Wednesday, September 3, 2014

গৌরীপুর এখন 'ফকির মুল্লুক':কালের কন্ঠ

ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গত ৩০ জুন প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই কয়েক শ নারী-পুরুষ মানববন্ধন করে। তাদের ব্যানারে লেখা ছিল ‘...নব্য গডফাদার-গণদুশমন সাবেক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) মুজিবুর রহমান ফকির ও তাঁর দোসরদের গ্রেপ্তার করতে হবে’। মানববন্ধনে অংশ নেওয়া সবাই ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলা কিংবা ঢাকায় বসবাসরত গৌরীপুরের বাসিন্দা। এদের অনেকেই আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী বা সমর্থক। কর্ম
সূচির অন্যতম উদ্যোক্তা বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও আওয়ামী সাংস্কৃতিক জোটের কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট ফেরদৌস আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দুর্নীতি-জুলুমবাজি করে গৌরীপুরকে মগের মুল্লুক বানিয়েছেন এমপি মুজিবুর রহমান ফকির। এমন এমপি বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষতিকর, দেশের জন্য ক্ষতিকর। দলের হাইকমান্ড ও সরকারের সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি জানানোর জন্যই আমাদের এই মানববন্ধন কর্মসূচি।’ এর আগে গত ২৪ জুন এলাকার একজন সম্মানিত কলেজশিক্ষককে এমপির ক্যাডারদের দিগম্বর করার ঘটনায় গৌরীপুর উপজেলা সদরে নজিরবিহীন হরতাল পালিত হয়। হরতালের সমর্থনে মিছিল-সমাবেশ থেকে এমপি মুজিব ফকির ও তাঁর দোসরদের শাস্তি দাবি করা হয়। একই ঘটনায় ২৭ জুন গৌরীপুর উপজেলার বোকাইনগর গ্রামে এমপি ও তাঁর ক্যাডারদের শাস্তি দাবি করে এলাকাবাসী মিছিল করে। সেই মিছিলে অংশ নেওয়া গৌরীপুর আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আবদুল ওয়াদুদ বোকাইনগরী (৭০) কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমান এমপি রাজনীতিক নন। তাঁর দৌরাত্ম্যরে কারণে আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ লোকজন এখন নির্জীব হয়ে পড়ছেন।’ অনুসন্ধানে জানা যায়, ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনের আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য ক্যাপ্টেন (অব.) মুজিবুর রহমান ফকিরের বিরুদ্ধে তাঁর এলাকার দলীয় লোকজনসহ সাধারণ মানুষের এমন ক্ষোভ-বিক্ষোভের কারণ হলো এমপির বেপরোয়া ও দাম্ভিক আচরণ, রুচিহীন কথাবার্তা, প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার বিকৃত মানসিকতা, ক্যাডার পালন, জুয়া খেলায় মদদদান, ম্যুরাল তৈরির নামে চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম। বিগত মহাজোট সরকারের সময় মুজিবুর রহমান ফকির স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী হয়েই ক্ষমতার দাপট দেখাতে শুরু করেন। অপমান, অপদস্থ ও নির্যাতিত হতে হতে একপর্যায়ে স্থানীয় ত্যাগী নেতারা সাহস করে তাঁর বিরুদ্ধে জোট বাঁধেন। গত সংসদ নির্বাচনের আগে ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় গণভবনে তৃণমূলের বৈঠকে দলীয় সভাপতির সামনেই মুজিবুর রহমান ফকিরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ এনে মুখ খোলেন তৃণমূলের নেতারা। