ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা নিয়ে নেদারল্যান্ডসের স্থায়ী সালিসি আদালতের রায়ে বাংলাদেশ ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রাঞ্চল পেয়েছে। ভারতের সাথে বিরোধপূর্ণ সমুদ্রাঞ্চল ছিল ২৫ হাজার ৬০২ কিলোমিটার। মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি হওয়ার পর এ রায়ের ফলে বঙ্গোসাগরের এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার আঞ্চলিক সমুদ্র (টেরিটোরিয়াল সি), ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইইজেড) এবং চট্টগ্রাম উপ
কূল থেকে ৩৫৮ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের (কন্টিনেন্টাল সেলফ) তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। স্থায়ী সালিসি আদালতের রায়ে বঙ্গোপসাগরের ওপর টানা রেখায় দক্ষিণ তালপট্টি ভারতের অংশে পড়েছে। আদালতের রায়ে বঙ্গোপসাগরে ৫০ বর্গকিলোমিটারের একটি ‘গ্রে এরিয়া’ রয়েছে যার মৎস্য সম্পদে ভারতের এবং সমুদ্র তলদেশের সম্পদে বাংলাদেশের অধিকার থাকবে। নেদারল্যান্ডসের স্থায়ী সালিসি আদালতের এ রায় গত সোমবার বাংলাদেশ ও ভারতকে জানানো হলেও গতকাল বেলা ২টায় তা আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। একই সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রায়ের ওপর একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। এতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির প্রধান ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (আনকজ) রিয়ার অ্যাডমিরাল খুরশেদ আলমসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এই রায় বাংলাদেশ ও ভারত উভয় রাষ্ট্রের জন্য বিজয় নিশ্চিত করেছে। এই বিজয় বন্ধুত্বের বিজয়। এটি দুই দেশের জনগণের বিজয়। কেননা তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকা সমস্যা আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি হলো। এ সমস্যা দুই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করেছিল। মাহমুদ আলী বলেন, সালিসি আদালতের রায় বাংলাদেশ ও ভারতের সমুদ্রসীমা চিহ্নিত করে দিয়েছে। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ নেই। এই রায়ের মাধ্যমে ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক আদালতে দায়ের করা ভারত ও মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা-সংক্রান্ত বাংলাদেশের মামলার পরিসমাপ্তি হলো। আন্তর্জাতিক আইনগত প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ দিনের বিরাজমান সমস্যা শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানে ভারতের সদিচ্ছা এবং আদালতের রায় মেনে নেয়ার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারত সরকারকে সাধুবাদ জানান। তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট সমুদ্রসীমা না থাকায় বঙ্গোপসাগরে প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলন, গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণসহ সামগ্রিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। এ ছাড়া বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের সদস্যরা তাদের দায়িত্ব পালনে এবং বিদেশী ট্রলারের অবৈধভাবে মৎস্য আহরণ প্রতিরোধে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিল। সমুদ্রসীমার বিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান হওয়ায় আনন্দ প্রকাশ করে দীপু মনি বলেন, এ রায়ের ফলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে সৌহাদ্যপূর্ণ সম্পর্ক এগিয়ে নিতে অন্তত সমুদ্রসীমা বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। বঙ্গোপসাগরের ওপর বাংলাদেশ ও ভারত উভয়েই ন্যায্য অধিকার পেয়েছে। এ জয় সব