পদ্মা সেতু প্রকল্পের মূল কাজ শুরুই হয়নি। এরই মধ্যে প্রকল্পের টাকায় ৩৮টি গাড়ি কেনা হয়ে গেছে। এর ৩৬টিই মিতসুবিশি কোম্পানির পাজেরো ব্র্যান্ডের গাড়ি। সেতু বিভাগের পুরোনো আরও ১০টি গাড়িও এই প্রকল্পে ব্যবহার করা হচ্ছে। মূল প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) গাড়ির জ্বালানি বাবদ প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যন্ত মোট চার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। অথচ গত মার্চ পর্যন্ত এই খাত থেকে তিন কোটি ৬১ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছ
ে। সেতু বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। প্রকল্প কর্মকর্তাদের জন্য বরাদ্দ নতুন ও পুরোনো ২৮টি গাড়ির মধ্যে ২৪টি গাড়ি ও পাঁচটি মোটরসাইকেলের জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচের হিসাব পাওয়া গেছে। মহাখালীর ‘গুলশান সার্ভিস স্টেশন’ নামের একটি পাম্প থেকে এই গাড়িগুলোর জন্য প্রতি মাসে গড়ে সোয়া দুই লাখ টাকার জ্বালানি তেল নেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পের মূল কাজ অর্থাৎ মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজ শুরুই হয়নি। জমি অধিগ্রহণ শেষ হয়েছে। সংযোগ সড়কের কাজ প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ২০১৮ সালে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের গাড়ি নিয়ে নয়ছয় নতুন নয়। এ জন্যই গাড়ি যত কম হয়, তত ভালো। দুর্নীতির অভিযোগসংক্রান্ত ঝামেলায় পদ্মা সেতু প্রকল্প বৈদেশিক ঋণপুষ্ট প্রকল্প থেকে দেশীয় অর্থায়নের প্রকল্পে পরিণত হওয়ায় এখন বেশি করে কৃচ্ছ্রসাধন করা দরকার। দেশীয় অর্থায়নের প্রকল্পে এত গাড়ি ও জ্বালানি অপচয় কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, নতুন কেনা গাড়িগুলোর মধ্যে প্রকল্প কর্মকর্তাদের জন্য কেনা হয়েছে ১৮টি। পদ্মা সেতু প্রকল্পের সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এলাকা নির্মাণ তদারকির জন্য সেনাবাহিনীকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অন্য ২০টি গাড়ি কেনা হয়েছে সেনাবাহিনীর অধীন পরামর্শকদের জন্য। বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে—এই আশায় গাড়িসহ যাবতীয় কেনাকাটা করা হয়েছিল। এখন তা রাজস্ব খাত থেকে বাস্তবায়িত হচ্ছে। কিন্তু রাজস্ব খাতের প্রকল্পে এত গাড়ি কেনার নজির যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন অন্য প্রকল্পে নেই বলে সূত্র জানিয়েছে। মূল সেতু ও নদীশাসনের জন্য আলাদা পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। পরামর্শকের জন্য আরেক দফা গাড়ি কেনা হবে বলে সূত্র জানিয়েছে। নতুন কেনা গাড়িগুলোর কোনো কোনোটার দাম এক কোটি টাকারও বেশি। সূত্র জানায়, শুধু পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে নেওয়া একটি গাড়িতে গত মার্চ ও এপ্রিল মাসে প্রকল্পের পরিচালক খরচ করেন এক হাজার ১৪০ লিটার ডিজেল। আর এক হাজার ৪০ লিটার ডিজেল পোড়ান সেতু বিভাগের সচিব। প্রকল্পের বাইরে সচিব সরকারের পরিবহন পুল থেকেও একটি