যা পরিস্থিতির। শুরু হয়েছে নদীভাঙন। এতে বেড়েছে লাখ লাখ মানুষের দুর্ভোগ। কিন্তু সে অনুযায়ী এসব লোকজনের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ত্রাণ বিতরণের নেই তেমন কোনো উদ্যোগ। খাবার, পানি ও প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের অভাবে কষ্টে দিন কাটাচ্ছে বহু অসহায় মানুষ। এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে গতকাল বুধবার স
কালে বাসস জানায়, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের বিভিন্ন স্থানে ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে। রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, বরিশাল, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। খবরে আরও বলা হয়, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ৮৩টি পানি পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের ৪৯টি স্থানে পানি বেড়েছে। কমেছে ২৯টি স্থানে। সকাল ছয়টায় গাইবান্ধায় ঘাঘট নদ বিপৎসীমার ২৬ সেন্টিমিটার, বাহাদুরাবাদে যমুনা ৩৪ সেন্টিমিটার, সারিয়াকান্দিতে ৬৭ সেন্টিমিটার ও সিরাজগঞ্জে ১০ সেন্টিমিটার, কানাইঘাটে সুরমা ৪৫ সেন্টিমিটার ও সুনামগঞ্জে ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্রের পানি বেড়ে গতকাল বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। এদিন নদের পানি বিপৎসীমার ১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বৃষ্টি ও উজানের অব্যাহত ঢলে ৪০টি ইউনিয়নের দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে ১৫ হাজার হেক্টর জমির আউশ, আমন ও সবজিখেত। ধরলা, তিস্তা ও দুধকুমার নদের পানিও গতকাল বেড়েছে। বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ শুরু হলেও তা খুবই অপর্যাপ্ত। উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবুল হোসেন বলেন, এ ইউনিয়নের প্রায় ২০ হাজার মানুষ চার দিন ধরে পানিবন্দী। তাঁরা রয়েছেন খাদ্যসংকটে। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত যেটুকু চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে তা উল্লেখ না করার মতো। সিরাজগঞ্জে যমুনা ফুঁসে উঠে গতকাল দুপুরে এর পানি শহররক্ষা বাঁধের হার্ড পয়েন্টে বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। দারুণ হুমকিতে রয়েছে বাঁধটি। নয়টি উপজেলার আরও ২০টি ইউনিয়ন নতুন করে হয়েছে প্লাবিত। এরই মধ্যে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার ২৫টি, কাজীপুরের ৮০টি, শাহজাদপুরের ২০টি, চৌহালীর ৪০টি, তাড়াশের ৪০টিসহ প্রায় চার শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে কয়েক লাখ মানুষ। অথচ ত্রাণ হিসেবে মাত্র ২৮ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। বগুড়ার ধুনট উপজেলায় যমুনা ও বাঙ্গালী নদীর পানি আরও বেড়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় এখানে যমুনার পানি বিপৎসীমার ৬৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছিল। প্লাবিত হয়েছে আরও ১১টি গ্রাম। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে আড়াই হাজার পরিবার। অনেকেই আশ্রয়ের সন্ধানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ছুটলেও সেখানেও তাদের ঠাঁই মেলেনি। দেখা দিয়েছে খাবার ও পানির সংকট। গাইবান্ধায় গতকাল নতুন করে প্লাবিত হয়েছে সুন্দরগঞ্জ ও ফুলছড়ি উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রাম। জেলার বালাসিঘাট থেকে জামালপুরের বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত নৌপথে রেলওয়ের ওয়াগন পারাপার বন্ধ হয়ে গেছে। রেলওয়ের লালমনিরহাট মেরিন বিভাগ সূত্র জানায়, ব্রহ্মপুত্রের প্রবল স্রোতে ওয়াগনবাহী টাগ (ফেরি) বালাসিঘাটে ভিড়তে পারছে না। তাই গত মঙ্গলবার রাত থেকেই ওয়াগন