বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছ থেকে পার্লামেন্টে নেয়ার ক্ষেত্রে দ্বিমুখীনীতি অবলম্বন করছে সরকার। সংশ্লিষ্টপক্ষগুলোর কোনো বক্তব্য না নিয়েই ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলে সংবিধানের এ-সংক্রান্ত অনুচ্ছেদে আনা হচ্ছে সংশোধনী। কিন্তু সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বললেও সরকার মূলত তা করছে সুবিধামতো। পুরোপুরিভাবে ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাচ্ছে
না তারা। পঞ্চদশ সংশোধনীর সময়ও একই কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সে সময়ও সুবিধামতো সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেছেন, ১৯৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলে সরকার দেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। তারা তাদের ইচ্ছামাফিক সংবিধানে পরিবর্তন আনছে। মূলত বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ ও দলীয়করণ করার জন্যই এই অশুভ প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা ছিল সংসদের হাতে। ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল গঠনের সময় তা দেয়া হয় রাষ্ট্রপতির কাছে। পরে ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে অসদাচরণের জন্য বিচারপতিদের অপসারণ করতে গঠন করা হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। সামরিক শাসনামলের সংশোধনীর কথা বলে সরকার ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করতে উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু একই শাসনামলে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদেও পরিবর্তন আনা হয়েছিল। তা পরিবর্তনের কোনো তাগিদ নেই। বিষয়টিকে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা ক্ষমতাসীনদের দ্বিমুখীনীতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ১১৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়, বিচার কর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল-নির্ধারণ, পদোন্নতি দান ও ছুটি-মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলা বিধান সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত থাকবে। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় ফরমানের আদেশ নম্বর ৪-এর দ্বিতীয় তফসিল বলে সংবিধানের উপরি উক্ত ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয়। এতে সুপ্রিম কোর্টের পরিবর্তে বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা হয়। সংশোধনীতে উল্লেখ করা হয়, সুপ্রিম কোর্টের সাথে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তা প্রযুক্ত হবে। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলেও এই সংশোধনী সংবিধানে বহাল থাকে। বর্তমান সংবিধানের ৯৬(৩) অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, ‘একটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকিবে যাহা এই অনুচ্ছেদে ‘কাউন্সিল’ বলিয়া উল্লিখিত হইবে এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকের মধ্যে পরবর্তী যে দুইজন কর্মে প্রবীণ তাহাদের লইয়া গঠিত হইবে : তবে শর্ত থাকে যে, কাউন্সিল যদি কোন সময়ে কাউন্সিলের সদস্য এইরূপ কোন বিচারকের সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করেন, অথবা কাউন্সিলের কোন সদস্য যদি অনুপস্থিত থাকেন অথবা অসুস্থতা কিংবা অন্য কোন কারণে কার্য করিতে অসমর্থ্য হন তাহা হইলে কাউন্সিলের যাহারা সদস্য আছেন তাহাদের পরবর্তী যে বিচারক কর্মে প্রবীণ তিনিই অনুরূপ সদস্য হিসাবে কার্য করিবেন।’ ৯৬(৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কাউন্সিলের দায়িত্ব হইবেÑ (ক) বিচারকগণের জন্য পালনীয় আচরণ বিধি নির্ধারণ করা; এবং (খ) কোন বিচারকের অথবা কোন বিচারক যেরূপ পদ্ধতিতে অপসারিত হইতে পারেন সেইরূপ পদ্ধতি ব্যতীত তাঁহার পদ হইতে অপসারণযোগ্য নহেন এইরূপ অন্য কোন পদে আসীন ব্যক্তির সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করা। (৫) যে েেত্র কাউন্সিল অথবা অন্য কোন সূত্র হইতে প্রাপ্ত তথ্যে রাষ্ট্রপতির এইরূপ বুঝিবার কারণ থাকে যে কোন বিচারকÑ (ক) শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যরে কারণে তাঁহার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করিতে অযোগ্য হইয়া পড়িতে পারেন, অথবা (খ) গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হইতে পারেন, সেই েেত্র রাষ্ট্রপতি কাউন্সিলকে বিষয়টি সম্পর্কে তদন্ত করিতে ও উহার তদন্ত ফল জ্ঞাপন করিবার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন। (৬) কাউন্সিল তদন্ত করিবার পর রাষ্ট্রপতির নিকট যদি এইরূপ রিপোর্ট করেন যে, উহার মতে উক্ত বিচারক তাঁহার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে অযোগ্য হইয়া পড়িয়াছেন অথবা গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হইয়াছেন তাহা হইলে রাষ্ট্রপতি আদেশের দ্বারা উক্ত বিচারককে তাঁহার পদ হইতে অপসারিত করিবেন।’ সংবিধানের এই বিধান বিচার বিভাগের স্বাধীনতার েেত্র রাকবচ হিসেবে মনে করেন আইনজীবীরা। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের মামলায়ও আপিল বিভাগ তার রায়ে উল্লেখ করেছেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানের বিচারক অপসারণ পদ্ধতির যে প্রক্রিয়া তার চেয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান বিচার বিভাগের স্বাধীনতার েেত্র শ্রেয়তর। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করলেও আপিল বিভাগ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানটি অবৈধ ঘোষণা করেননি। পঞ্চদশ সংশোধন বিল পাসের জন্য গঠিত সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানটি রেখে দিয়ে সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদের সংশোধন করে। কিন্তু বর্তমান সরকার হঠাৎ করে ৯৬ অনুচ্ছেদটি সংশোধন করে ৭২-এর মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আইন কমিশনও এ-সংক্রান্ত ৭২-এর মূল অনুচ্ছেদে ফিরে যাওয়ার সুপারিশ করেছে। সরকার ৭২-এর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংযোজনের মাধ্যমে ওই সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বললেও বিচার বিভাগ সংক্রান্ত ১১৬ অনুচ্ছেদে কোনো পরিবর্তনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। অথচ বর্তমানে এই অনুচ্ছেদে যা যা বলা আছে তাও পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমেই আনা হয়। এতে বলা হয়, ‘বিচার-কর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্ব পালনে রত ম্যাজিষ্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল- নির্ধারণ, পদোন্নতি দান ও ছুটি মঞ্জুরীসহ) ও শৃংখলা বিধান রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রীম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে।’ অর্থাৎ মার্শাল ল’র সময় করা পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করার পাশাপাশি অধঃস্তন আদালতের বিচারকদের কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও ছুটি মঞ্জুরের বিষয়টি দেয়া হয় রাষ্ট্রপতির কাছে। এর আগে এই দায়িত্ব ছিল সুপ্রিম কোর্টের। সংসদের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের উদ্যোগের বিরোধিতা করে সাবেক প্রধান বিচারপতি মুস্তাফা কামাল ইতঃপূর্বে সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটির মতবিনিময় সভায় বলেছেন, সরকারের এই উদ্যোগ সংসদের মর্যাদাকে ুণœ করবে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে যদি আপনি (এমপি) একজন বিচারককে অভিশংসন করেন, তাহলে এটা হবে সংসদ সদস্যদের জন্য ব্যর্থতা ও মানহানিকর। আপনি কোনোভাবেই এই কাজ উপভোগ করতে পারেন না। তিনি আরো বলেন, সংসদ যদি এই ক্ষমতা পায় তাহলে একজন বিচারক কোনো কাজই করতে পারবেন না। ভারতের পার্লামেন্টের এই ক্ষমতা আছে। কিন্তু গত ৬০-৭০ বছরে সেখানে কতজন বিচারপতিকে অভিশংসন করা হয়েছে? সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল রাখার পক্ষে নিজের অবস্থান জানিয়ে তিনি আরো বলেন, সিভিল সার্ভিসে কেউ অসদাচরণ করলে তার সিনিয়র কর্মকর্তারা তার বিচার করেন; একইভাবে কোনো জেলা জজ কোনো অসদাচরণ করলে একজন সিনিয়র জেলা জজ তার বিষয়ে তদন্ত করেন। তবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পক্ষে বললেও এর কিছু দুর্বলতার কথাও বলেন তিনি। বলেন, কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ তদন্ত করতে এই কাউন্সিলের কোনো লোকবল নেই। ’৭২ সালের মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব সাংবাদিকদের বলেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানে দুই-তৃতীয়াংশ অনুমোদনের ভিত্তিতে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের যে বিধান ছিল, সংবিধান সংশোধন করে সেটিই আবার ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের পর পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’, ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ছাড়া ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের অনেক কিছুই ফিরিয়ে আনা হয়। এ ছাড়া বিচার বিভাগ সংক্রান্ত ৯৬ ও ১১৬ অনুচ্ছেদটি সামরিক শাসনামলে যেভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত ছিল সেভাবেই রয়ে যায়। এর মধ্যে ১১৬ অনুচ্ছেদটি রেখে শুধু ৯৬ অনুচ্ছেদটি সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার।
No comments:
Post a Comment