বাংলাদেশের সাথে সমুদ্রসীমার রায় আটকাতে ভারত সব ধরনের চেষ্টা করেছে। সর্বশেষ নেদারল্যান্ডসে অবস্থিত স্থায়ী সালিসি আদালতের (পিসিএ) ব্যয়ের অর্থ পরিশোধে গড়িমসি করে তারা রায় প্রকাশ ২০ দিন ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। এর আগে বাংলাদেশের অনুরোধ সত্ত্বেও দেশটি পিসিএ’র বদলে জার্মানির হামবুর্গে অবস্থিত সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে (ইটলস) মামলা স্থানান্তর করতে সম্মত হয়নি। পিসিএ’র বিচারক নিয়োগেও ভারত যতট
া সম্ভব বিলম্ব করেছে। নেদারল্যান্ডসের রাজধানী হেগে অবস্থিত পিসিএতে বাংলাদেশ ও ভারত গত বছর ৯ থেকে ১৮ ডিসেম্বর সমুদ্রসীমা নির্ধারণে যার যার অবস্থানের পে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে। শুনানি শেষে আদালতের প থেকে বলা হয়, কার্যবিধির ১৫ ধারা অনুযায়ী ছয় মাস পর সমুদ্রসীমা নির্ধারণের রায় দেয়া হবে। সে হিসাবে ১৮ জুনের মধ্যে এ রায় হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভারত পিসিএতে বিচারপ্রক্রিয়া চালাতে তার অংশের অর্থ পরিশোধ না করায় রায় দেয়া বিলম্বিত হয়। শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত সময়ের ২০ দিন পর ৭ জুলাই পিসিএ রায় দিতে সক্ষম হয়। অথচ ২০১০-এর জানুয়ারিতে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে পিসিএ’র পরিবর্তে ইটলসে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ভারতকে প্রস্তাব দিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের প্রস্তাবে আগ্রহ দেখায়নি ভারত। ইটলসে আগে থেকে প্রতিষ্ঠিত একটি আদালতের মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত কম খরচে দ্রুততার সাথে বিরোধ নিষ্পত্তি সম্ভব। তবে এই আদালতে যেতে বিবদমান উভয় পক্ষের সম্মতি প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমার ইতঃপূর্বে পিসিএ’র পরিবর্তে ইটলসে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তিতে সম্মত হয়েছে। ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর সমুদ্রসীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশ একই দিন দুই প্রতিবেশী দেশকে মামলার ব্যাপারে নোটিশ দেয়। ২০১২ সালের ১৫ মার্চ ইটলস বাংলাদেশ-মিয়ানমার সমুদ্রসীমা নির্ধারণী রায় দেয়। অন্য দিকে পিসিএ বাংলাদেশ-ভারত সমুদ্রসীমার রায় দিতে ইটলসের চেয়ে দুই বছর তিন মাসেরও বেশি সময় নিয়েছে। পিসিএতে বিচারক নিয়োগ ও বিচারকার্যের আনুষঙ্গিক খরচ বিবদমান পক্ষগুলোকে সমান ভাগে ভাগ করে নিতে হয়। কিন্তু ইটলসে এই বাড়তি খরচের ঝোঝা নেই। আগে থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত ২১ জন বিচারক এই আদালত পরিচালনা করেন। উভয় ট্রাইব্যুনালের রায়ের কার্যকারিতা একই। এ রায়ই চূড়ান্ত এবং এর বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ নেই। তাই মিয়ানমারের মতো ভারতকেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণের জন্য বাংলাদেশ অনুরোধ করেছিল। কিন্তু আর্থিক সক্ষমতাসহ সমুদ্রসীমার কারিগরি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও সমুদ্র আইনসংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ জ্ঞানে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে থাকার কারণে ভারত পিসিএতে দ্বিপক্ষীয় সালিসির মাধ্যমেই বিষয়টির নিষ্পত্তি চেয়েছে। ভারত ইতঃপূর্বে বেশ কিছু দেশের সাথে তার সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করেছে। তাই এ ক্ষেত্রে ভারতীয়দের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল। পিসিএতে বিচার হিসাবে ছিলেন জার্মানির রুডিজার উলফ্রাম (প্রেসিডেন্ট), ফ্রান্সের জ্যাঁ-পিয়েরে কট, ঘানার টমাস এ মেনশাহ, অস্ট্রেলিয়ার প্রফেসর শিয়ারার এবং ভারতের ড. প্রেমারাজু শ্রীনিবাসা রাও। বিচারকদের সর্বসম্মত রায়ে বাংলাদেশ ও ভারতের আঞ্চলিক সমুদ্র (১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত) নির্ধারণ করা হয়েছে। আর পাঁচজন বিচারকের মধ্যে চারজনের ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল (২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত) এবং ২০০ মাইলের মধ্যে এবং বাইরে মহীসোপান নির্ধারণ করা হয়েছে। বিচারক প্রেমারাজু শ্রীনিবাসা রাও ১৭৭ দশমিক ৫ ডিগ্রিতে রেখা টানার বিরোধিতা করে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছেন। তার মতে, এতে ভারতের জন্য ন্যায্যতা নিশ্চিত হয়নি। যে আইন ও নীতির ভিত্তিতে ‘গ্রে এরিয়া’ নির্ধারণ করা হয়েছে ড. রাও তাতেও দ্বিমত পোষণ করেছেন। বাংলাদেশ ১৮০ ডিগ্রিতে বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রসীমার রেখা টানার দাবি করেছিল। ভারতের দাবি ছিল ১৬২ ডিগ্রিতে। আদালত ১৭৭ দশমিক ৫ ডিগ্রিতে সমুদ্রসীমার রেখা টেনেছেন। আদালতের রায়ে বঙ্গোপসাগরে ৫০ বর্গকিলোমিটারের একটি গ্রে এরিয়া রয়েছে যার মৎস্যসম্পদে ভারতের এবং সমুদ্র তলদেশের সম্পদে বাংলাদেশের অধিকার থাকবে। ভারতের সাথে সমুদ্রসীমার রায়ে বাংলাদেশ ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রাঞ্চল পেয়েছে। ভারতের সাথে বিরোধপূর্ণ সমুদ্রাঞ্চল ছিল ২৫ হাজার ৬০২ কিলোমিটার। ব্লক পুনর্গঠন : বঙ্গোপসাগরে ভারত ও মিয়ানমারের পাল্টাপাল্টি দাবির মুখে বাংলাদেশের জন্য প্রায় কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের ২৮টি ব্লকের মধ্যে ১০টিতে ভারত ও ১৭টিতে মিয়ানমার আপত্তি দিয়ে রেখেছিল। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য ২০০৮ সালে তিনটি ব্লক (৫, ১০ ও ১১) বাংলাদেশ বিদেশী কোম্পানির কাছে বরাদ্দ দেয়ার উদ্যোগ নিলেও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে আপত্তি আসে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আরবিট্রেশনে (সালিসি) যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ। মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির পর ১৭টি ব্লকের মধ্যে ১২টি পুনর্গঠন করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। আর ভারতের সাথে সমুদ্রসীমার নিষ্পত্তির পর বাংলাদেশকে পাঁচটি ব্লক পুনর্গঠন করতে হবে। এগুলো হলোÑ ৫, ৯, ১৪, ১৯ ও ২৪। এই ব্লকগুলো পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ শিগগির তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিচ্ছে। এর আগে বঙ্গোপসাগরের অধিকার নিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর বিরোধ থাকায় অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে উৎসাহ দেখায়নি আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী কোম্পানিগুলো। সমুদ্রসীমার নিষ্পত্তি হওয়ায় এখন বিদেশী কোম্পানিগুলো তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহী হয়ে উঠবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। বর্তমানে উৎপাদন বণ্টন চুক্তির আওতায় (পিএসসি) কনকোফিলিপস ১০ ও ১১ নম্বর ব্লকে অনুসন্ধান করছে। মার্কিন কোম্পানিটির সাইসমিক সার্ভে অনুযায়ী ব্লক দু’টিতে ৫ থেকে ৭ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘন ফুট) গ্যাসের মজুদ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অগভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের একমাত্র গ্যাসক্ষেত্র সাঙ্গু দুই বছর আগেই পরিত্যক্ত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে গ্যাস ঘাটতি দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট যা মোট চাহিদার এক-পঞ্চমাংশ। ১৯৯৮ সালে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের পর এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য পায়নি। গ্যাসের অভাবে বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে ঝুঁকছে। আর অন্তর্বর্তী চাহিদা মেটানোর জন্য সরকার অত্যন্ত ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ওপর নির্ভর করছে। এর ফলে গ্রাহকপর্যায়ে বিদ্যুতের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ২০০৮ ও ২০১০ সালের পর ব্লক পুনর্গঠন শেষে বাংলাদেশ আগামী বছর বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য তৃতীয় দফা আন্তর্জাতিক দরপত্রে যেতে পারে বলে জানা গেছে।
No comments:
Post a Comment