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিধুভূষণ দাস এ আসনে দলীয় প্রার্থী পরিবর্তনের দাবি জানান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন (অব.) মুজিবই দলীয় সমর্থন পান। নির্বাচনে জিতে ফের এমপি হয়েই তিনি হয়ে ওঠেন বেপরোয়া আর প্রতিশোধপরায়ণ। স্বরূপে ফিরে তিনি এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। এমপি হওয়ার কারণে স্থানীয় প্রশাসন তাঁর হাতের মুঠোয়। নিজের ভাতিজা ও দলীয় কিছু লোক দিয়ে গৌরীপুরের কলতাপাড়ায় গড়ে তুলেছেন ক্যাডারবাহিনী। প্রতিদ্বন্দ্বী নারী প্রার্থীকে নাজেহাল : গত সংসদ নির্বাচনে একই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন পারিবারিকভাবেই আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নাজনীন আলম। এ কারণে মুজিবুর রহমান ফকির প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হন তাঁর ওপর। নির্বাচনী প্রচারণাকালে প্রকাশ্যে নাজনীনের গাড়ি ভাঙচুর করে মুজিবের সমর্থকরা। বিস্ময়কর হলো, বিভিন্ন নির্বাচনী জনসভায় বিয়ে করার ঘোষণাসহ রুচিহীন ভাষায় নাজনীন আলমকে আক্রমণ করেন ক্যাপ্টেন (অব.) মুজিব। জনসভায়ই তিনি নির্বাচনের পর ভোটারদের ওই বিয়ে খাওয়ার দাওয়াত দিতে থাকেন। একজন জনপ্রতিনিধির এমন বক্তব্যে এলাকায় ছি ছি পড়ে যায়। নির্বাচনের পরও তিনি ওই নারী প্রার্থীকে নিয়ে অশোভন কথা বলতে থাকেন। গৌরীপুর পৌরসভার মেয়র সৈয়দ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নির্বাচনের পর গৌরীপুর ডাকবাংলোয় অনেক নেতা-কর্মীর উপস্থিতিতে নাজনীন আলমকে নিয়ে তিনি বিয়ের প্রসঙ্গ তোলেন। এরপর এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেও প্রকাশ্যে তিনি এ বিষয়ে রুচিহীন কথা বলেন। এসব কারণে আমি আর পরে এমপি মুজিবের সঙ্গে কোনো অনুষ্ঠানেই যাই না।’ স্কুলশিক্ষক খাদিজাতুল কোবরা বলেন, ‘নির্বাচনের পর গৌরীপুরের সিধলা ইউনিয়নের কবুলেন্নেছা বালিকা বিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণে আসেন এমপি মুজিব। সেখানে সবার সামনে তিনি নাজনীন আলমের বিষয়ে জানতে চান। একপর্যায়ে এমপি আমাকে (খাদিজাতুল) উদ্দেশ করে বলেন তাঁর দেওয়া বিয়ের প্রস্তাবে নাজনীন আলম রাজি কি না তা খোঁজ নিয়ে জানাতে।’ নাজনীন আলম বলেন, ‘উনি এমপি নির্বাচনে ভোট ডাকাতি করে পাস করেছেন। আর ওই সময় যারা আমাকে সমর্থন করেছিল, তাদের একে একে তিনি এখন দমন করছেন।’ নাজনীন আলম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘উনি নির্বাচনী প্রচারণায় আমার বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা বলেছেন। একজন নারী সম্পর্কে প্রকাশ্যে ওই সব কথা কোনো সভ্য মানুষ বলতে পারে না।’ প্রতিপক্ষ পীড়নের বিকৃত পন্থা : এমপি হয়েই মুজিব ফকির তাঁর প্রতিপক্ষকে শিক্ষা দেওয়ার ‘বিকৃত’ পথ বেছে নেন। অভিযোগ আছে, সংসদ নির্বাচনের পরপরই স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার অভিযোগে ভাংনামারীর ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুজ্জামান ছোটনের মাথা প্রকাশ্যে ন্যাড়া করে দেওয়া হয়। গত ২২ এপ্রিল এমপির অপছন্দের ব্যক্তিকে অতিথি করায় ডৌহাখলা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বিল্লাল হোসেনকে কলতাপাড়ায় এমপির ব্যক্তিগত কার্যালয় ‘সেবালয়’-এ নিয়ে পেটানো হয়। বিল্লালকে স্কুল থেকে এমপি নিজেই তাঁর গাড়িতে করে সেবালয়ে নিয়ে যান। পরে মাথা ন্যাড়া করার জন্য নাপিত ডাকা হলে ওই শিক্ষক অজ্ঞান হয়ে পড়লে পরে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। শিক্ষকের ঘনিষ্ঠজনরা জানান, এ ঘটনায় বিল্লাল হোসেন বিচার তো চাইতেই পারেননি, এমনকি একটি পত্রিকায় এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলে বিল্লালকে লিখিত দিতে বাধ্য করা হয় যে নির্যাতনের ঘটনাটি মিথ্যা। নির্বাচনে মুজিবের পক্ষে কাজ না করায় সিধলা ইউনিয়নের মাদ্রাসাশিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেনকে মইলাকান্দা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। গত ১৪ মে ডৌহাখলার বিএনপিকর্মী মোকসেদুলের (২৩) মাথা ন্যাড়া করে কলতাপাড়া বাজার ঘুরিয়ে পরে তাঁকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। কালের কণ্ঠকে মোকসেদুল জানান, ১৪ মে ঘটনার চার দিন আগে এলাকার একজন তাঁকে আওয়ামী লীগে যোগ দিতে বলে। নইলে সমস্যা হবে বলে হুমকি দেয়। এরপর বাবু নামের একজন আওয়ামী লীগকর্মী তাঁর কাছে এসে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। তিনি তখন বলেন, এটা কি মগের মুল্লুক নাকি? এরপর ১৪ মে স্থানীয় রায়গঞ্জ বাজার থেকে এমপি মুজিবের উপস্থিতিতে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের লোকজন তাঁকে ধরে সেবালয়ে নিয়ে যায়। সেখানে তাঁর মাথা ন্যাড়া ও নির্যাতন করে পরে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ তিনটি মামলায় আসামি করে তাঁকে আদালতে চালান দেয়। অথচ কোনো মামলার এজাহারেই তাঁর নাম ছিল না। ২০ দিন পর তিনি জামিনে বেরিয়ে আসেন। মোকসেদুল জানান, সাংবাদিকদের কাছে ঘটনা জানানোর কারণে তিনি হুমকিতে আছেন। ভয়ে বাড়ি থেকে বের হতে পারেননি। গত ১৬ মার্চ কলতাপাড়ায় সেবালয়ের সামনে ডৌহাখলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদকে লোহার রড দিয়ে নির্যাতন করে পা ভেঙে দেওয়া হয়। আবু সাঈদ বলেন, এমপি মুজিব ফকিরের ক্যাডাররাই এ ঘটনা ঘটায়। তিনি হামলাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করলেও পুলিশ নীরব। আবু সাঈদ আরো বলেন, তিনি শুনেছেন তাঁর দলীয় পদে আরেকজনকে দেওয়া হয়েছে, যদিও এ ব্যাপারে তিনি কোনো চিঠি পাননি। ‘সেবালয়’ এখন টর্চার সেল, নেতৃত্বে এমপির ভাতিজারা : ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ সড়কের কলতাপাড়া বাজারে ২০-২৫ বছর আগে মুজিব ফকির বিশ্রামের জন্য তৈরি করেন ‘সেবালয়’ নামের একটি টিনশেড বাড়ি। সেবালয়ে সেবার কোনো নামগন্ধ না থাকলেও ভবনটি এখন এমপির ক্যাডারদের টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। গত কয়েক বছরে কলতাপাড়া বাজারে যাদের নির্যাতন করা হয়েছে, তাদের সবাইকে ঘটনার আগে বা পরে সেবালয়ে এনে আটকে রাখা হয়েছে। আর নির্যাতনের সব ঘটনার হোতা হিসেবে ভূমিকা রাখছে এমপির ভাতিজা আতাউর রহমান ফারুক। জানা গেছে, সালিস-দরবার, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে ফারুক এখন কয়েক কোটি টাকার মালিক। সে-ই তার বাহিনী দিয়ে এমপির নির্দেশে লোকজনকে শায়েস্তা করে। এলাকাবাসী জানায়, এমপির আরো দুই অত্যাচারী ভাতিজা আছে- শহীদ মাস্টার ও দীপু। গত ৪ জুলাই রাতে কলতাপাড়ার কাছে গাজীপুর বাজারে আওয়ামী লীগ নেতা সামিউল আলম লিটনের ওপর হামলা হয়। অভিযোগ আছে, এ হামলায়ও নেতৃত্ব দেয় এমপির ভাতিজারা। সামিউল আলম লিটন বলেন, এমপির উপস্থিতিতে তাঁর ভাতিজা ফারুকসহ শহীদ, রতন, দীপু, সাত্তার, বারেক, আকরাম মেম্বার প্রমুখ ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ সড়কের গাজীপুরে তাঁর ওপর হামলা করে। সর্বশেষ গত ২২ জুন আওয়ামী লীগের সাবেক উপজেলা সাধারণ সম্পাদক, বর্তমানে মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষক ফরিদ উদ্দিন আহম্মেদকে সেবালয়ে নিয়ে দিগম্বর করা হয়। ফরিদ উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাকে সেবালয়ে নিয়ে গিয়ে অপদস্থ করা হয়। সেখান থেকেই ক্যাডাররা মোবাইল ফোনে এমপির সঙ্গে কথা বলে। এমপি তাদের বলে যে তারা যেন ঘটনার ছবি তুলে রাখে। তখন ক্যাডাররা বলে, ছবি তুলেছি। এরপর এমপি আমাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেন।’ ফরিদ উদ্দিন বলেন, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল, আকরাম মেম্বারসহ এমপির ক্যাডাররা এ ঘটনায় জড়িত। তিনি এদের বিরুদ্ধে থানায় মামলাও করেছেন। ডৌহাখলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ বলেন, এমপির ক্যাডার কলতাপাড়া এলাকায় জনাব আলী, হেলাল, আজিজ, কাদের প্রমুখ তাঁর ওপর হামলা করে। সারা বছর জুয়ার আসর : গৌরীপুরের গোহাটা, সহনাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দুলালের বাড়ি, সোনাকান্দি গ্রাম, রামগোপালপুর ইউনিয়নের বাহাদুর গ্রাম, মইলাকান্দাসহ বিভিন্ন স্থানে সপ্তাহব্যাপী-মাসব্যাপী জুয়ার আসর বসে। এর বিরোধিতা করায় মাওয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক খসরুজ্জামান বাবুলকে সম্প্রতি কমিটি থেকেই অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। খসরুজ্জামান বাবুল জানান, তিনি ও সভাপতিসহ স্থানীয় নাগরিকরা ইউএনওর কাছে এলাকায় জুয়া খেলার বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। এরই জের ধরে তাঁদের কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। গত ২ জুলাই মাওহা ইউনিয়ন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রমিজ উদ্দিন স্বপনের বাড়ির পাশের জুয়া খেলার জায়গায় অভিযান চালিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ছয়টি মোটরসাইকেল আটক করে। উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাসুম আলী বেগ এ ব্যাপারে বলেন, তাঁরা গোপন সূত্রে খবর পেয়ে এ অভিযান চালান। তবে বাড়ির পাশে জুয়া খেলা হলেও তা জানতেন না বলে দাবি করেন আওয়ামী লীগ নেতা রমিজ উদ্দিন স্বপন। জুয়ার মাধ্যমে এমপির টাকা কামাইয়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে গৌরীপুর পৌরসভার মেয়র সৈয়দ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি গত মার্চে স্থানীয় রাজনীতিকদের এবং এমপির চাপে পৌরসভায় এক প্রদর্শনীর অনুমতি দিতে বাধ্য হই। সে সময় এমপি মুজিবুর রহমান ফকিরকে প্রতি রাতে ৫০ হাজার টাকা লোক মারফত পৌঁছে দিতে হতো। যে লোক টাকা নিয়ে যেত, তার নাম এমপি নিজেই বলে দিয়েছিলেন। আর এমপির ঘনিষ্ঠ হিসেবে একটি জাতীয় দৈনিকের স্থানীয় এক সাংবাদিককেও দৈনিক পাঁচ হাজার টাকা দিতে হতো।’ ১২ দিন ওই প্রদর্শনী চলে বলে মেয়র জানান। ম্যুরালের নামে চাঁদাবাজি : এমপির ক্যাডারদের হাতে লাঞ্ছনার শিকার কলেজশিক্ষক ফরিদ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, বোকাইনগর মাদ্রাসার দুজন শিক্ষকের কাছে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার আবক্ষ ম্যুরাল তৈরির নাম করে এমপি দুই লাখ করে চার লাখ টাকা দাবি করেন। কিন্তু তিনি (ফরিদ উদ্দিন) সেই টাকা দিতে নিষেধ করেছিলেন। এ টাকা না পেয়েই ক্ষুব্ধ এমপি তাঁর ক্যাডারদের দিয়ে তাঁকে হেনস্তা করান। ম্যুরালের বিষয়ে পৌর মেয়র বলেন, কোনো অনুমতি ছাড়া পৌরসভার ভেতরে একটি সরকারি পুকুর ভরাট করে এমপি এটি তৈরি করেছেন। এর কারণে ওই এলাকায় ভবিষ্যতে জনদুর্ভোগের সৃষ্টি হতে পারে। তিনি বিষয়টি লিখিতভাবে স্থানীয় সরকার বিভাগে জানাবেন। ম্যুরালের