গাড়ি ব্যবহার করেন। সেতু বিভাগের আরেকটি গাড়িও সচিব মাঝেমধ্যে ব্যবহার করেন। প্রকল্পের অন্য গাড়ি ব্যবহারকারীরাও প্রতি মাসে অস্বাভাবিক হারে জ্বালানি তেল খরচ করছেন বলে জানা গেছে। প্রকল্পের কর্মকর্তাদের গাড়িগুলো মূল ডিপিপিতে আলাদা করে উল্লেখ করা আছে। আর পরামর্শকদের জন্য যেসব গাড়ি কেনা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে হবে, সেগুলো প্রকল্পের বিভিন্ন অংশের ব্যয়ের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ২০০৭ সালে অনুমোদিত পদ্মা সেতু প্রকল্পের মূল ডিপিপিতে ১৫টি গাড়ি, কিছু মোটরসাইকেল ও স্পিডবোটের সংস্থান রাখা ছিল। ২০১১ সালে ডিপিপি পরিবর্তন করে গাড়ির সংখ্যা বাড়িয়ে ২৯ করা হয়। ২০০৯ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ১৮টি নতুন গাড়ি কেনা হয়। সেতু বিভাগে থাকা পুরোনো ১০টি গাড়ি নিয়ে ডিপিপিতে থাকা গাড়ির কোটা পূরণ করা হয়েছে। আর পরামর্শকদের জন্য ২০টি গাড়ি কেনা হয়েছে এ বছরের শুরুতে। সূত্র জানায়, প্রকল্প পরিচালক ও তিন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর সার্বক্ষণিক গাড়ি ব্যবহারের নিয়ম আছে। জ্যেষ্ঠ পরামর্শকদের জন্যও গাড়ি দেওয়া হয়। এর নিচের কর্মকর্তাদের সার্বক্ষণিক নয়, প্রকল্পের কাজে প্রয়োজন হলে গাড়ি ব্যবহার করার কথা। কিন্তু পদ্মা সেতুর গাড়ি সেতু বিভাগের সচিব ছাড়াও নিচের স্তরের কর্মকর্তারাও সার্বক্ষণিক ব্যবহার করছেন। নিচের স্তরের কর্মীদের ব্যবহারের জন্য মোটরসাইকেল কেনা হলেও সেগুলো ব্যবহার করছেন অফিস সহকারীরা। গাড়ির একাধিক চালক জানান, প্রকল্পের গাড়ি কর্মকর্তাদের আত্মীয়-স্বজনদেরও ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। জানতে চাইলে সেতু বিভাগের সচিব খোন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, দেশি কিংবা বিদেশি অর্থায়ন যা-ই হোক না কেন, গাড়ি বেশি না। এত বড় প্রকল্পে ১৫০টি গাড়ি থাকা উচিত। প্রকল্পের কাজে গতি বেড়েছে, গাড়ি আরও লাগবে। কাজ শেষ হলে সব গাড়ি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চলে যাবে। নিজে প্রকল্পের গাড়ি ব্যবহারের বিষয়ে সচিব বলেন, ‘আমি শুধু সচিব নই, যমুনা সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালকও। নির্বাহী পরিচালকের জন্য গাড়ি বরাদ্দ আছে। কর্তৃপক্ষের গাড়ি না নিয়ে প্রকল্পের গাড়ি নিয়েছি। আর সচিব হিসেবে পুল থেকে একটা পেয়েছি। এর বাইরে আর গাড়ি নেই।’ গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি: পদ্মা সেতু প্রকল্পের মূল ডিপিপিতে পাঁচ কোটি আট লাখ টাকার মোটরযানের সংস্থান রাখা হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে ১২টি পাজেরো, একটি করে মাইক্রোবাস, পিকআপ, মিনিবাস এবং ১২টি মোটরসাইকেল। প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে গাড়ি, পিকআপ, মিনিবাস ও মাইক্রোবাসের সংখ্যা ২৯ করা হয়। ভিভিআইপিদের জন্য তিন হাজার সিসির (ইঞ্জিন ক্ষমতাসম্পন্ন) তিনটি পাজেরো যুক্ত করা হয়। মোটরসাইকেল বাড়ে তিনটি। নতুন যোগ হয় দুটি ডাবল ইঞ্জিনের স্পিডবোট। এই খাতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ডিপিপিতে উল্লেখিত গাড়ির মধ্যে ইতিমধ্যে নয় কোটি ৮৪ লাখ টাকায় ১৮টি পাজেরো ও ১৪টি মোটরসাইকেল কেনা হয়ে গেছে। এর বাইরে প্রকল্পের সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এলাকা নির্মাণকাজের পরামর্শকের জন্য প্রায় ১৮ কোটি টাকায় ২০টি গাড়ি কেনা হয়েছে। এসব গাড়ির মধ্যে ১৬টি পাজেরো এবং চারটি মাইক্রোবাস রয়েছে। সূত্র জানায়, ভিভিআইপিদের জন্য কেনা তিনটি গাড়ির একটি সচিব, অন্যটি প্রকল্প পরিচালক ব্যবহার করেন। এ বিষয়ে সচিব বলেন, ভিভিআইপিদের জন্য কেনা গাড়িতে বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্যদের আনা-নেওয়ার কাজও করা হয়। তেল পুড়ছে দেদার: প্রকল্প এলাকায় যাতায়াত করেন অল্প কয়েকজন কর্মকর্তা। সেটাও কদাচিৎ। কিন্তু পদ্মা সেতু প্রকল্পের টাকায় তেল পুড়ছে দেদার। ২৪টি গাড়ি ও পাঁচটি মোটরসাইকেলের জন্য গত এপ্রিলে জ্বালানি, ইঞ্জিন অয়েলসহ রক্ষণাবেক্ষণে খরচ হয় দুই লাখ ১১ হাজার টাকা। এর আগের মাসে খরচ হয় দুই লাখ ৩০ হাজার টাকা। সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এসব গাড়িতে এপ্রিলে ডিজেল খরচ হয় এক হাজার ২০ লিটার এবং অকটেন ৮০৭ লিটার। মার্চে পোড়ানো হয় এক হাজার ১৯০ লিটার ডিজেল ও ৯৩৩ লিটার অকটেন। সেতু বিভাগের সচিবের গাড়িতে এপ্রিলে ৪৮০ লিটার এবং মার্চে ৫৬০ লিটার তেল পোড়ানো হয়। ইঞ্জিন অয়েল ও ব্রেক অয়েল মিলে এপ্রিলে সচিবের গাড়ির পেছনে খরচ হয় ৩৭ হাজার ৯০ টাকা। মার্চে ব্যয় হয় ৪০ হাজার ২৩০ টাকা। মার্চ ও এপ্রিলে প্রকল্প পরিচালক ডিজেল পোড়ান এক হাজার ১৪০ লিটার। এই খাতে দুই মাসে ব্যয় ৮২ হাজার ১৭০ টাকা। মার্চ ও এপ্রিলে কার্যদিবস ছিল ২১টি। সেই হিসাবে সচিব দৈনিক গড়ে ২৫ লিটার এবং প্রকল্প পরিচালক ২৭ লিটার করে ডিজেল পোড়ান। এক লিটার ডিজেলে নতুন গাড়ি গড়ে সাত-আট কিলোমিটার চলে। সেই হিসাবে এই দুজন প্রতিদিন গড়ে ২০০ কিলোমিটার পথ চলেছেন। এ বিষয়ে সচিব আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘প্রকল্প পরিচালক তো মাসে বহুবার প্রকল্প এলাকায় যান। আমি যাই অন্তত তিনবার। আর যানজট তো আছেই। এর পরও জ্বালানি খরচ বেশি কি না, চেক করে দেখব।’ তিনি আরও বলেন, ‘মার্চ ও এপ্রিলে মন্ত্রিসভার কর্মসূচিতে উত্তরবঙ্গে সফর করার কারণে হয়তো বেশি খরচ হতে পারে। গাড়ি আমার সঙ্গে থাকে। তবে এত খরচ হয় না। বেশি সিসির এসব গাড়ির জন্য ৩৮০ লিটার জ্বালানি খরচ করার সুযোগ আছে।’ সচিব ও প্রকল্প পরিচালকের গাড়ি চলে ডিজেলে। বাকিগুলো চলে অকটেনে। মার্চে-এপ্রিলে অন্য কর্মকর্তাদের ব্যবহারের গাড়িগুলো দৈনিক সর্বনিম্ন ১৫ লিটার থেকে ৭০ লিটার পর্যন্ত তেল পুড়িয়েছেন। মোটরসাইকেল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রকল্পের ক্যাশিয়ার, যোগাযোগমন্ত্রীর দপ্তরের পিয়ন, কম্পিউটার অপারেটর ও ডেচপাচ রাইডারদের। তাঁরাও দিনে গড়ে ২০ লিটার করে তেল পুড়িয়েছেন। এই পরিমাণ তেল পোড়াতে হলে দৈনিক অন্তত ৪০-৫০ কিলোমিটার ভ্রমণ করতে হবে। সেতু বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, এটা অবাস্তব।
No comments:
Post a Comment