পক্ষের। সমুদ্রসীমা-সংক্রান্ত মামলায় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করার জন্য দীপু মনি বিশেষ করে কমনওয়েলথ ও নরওয়েকে ধন্যবাদ জানান। আদালতে বাংলাদেশের ডেপুটি এজেন্ট খুরশেদ আলম বলেন, ভারত ও মিয়ানমার বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রসীমা দাবি করে যে রেখা টেনেছিল তাতে বাংলাদেশ ১০০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ (জোনলক) হয়ে পড়ত। আর বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব থাকত মাত্র ৪০ হাজার বর্গকিলোমিটার। হাড়িয়াভাঙ্গা নদী যেখানে সাগরে মিলেছে রেডকিফের অ্যাওয়ার্ড অনুযায়ী সেখানে সমুদ্রসীমা শুরু হওয়ার কথাÑ এটাই ছিল বাংলাদেশের বক্তব্য। ভারত দাবি করে হাড়িয়াভাঙ্গা নদীটি রায়মঙ্গলে আছে। তাই রায়মঙ্গল থেকে সমুদ্রসীমা শুরু হবে। এটিই ছিল যুক্তিতর্কের মূলে। মোটামুটিভাবে বলা যায়, ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় রেডকিফ যে মানচিত্র এঁকেছিলেন, সমুদ্রসীমা সে অনুযায়ীই হয়েছে। ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর আদালতের বিচারকেরা সরেজমিন বাংলাদেশ ও ভারতের দাবি অনুযায়ী বেইস পয়েন্ট দেখে গেছেন। সমুদ্রসীমা নির্ধারণে আদালত ভারতের সমদূরত্ব ও বাংলাদেশের সমতা পদ্ধতি বিবেচনায় নিয়ে রায় দিয়েছেন। বাংলাদেশ ১৮০ ডিগ্রিতে বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রসীমার রেখা টানার দাবি করেছিল। ভারতের দাবি ছিল ১৬২ ডিগ্রিতে। আদালত ১৭৭ দশমিক ৫ ডিগ্রিতে সমুদ্রসীমার রেখা টেনেছেন। দক্ষিণ তালপট্টি ভারতের : দক্ষিণ তালপট্টি কারÑ এ প্রশ্নের উত্তরে খুরশেদ আলম বলেন, তালপট্টি ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে বালু দিয়ে সৃষ্টি হয়ে ১৯৮৫ সালের ঝড়ে (যাতে উড়িরচর নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল) সমুদ্রে মিলিয়ে যায়। ১৯৮৯ সাল থেকে উপগ্রহের চিত্রে তালপট্টি দ্বীপের স্থানে শুধুই পানি দেখা গেছে। ২০০৮ সালে ভারতের গবেষণায়ও বলা হয়, ‘নিউ মুর (তালপট্টি) ইস নো মোর।’ অর্থাৎ তালপট্টি আর নেই। গত ২৪ অক্টোবর বাংলাদেশ বিচারকদের সরেজমিন তালপট্টির স্থান দেখাতে নিয়ে যায়। তারা সেখানে কোনো দ্বীপের অস্তিত্ব পাননি। ভারত বিমান থেকে ইনফ্রারেড ক্যামেরা ব্যবহার করে তালপট্টির অস্তিত্ব দেখাতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। রেডকিফের লাইনকে ভিত্তি ধরে বাংলাদেশ-ভারত সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রেডকিফের লাইনেই দক্ষিণ তালপট্টি ভারতের অভ্যন্তরে পড়ে গেছে। ১৯৮০ সালের আগে বাংলাদেশ তালপট্টি দাবি করেছিল। কিন্তু এর পর থেকে বাংলাদেশে যত মানচিত্র প্রকাশ করা হয়েছে তাতেও তালপট্টি বাংলাদেশের ছিল না। দীপু মনি বলেন, দক্ষিণ তালপট্টির ছোট একটি জায়গা ভারতের অংশে পড়লেও তার নিচে বঙ্গোপসাগরের বিশাল এলাকা পেয়েছে বাংলাদেশ। স্থায়ী সালিসি আদালতের প্রেস বিজ্ঞপ্তি : নেদারল্যান্ডসের স্থায়ী সালিসি আদালত গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েপ্রণ, বিচারকদের সর্বসম্মত রায়ে বাংলাদেশ ও ভারতের আঞ্চলিক সমুদ্র (১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত) নির্ধারণ করা হয়েছে। আর পাঁচজন বিচারকের মধ্যে চারজনের ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল (২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত) এবং ২০০ মাইলের মধ্যে এবং বাইরে মহীসোপান নির্ধারণ করা হয়েছে। বিচারকদের রায় সম্পর্কে খুরশেদ আলম জানান, বিচারক ড. পি এস রাও ১৭৭ দশমিক ৫ ডিগ্রিতে রেখা টানার বিরোধিতা করেছেন। তার মতে, এতে ভারতের জন্য ন্যায্যতা নিশ্চিত হলো না। যে আইন ও নীতির ভিত্তিতে গ্রে এরিয়া নির্ধারণ করা হয়েছে ড. রাও তাতেও দ্বিমত পোষণ করেছেন।
No comments:
Post a Comment