নতুন জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসীমুদ্দিন রাহমানীর বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে বিপুল অঙ্কের টাকা লেনদেনের তথ্য পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ ছাড়া শেয়ারবাজারে বর্তমানে তাঁর ছয় কোটি ৩৮ লাখ টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট ডিবি কর্মকর্তারা জানান, ৩০ জন সহযোগীসহ মুফতি জসীমুদ্দিন গত বছরের ১১ আগস্ট বরগুনায় গ্রেপ্তার হন। পরবর্তী সময়ে তদন্তে ব্লগার রাজীব হায়দারকে হত্য
াসহ ধর্মের নামে গোপন জঙ্গি তৎপরতায় তাঁর সংশ্লিষ্টতার তথ্য-প্রমাণ মেলে। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহযোগিতায় অনুসন্ধান করে জসীমুদ্দিনের কয়েকটি ব্যাংক হিসাব ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তথ্য পর্যালোচনা করে বিপুল অঙ্কের অর্থ লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়। পেশায় মসজিদের একজন ইমামের বিপুল অঙ্কের এই লেনদেনকে অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক বলে মনে করছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মো. মনিরুল ইসলাম। মুফতি জসীমুদ্দিন রাহমানী ১৯৯৮ সালের ২৩ জুলাই ৮০ হাজার টাকা জমা করে প্রথম ব্যাংক হিসাব খোলেন আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের বরিশাল শাখায় (সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর-০১০১১২০৯১৮৭)। ওই ব্যাংক হিসাবে নিজের নাম মো. জসিম উদ্দিন এবং ঠিকানা লেখা হয় বরিশাল শহরের কাউনিয়া আকন ভিলা জামে মসজিদ। ডিবির তদন্তে বেরিয়ে আসে, মো. আবুল বাশারের প্রাইম ব্যাংক বরিশাল শাখার হিসাব থেকে ২০১০ সালের ২৬ আগস্ট ১২ লাখ টাকা জসীমুদ্দিনের উল্লিখিত হিসাব নম্বরে জমা পড়ে। এই বাশার হলেন জসীমুদ্দিনের ছোট ভাই। তিনি বরিশালের একটি মাদ্রাসার শিক্ষক। বাশার একই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর জসীমুদ্দিনের হিসাবে আরও ১১ লাখ ২৬ হাজার টাকা জমা দেন। ইসলামী ব্যাংকের বরিশাল শাখার মাওলানা নুরুর রহমান বেগের হিসাব থেকে দুই লাখ টাকা জসীমুদ্দিনের উল্লিখিত হিসাবে জমা পড়ে। নুরুর রহমান বরিশাল শহরের এবাদুল্লাহ জামে মসজিদের ইমাম। ইমামতির পাশাপাশি তিনি ক্রোকারিজ ব্যবসায় জড়িত। জসীমুদ্দিনকে টাকা দেওয়ার তাঁর উদ্দেশ্য কী ছিল, গোয়েন্দারা তা খতিয়ে দেখছেন। ২০০৯ সালের ৭ জুন জসীমুদ্দিন ব্রোকারেজ হাউস এম সিকিউরিটিজে একটি বিও হিসাব (শেয়ার ব্যবসার জন্য) খোলেন। তাতে তিনি আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের বরিশাল শাখার হিসাব নম্বর ব্যবহার করেন। এর তিন দিন পর ১০ জুন জসীমুদ্দিন শেয়ার কেনার জন্য এম সিকিউরিটিজের অনুকূলে চার লাখ টাকা জমা দেন। পরদিন ১১ জুন ব্যাংকে এক লাখ টাকা রেখে বাকি টাকা আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখার ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করেন। ২০০৯ সালের ৭ জুন থেকে ২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই বিও হিসাবে চার কোটি ২৭ লাখ টাকা জমা হয় এবং তা বিভিন্ন সময়ে উত্তোলনও করা হয়। বর্তমানে হিসাবটিতে ছয় কোটি ৩৮ লাখ টাকার শেয়ার রয়েছে (ক্রয়মূল্য অনুযায়ী)। এর আগে ২০০৭ সালের ২৭ মে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসিতে একটি হিসাব খোলেন মুফতি জসীমুদ্দিন। শেয়ার কেনার জন্য এই হিসাবে দুই কোটি ২৫ লাখ টাকা জমা করেন। এ ছাড়া আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের ধানমন্ডি শাখা থেকে দুটি চেকে শেয়ার কেনার জন্য আরও ২৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা নিকাশ ঘরের (ক্লিয়ারিং হাউস) মাধ্যমে জমা দেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতায় ডিবির তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, উপরে উল্লিখিত লেনদেন ছাড়াও জসীমুদ্দিনের পরিচালিত হিসাব থেকে আইডিএলসি সিকিউরিটিজের অনুকূলে বিভিন্ন সময়ে ২৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা, এম সিকিউরিটিজের অনুকূলে ২৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা, জনৈক হুমায়ুন কবীরকে ২০ লাখ ৭০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখায় জসীমুদ্দিন দুটি মেয়াদি আমানত হিসাব খোলেন। এর মধ্যে একটি ১৫ লাখ, আরেকটি ১০ লাখ ২০ হাজার টাকার। দ্বিতীয় হিসাবটি এখনো চালু আছে। এ দুটি হিসাবের একটি ঠিকানা হিসেবে মারকাজ মাদ্রাসা, বছিলা রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা এবং আরেকটিতে ইমাম, হাতেমবাগ মসজিদ, ধানমন্ডি, ঢাকা উল্লেখ করা হয়েছে। জসীমুদ্দিনের বিরুদ্ধে ঢাকার মোহাম্মপুর থানার মামলার তদন্ত-তদারক কর্মকর্তা ডিবির জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, জসীমুদ্দিনকে গ্রেপ্তার করার পর তাঁর ব্যাংক হিসাব ও আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি তদন্ত করে তাঁর ব্যাংক হিসাবগুলোতে বিপুল অঙ্কের অর্থ লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ছাড়া তিনি শেয়ারবাজার ও ট্রাভেল এজেন্সিতেও বিনিয়োগ করেছেন। মুফতি জসীমুদ্দিনকে বরগুনায় গ্রেপ্তারের পর ২০১৩ সালের আগস্টে ঢাকার বছিলায় তাঁর পরিচালিত মাদ্রাসায় অভিযান চালায় পুলিশ। এই মাদ্রাসা থেকেই তিনি মূলত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। সেখান থেকে পুলিশ জঙ্গি তৎপরতা-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন উপকরণ, পুস্তিকা-প্রচারপত্র উদ্ধার করে। এপর তাঁর বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইন এবং তথ্য, যোগাযোগ ও প্রযুক্তি আইনে দুটি মামলা হয়। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় দুই সহযোগী জুম্মন শিকদার, জাহেদুল হকসহ তাঁকে ২ জুলাই এক দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, রিমান্ডে জসীমুদ্দিনের ব্যাংকে অস্বাভাবিক লেনদেন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁকে আরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে ৩ জুলাই ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে পাঠানো হয়। বিষয়টি শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
No comments:
Post a Comment