নামে এমপির চাঁদাবাজি থেকে রেহাই পাচ্ছেন না ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানরাও। বোকাইনগর ইউপি চেয়ারম্যান হাবিবুল ইসলাম খান শহীদ বলেন, ম্যুরালের জন্য কর্মসৃজন প্রকল্প থেকে ২০ শতাংশ হারে এমপিকে টাকা দিতে হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে এমপির বরাত দিয়ে আওয়ামী লীগের লোকজনের টাকা দাবির কথা স্বীকার করেন মইলাকান্দা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রিয়াদুজ্জামান রিয়াদও। আওয়ামী লীগেই বিক্ষোভ : গত ২৬ জুন গৌরীপুরে দলীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপজেলা কমিটির সভায় এমপি মুজিবকে দলীয় সভাপতির পদ থেকে অব্যাহিত দেওয়া হয়। ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় সিনিয়র সহসভাপতি ডা. হেলাল উদ্দিনকে। রাত ৯টার দিকে যখন এ খবর গৌরীপুর উপজেলা সদরে মাইকিং করে প্রচার করা হয়, তখন স্থানীয় জনগণ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। ওই সভার কার্যবিবরণী সূত্রে জানা গেছে, সভায় ৪৯ জন সদস্যের উপস্থিতিতে ১৬ জন নেতা বক্তব্য দেন। সাধারণ সম্পাদক বিধুভূষণ দাস বলেন, সভার সিদ্ধান্ত ঊর্ধ্বতন কমিটিগুলোতে পাঠানো হয়েছে। এদিকে স্থানীয় ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতারাও এমপি মুজিবের শাস্তি চেয়ে দলীয় প্রধান বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন। দলের বাইরে এলাকাবাসীও এবার এমপি মুজিবের অপকর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে মাঠে নেমেছে। কলেজশিক্ষকের সম্মানহানির প্রতিবাদে গৌরীপুরে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। বোকাইনগরসহ উপজেলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকায় এমপি ও তাঁর ক্যাডারবাহিনীর শাস্তি দাবি করে মিছিল-মিটিং হয়। গত ৩০ জুন ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ‘বিক্ষুব্ধ গৌরীপুরবাসী’র ব্যানারে এমপি মুজিবের শাস্তি দাবি করে মানববন্ধন করা হয়। এমপি ও গত ৪ জুলাই সন্ধ্যার দিকে এমপি সমর্থকদের কয়েকটি বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর করে বিক্ষুব্ধ পক্ষ। এমপির সাবেক এপিএস আবু কায়সার রন্টির বাড়ির ফটক, এমপির ভাতিজা দীপুর প্রাইভেট কার ও আওয়ামী লীগ নেতা রঞ্জন সরকারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও হামলা চলে। ‘আমার বিরুদ্ধে একটি মহল মাঠে নেমেছে’ : অভিযোগের ব্যাপারে বক্তব্য নেওয়ার জন্য এই প্রতিবেদক একাধিকবার ফোন করলেও এমপি মুজিবুর রহমান ফকির ফোন ধরেননি। পরে একদিন ময়মনসিংহ শহরের আকুয়ায় তাঁর বাসভবনে গেলে কর্মচারীরা প্রথমে প্রতিবেদকের পরিচয় জেনে ভেতরে যান। ফিরে এসে বলেন, ‘এমপি সাহেব বাসায় নেই।’ অগত্যা গত ২৯ আগস্ট কালের কণ্ঠের ঢাকা অফিস থেকে বারবার ফোন করা হলে একবার এমপি মুজিব ফকির ফোন ধরেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কখনো দুর্নীতি করিনি, দুর্নীতিকে প্রশ্রয়ও দিইনি। নিজের জমি বিক্রি করে ম্যুরাল তৈরি করেছি। জমি বিক্রির দলিলও দেখে যেতে পারেন।’ তিনি বলেন, ‘রাজনীতি করি স্বচ্ছভাবে। তবে আমার বিরুদ্ধে একটি মহল বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে মাঠে নেমেছে, আমি জানি। আমার কোনো টর্চার সেল নেই। আমাদের পরিবারে দ্বিতীয় বিয়ে করার কোনো নজির নেই। এগুলো অপপ্রচার।’ আরো অভিযোগের বিষয় তুললে এমপি বলেন, ‘আমি আর কোনো কথা বলতে চাই না।’

No comments:

Post a Comment