পারাপার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এ পথে উত্তরাঞ্চলের আটটি জেলায় মালামাল পরিবহন বন্ধ আছে। জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার ৩০টি গ্রাম যমুনার পানিতে প্লাবিত হয় পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ। উপজেলায় স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত একটি বাঁধ ভেঙে গেছে। বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও উঁচু রাস্তায় খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেওয়া হাজারো মানুষ অনাহার-অর্ধাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। দুর্গত এলাকায় পৌঁছেনি পর্যাপ্ত ত্রাণ। পশ্চিম বামনা গ্রামের রাশেদা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘এমপি-চেয়ারম্যান-মেম্বর আমাগর কিচ্ছুই খোঁজখবর লয় নাই। রাস্তার মধ্যে না খাইয়া পইড়া আছি। সরকারি লোকজন আয়লেই কি কোনো সাহায্য মেলে? ওইঠাও চেয়ারম্যান-মেম্বার খায়া ফালায়।’ ওদিকে সরিষাবাড়ীতে শুরু হয়েছে যমুনার তীব্র ভাঙন। এতে তারাকান্দি-ভূঞাপুর সড়ক বাঁধ হুমকিতে পড়েছে। বাধানগর এলাকায় সড়ক বাঁধটি দেবে যাওয়ায় যেকোনো সময় তা ধসে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাঁধটি রক্ষা করা না গেলে যমুনা সারকারখানা থেকে উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলায় সড়কপথে সার পরিবহন বন্ধ হয়ে যাবে। পানি প্রবেশ করায় পাঠদান বন্ধ রয়েছে উপজেলার ১০টি বিদ্যালয়ে। গতকাল ২০টি গ্রামের ৬ শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়ে। রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলায় পদ্মার পানি বেড়ে বিপৎসীমা ছুঁইছুঁই করছে। গত ২৪ ঘণ্টায় গোয়ালন্দ পয়েন্টে ১৩ সেন্টিমিটার পানি বাড়ে। পানিতে দৌলতদিয়া ও দেবগ্রাম ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলগুলো তলিয়ে গেছে। নোহারী মণ্ডলপাড়া ও ঢল্লাপাড়া এলাকায় নদীভাঙন দেখা দেওয়ায় অনেক পরিবার নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে চলে যাচ্ছে। নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলার নূরালিপুর গ্রামের ৪৮টি বাড়ি গত দুই দিনে ধনু নদে বিলীন হয়ে গেছে। আরও অর্ধশত বাড়ি রয়েছে ভাঙন হুমকিতে। রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার সাতটি গ্রাম থেকে বন্যার পানি নেমে গেলেও দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। কোলকোন্দ ইউপির চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম জানান, সাউথপাড়া এলাকায় এক দিনের ব্যবধানে ১০টি বাড়ি ও কিছু আবাদি জমি বিলীন হয়ে গেছে। লক্ষ্মীটারি ইউপি চেয়ারম্যান ফয়সাল হাসান বলেন, বাঁধ ভেঙে পানিতে তলিয়ে নষ্ট হওয়ার পথে প্রায় ২০০ একর রোপা আমনখেত। শুরু হয়েছে নদীভাঙনও। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার দুর্গত লোকজনের জন্য দেওয়া হয়েছে সাত মেট্রিক টন চাল ও ১০ হাজার টাকা। নীলফামারীতে গতকাল তিস্তার পানি বিপৎসীমার সামান্য নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও অনেক জমির রোপা আমন তলিয়ে থাকায় নষ্ট হয়ে গেছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে নদীভাঙন। ডিমলা উপজেলার ছোটখাতা গ্রামের কৃষক জয়েন উদ্দিন (৬৫) বলেন, ‘আমার ১৮ বিঘা জমির একটাও আবাদ হবে না। গ্রামে একটা বাঁধ না হওয়ায় প্রতিবছরই শত শত বিঘা আবাদি জমি ও ঘরবাড়ি তিস্তায় বিলীন হচ্ছে।’ {প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন: নিজস্ব প্রতিবেদক, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ ও রংপুর এবং নীলফামারী, গাইবান্ধা, নেত্রকোনা, ধুনট (বগুড়া), সরিষাবাড়ী (জামালপুর), গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী), প্রতিনিধি ও জামালপুর সংবাদদাতা}

No comments:

Post a Comment