জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা ভঙ্গের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে ওই সব বহিষ্কারাদেশ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কার্যকর হয় না। কখনো আবার বহিষ্কারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। ফলে শৃঙ্খলা ভঙ্গের ঘটনায় জড়িত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী এবং অন্য শিক্ষার্থীরা বহাল তবিয়তে ছাত্রাবাসে থাকছেন এ
বং ক্লাস-পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছেন। বহিষ্কার করে পরে তা কার্যকর না করা বা বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শৃঙ্খলা ভঙ্গের প্রবণতা বাড়ছে বলে মনে করছেন শিক্ষকেরা। এর ফলে ক্যাম্পাসে র্যাগিংয়ের নামে হয়রানি, মারামারি, সংঘর্ষ, হামলা ও চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, কোনো এক অজানা কারণে প্রশাসন ক্যাম্পাসে র্যাগিং, মারামারি, ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় ঘোষিত শাস্তি যথাযথ কার্যকর করে না। এর ফলে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়, সুনাম নষ্ট হয়। সর্বশেষ গত বুধবার রাতে মওলানা ভাসানী হলে ছাত্রলীগের এক পক্ষের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা করে অপর পক্ষ। এ ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের জরুরি সভায় ছাত্রলীগের ১৬ নেতা-কর্মীকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার: গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি ইতিহাস বিভাগের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বিএনসিসি ক্যাডেট এবং রোভার স্কাউট সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক মহিতোষ রায় ও কার্যকরী সদস্য আসফিকুর রেজাকে এক বছরের জন্য এবং মীর মশাররফ হোসেন হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তাইমুর রহমান ও ছাত্রলীগ কর্মী মো. সালাউদ্দিন পারভেজকে ছয় মাসের জন্য বহিষ্কার ও ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ঘটনার সাত মাস পর তাঁদের শাস্তি মওকুফ করেন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। গত ২৫ সেপ্টেম্বর উপ-রেজিস্ট্রার (শিক্ষা) মোহাম্মদ আলী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়। গত বছরের ১৪ এপ্রিল (পয়লা বৈশাখ) ছাত্রী লাঞ্ছনার ঘটনায় দুই বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক তানভীর হাসান খান এবং পরিসংখ্যান বিভাগের ৩৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী আনিছুর রহমানকে। কিন্তু এর এক বছর পর গত মে মাসে অনুষ্ঠিত এক সিন্ডিকেট সভায় তাঁদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। বহিষ্কারাদেশ কার্যকর করা হয় না: গত তিন মাসে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে র্যাগিং ও মারামারির ঘটনায় ছয়টি বিভাগের সাত শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, এর একটিও কার্যকর করা হয়নি। যেমন, গত ১১ মে ক্যাম্পাসের বটতলায় র্যাগিংয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শহীদ রফিক-জব্বার হলের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা মারামারি করেন। এ ঘটনায় গত ১৫ মে সিন্ডিকেটের জরুরি সভায় রফিক-জব্বার হলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শামীম আহাম্মেদ, আইন ও বিচার বিভাগের রাশেদ খান মেনন ও নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের ইমরান খানকে ছয় মাসের জন্য এবং বঙ্গবন্ধু হলের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ইশতিয়াক আহমেদ, গণিত বিভাগের দ্বীপবেন্দু বিশ্বাস, লোকপ্রশাসন বিভাগের কৌশিক রহমান ও শাহরুখ শাহরিয়ার সৌমিককে তিন মাসের জন্য বহিষ্কার করা হয়। তাঁরা প্রত্যেকেই দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। সিন্ডিকেটে আরও সিদ্ধান্ত হয়, বহিষ্কারাদেশ বহাল থাকাকালীন তাঁরা কেউ হলে অবস্থান করতে পারবেন না এবং ক্লাস-পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। কিন্তু বিভাগের সভাপতি, হলের প্রাধ্যক্ষ ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বহিষ্কৃতরা প্রত্যেকেই হলে অবস্থান করছেন এবং ক্লাস-পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছেন। বহিষ্কার আদেশ কার্যকর না হলেও ইতিমধ্যে বহিষ্কারের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে বঙ্গবন্ধু হলের বহিষ্কৃত চার শিক্ষার্থীর। নৃ-বিজ্ঞান, প্রাণিবিদ্যা, গণিত এবং লোকপ্রশাসন বিভাগের সভাপতিরা প্রথম আলোকে জানান, বহিষ্কারাদেশ-সংক্রান্ত অফিস আদেশ বিভাগে এসেছে, কিন্তু এটি তাঁদের নজরে আসেনি। অন্যদিকে এ-সংক্রান্ত কোনো অফিস আদেশ পাননি বলে জানিয়েছেন আইন ও বিচার বিভাগের সভাপতি মো. রবিউল ইসলাম। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগেও এ-সংক্রান্ত কোনো অফিস আদেশ পৌঁছায়নি বলে জানা গেছে। বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীদের হলে থাকা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলমগীর কবির বলেন, ‘হলে অনেক শিক্ষার্থী। সবার খোঁজ রাখা কঠিন কাজ। তবে এ বিষয়ে আমি খোঁজ নেব।’ আদেশ জারি হয়নি: র্যাগিংয়ের নামে হয়রানি করার অপরাধে শেখ হাসিনা হলের আবাসিক ছাত্রী এবং মার্কেটিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের তিন শিক্ষার্থী সামি রেজওয়ানা, সাবরিনা আক্তার ও রাফিয়া মাহজুবাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবন বহিষ্কারের সুপারিশ করে শৃঙ্খলা বোর্ড। গত ২৩ জুলাই সিন্ডিকেট সভায় এ সুপারিশ অনুমোদন করা হয়। কিন্তু এর পর এক মাস পার হয়ে গেলেও এ-সংক্রান্ত কোনো অফিস আদেশ জারি করা হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাঁরা হলে অবস্থান করছেন এবং ক্লাস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছেন। উপাচার্যের বক্তব্য: উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম বলেন, ‘কোন বহিষ্কৃত শিক্ষার্থী হলে থাকছে, ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে, এসব জানালে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি।’ তিন ছাত্রী বহিষ্কারের ঘটনায় অফিস আদেশ জারি না হওয়া প্রসঙ্গে বলেন, ‘হাইকোর্টে দুজন রিট করেছেন। এর মধ্যে এ-সংক্রান্ত অফিস আদেশ জারি করা যায় কি না, আমরা খতিয়ে দেখছি।’
No comments:
Post a Comment