ইমার্জেন্সি (জরুরি) রোগীদের চিকিৎসা না দিয়ে কেবল রেফারেল কেন্দ্রে সরকারি হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়ার প্রবণতায় চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। জরুরি চিকিৎসাযোগ্য যেকোনো রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে ডাক্তারদের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তারা নিজেদের দায়িত্ব পালন করছেন না বলে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। অবশ্য তারা বলছেন, তারা চিকিৎসা দিতে চান কিন্তু রোগী মারা গেলে অথবা রোগীর শারীরিক অবস্থার
অবনতি হলে রোগীর অভিভাবকেরা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও হাসপাতালে আক্রমণ করে বসেন। এ ছাড়াও পুলিশ কেস হলে তাদের সাক্ষী বানিয়ে টানাহেঁচড়া করা হয়। সে কারণে বেশির ভাগ চিকিৎসকই দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চান। চিকিৎসকেরা বলছেন, অতীতে সন্ত্রাসী হামলায় একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদও বিনা চিকিৎসায় রক্তক্ষরণে মারা গেছেন। চিকিৎসকেরা তাদের চিকিৎসা করতে ভয় পেয়েছেন বলেই কেউ রক্তক্ষরণ বন্ধের ব্যবস্থা নিতেও সাহস পাননি। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রক্তক্ষরণ বন্ধ করে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আনা হলে হয়তো ইতিহাস ভিন্নভাবে লেখা হতে পারতো বলে অনেক চিকিৎসক মনে করেন। এ ছাড়া গত বৃহস্পতিবার ছিনতাইকারীদের গুলিতে নিরাপত্তাপ্রহরী লিটনকে উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের আল আশরাফ মেডিক্যালে নিয়ে গেলে সেখানে চিকিৎসা দেয়া হয়নি। পরে উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে গেলেও চিকিৎসকেরা সেখানে ধরেননি। অবশেষে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে গেলে অধিক রক্তক্ষরণে লিটন মারা যান। লিটনের স্বজনেরা রাত পর্যন্ত হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে একজন ডাক্তারের সহানুভূতি পাননি। এ ঘটনা বিবেকবান সবাইকে নাড়া দেয়। সম্প্রতি উচ্চ আদালত থেকে যেকোনো হাসপাতাল বা কিনিক থেকে সব মুমূর্ষু রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার নির্দেশনা জারি করলে এটা কার্যকর না হওয়ায় ক্ষোভ দানা বাধছে। এ সমস্যা সমাধানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ডা: প্রাণ গোপাল দত্ত বলেছেন, ঢাকার প্রবেশ পথে হাসপাতাল তৈরি করে সেখানে জরুরি বিভাগ চালু করে এ সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। তিনি বলেন, ঢাকার উত্তরায় কুয়েত মৈত্রি হাসপাতালে (বর্তমানে আমেরিকান হাসপাতাল) জরুরি সেবা চালু করা যেতে পারে। সেনাবাহিনী দ্বারা পরিচালিত কর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল তো আছেই। মুগদায় যে ৫০০ বেডের হাসপাতাল আছে তাতে জরুরি বিভাগ চালু করা যেতে পারে। যাত্রাবাড়ীতে মুগদার মতো একটি বড় হাসপাতাল করে সেখানে জরুরি বিভাগ চালু করা যেতে পারে। এ ছাড়া বুড়িগঙ্গার ওপারে কেরানীগঞ্জে আরেকটি হাসপাতাল চালু করে ওই দিক থেকে আসা রোগীদের চাহিদা মেটানো যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ছাড়াও বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থোপেডিকস, গাইনি, নিউরো, পেডিয়াট্রিকসহ বেশ কিছু জরুরি বিভাগ চালু করা হয়েছে, রোগীরা এখান থেকেও সেবা পেতে পারেন। এ ছাড়া প্রত্যেকটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জরুরি বিভাগ চালুর উদ্যোগ নিতে হবে। জরুরি চিকিৎসার রোগীরা মারা গেলে আত্মীয়স্বজনরা চিকিৎসকদের ওপর আক্রমণ করে বসেন। এ সমস্যা কিভাবে সমাধান করা যায় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা চিকিৎসক ও রোগীর সুসম্পর্কের মাধ্যমে অবসান করা যায়। রোগী যখন দেখবে চিকিৎসক সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন তাহলে আক্রমণ নয় তারা রোগীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পাবেন। বিশিষ্ট মেডিক্যাল শিক্ষাবিদ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা: মো: মোজাহেরুল হক জানিয়েছেন, ইমার্জিন্সি (জরুরি) রোগীকে চিকিৎসা না দিয়ে কোনো চিকিৎসক ফেরত দিতে পারেন না। চিকিৎসক যেখানেই থাকবেন ইমার্জিন্সি রোগী আসলে তাকে জরুরি অথবা প্রাথমিক চিকিৎসা দিতেই হবে। মেডিক্যাল শিক্ষার শুরুতেই সব ছাত্রকে এ ধরনের শপথ নিতে হয়। এটাকে বলে হিপোক্রিটাস ওথ।’ তিনি বলেন, শুধু মেডিক্যাল শিক্ষায় নয়, মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল থেকে রেজিস্ট্রেশন নেয়ার সময়ও চিকিৎসককে এ হিপোক্রেটিক শপথটি নিয়েই রেজিস্ট্রেশন নিতে হয়। বাংলাদেশে হিপোক্রেটিক শপথ ভঙ্গ করলে কোনো শাস্তির ব্যবস্থা নেই। ফলে জরুরি সেবার জন্য যেসব রোগী সরকারি হাসপাতাল ছাড়া বেসরকারি চিকিৎসকদের কাছে আসেন চিকিৎসকরা তাদের সেবা দিতে চান না। তারা দায়িত্ব এড়িয়ে যেতেই পছন্দ করেন, এটা অনৈতিকও বটে। বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন জানান, সরকারি হাসপাতাল ছাড়া চিকিৎসকেরা যে জরুরি চিকিৎসা দেন না তা ঠিক নয়। তারা কেবল যেসব চিকিৎসার সাথে মামলা (মেডিকো লিগ্যাল কেস) জড়িত থাকতে পারে কেবল সেসব ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ছাড়া অন্যরা চিকিৎসাটা দিতে চাননা কোর্ট অথবা পুলিশি হয়রানির কারণে। অনেক সময় কোর্ট থেকেও বলা হয় সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের সার্টিফিকেট লাগবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় একত্রে বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে এ অবস্থার অবসান করতে পারে। এ তিন মন্ত্রণালয় একত্রে সিদ্ধান্ত দিতে পারে যে সরকারি লাইসেন্সপ্রাপ্ত সব চিকিৎসকই মেডিকো লিগ্যাাল কেসের চিকিৎসা দিতে পারবে। এ ছাড়া এ ধরনের চিকিৎসার ক্ষেত্রে চিকিৎসকের নিরাপত্তা বিধান করলেও তারা রাজি হবেন চিকিৎসা দিতে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি অনুষদের সাবেক ডিন ও শিশু সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, চিকিৎসকদের এ ধরনের কাজটি অনৈতিক। যেকোনো জরুরি চিকিৎসার যোগ্য রোগীকে তার কাছে পৌঁছামাত্রই প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে বাধ্য। এরপর তিনি হয়তো কোনো রেফারেল সেন্টারে পাঠিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু এটা না করে চিকিৎসকেরা রোগী ফিরিয়ে দেয় কেন? এটা অনুসন্ধান করে দেখা উচিত সবার। অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, একটা জরুরি চিকিৎসার যোগ্য রোগীকে চিকিৎসা দিলে তিনি সুস্থও হয়ে যেতে পারেন আবার আরো বেশি অসুস্থও হয়ে পড়তে পারেনন। এমনকি রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। আমাদের দেশে চিকিৎসাধীন রোগী মারা গেলে রোগীর আত্মীয়স্বজন চিকিৎসকের সাথে অনুপযুক্ত আচরণ করে থাকেন। আক্রমণ করে বসেন চিকিৎসক ও হাসপাতালে। অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম এ অবস্থার অবসানের জন্য কিছু সুপারিশ করেছেন। তিনি জানান, যেকোনো হাসপাতালে জরুরি রোগী চিকিৎসা দেয়া হলে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে পুলিশকে। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে স্বাস্থ্য প্রশাসন, জেলা প্রশাসন এবং পুলিশ প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেবেন রোগীকে রেফারেল সেন্টারে পাঠানো হবে কি না। তাহলে এককভাবে চিকিৎসকদের ওপর দায়িত্ব এসে পড়বে না, তারা আক্রমণেরও শিকার হবেন না এবং জরুরি চিকিৎসার রোগীরা চিকিৎসা পাবেন। উল্লেখ্য, সব কিছুর ঊর্ধ্বে রোগীর প্রাণ রক্ষা।
No comments:
Post a Comment