বিগত সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান এবং সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। বৃহস্পতিবার রাজধানীর রমনা মডেল থানায় একযোগে তিনটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় তিনজনের বিরুদ্ধেই জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ আনা হয়েছে। মান্নান খানের অবৈধ সম্পদের অধিকাংশই তার স্ত্র
ী সৈয়দা হাসিনা সুলতানার নামে। মামলায় তার স্ত্রীর বিষয়টি আনা হয়নি। শিগগিরই মান্নান খানের স্ত্রীর বিরুদ্ধেও মামলা করা হবে। দুদকের অনুসন্ধানে মাহবুবুর রহমানের স্ত্রী প্রীতি হায়দারেরও বিপুল অবৈধ সম্পদের তথ্য মিলেছে। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বিপুল অর্থ-সম্পদ রয়েছে আবদুর রহমান বদির স্ত্রী শাহিনা আক্তার সাকীর নামেও। এদের বিরুদ্ধেও পৃথক মামলার প্রস্তুতি চলছে। সরকারদলীয় আলোচিত সাত ভিআইপির মধ্যে প্রথম মামলা হল এ তিনজনের বিরুদ্ধে। বৃহস্পতিবার সকালে দুদকের তিন সদস্যের কমিশন এদের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়টি অনুমোদন দেয়। দুদকের উপপরিচালক মোঃ নাসির উদ্দিন বাদী হয়ে আবদুল মান্নান খানের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলার বাদী উপপরিচালক মোঃ খায়রুল হুদা। আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে মামলা করেন উপপরিচালক মোহাম্মদ আবদুস সোবহান। দুদকের মামলায় মান্নান খানের বিরুদ্ধে অসদুপায়ে ৭৫ লাখ ৪ হাজার ২৬২ টাকার সম্পদ অর্জন এবং ৪ লাখ ৫৯ হাজার ৫৯৭ টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ আনা হয়েছে। মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে ৫ কোটি ১৯ লাখ ৫০ হাজার টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং ১ কোটি ২৪ লাখ ৪০ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগ তোলা হয়েছে। ১০ কোটি ৮৬ লাখ ৮১ হাজার ৬৬৯ টাকার সম্পদ গোপন এবং ১ কোটি ৯৮ লাখ ৩৩৭৫ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের অভিযোগ আনা হয়েছে কক্সবাজার ৪-এর সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে। দুদক সূত্র জানায়, একযোগে দায়ের করা তিন মামলার এখন তদন্ত হবে। তদন্তে এর বাইরে আরও সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেলে সেগুলোও চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত হবে। অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান : মান্নান খানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪’র ২৬(২) এবং ২৭(১) ধারায় মামলা (৩৫) করা হয়। এজাহারে উল্লেখ করা হয়, মান্নান খান মালিকানাধীন ৯৬ লাখ ৮৯ হাজার ৯৫৯ টাকার স্থাবর সম্পদের মধ্যে ৪ লাখ ৫৯ হাজার ৫৯৭ টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন, যা দুদক আইনের ২৬(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তিনি অসদুপায়ে ৭৫ লাখ ৪ হাজার ২৬২ টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন, যা দুদক আইনের ২৭(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এজাহারে আরও বলা হয়, আবদুল মান্নান খান ৯ এপ্রিল ২০১৪ দুদক সচিব বরাবর সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন। দাখিল করা বিবরণীতে তিনি ২ কোটি ২২ লাখ ৯৬ হাজার ৩১৬ টাকার স্থাবর সম্পদ এবং ৯৩ লাখ ৫ হাজার ৩৬২ টাকার অস্থাবর সম্পদ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। কোনো দায়দেনা নেই। সম্পদ বিবরণী পর্যালোচনায় দেখা যায়, তার মালিকানাধীন উল্লিখিত মূল্যের স্থাবর সম্পদের মধ্যে নিজস্ব অর্থায়নে ক্রয়কৃত স্থাবর সম্পদের মূল্য ৪১ লাখ ১০ হাজার টাকা। অস্থাবর সম্পদের মূল্য ৯২ লাখ ৩০ হাজার ৩৬২ টাকা। তার নিজস্ব অর্থায়নে ক্রয়কৃত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মোট মূল্য ১ কোটি ৩৩ লাখ ৩০ হাজার ৩৬২ টাকা। অথচ তিনি সম্পদ বিবরণীতে নিজস্ব অর্থায়নে ক্রয়কৃত সম্পদের মূল্য ৯২,৩০,৩৬২ টাকা উল্লেখ করেছেন। ফলে মান্নান খান দুদকে দাখিল করা বিবরণীতে ৪ লাখ ৫৯ হাজার ৫৯৭ টাকা মূল্যের সম্পদের তথ্য গোপন করে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর ২৬(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। মান্নান খানের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন সম্পর্কে বলা হয়, মান্নান খানের মালিকানাধীন ১ কোটি ৩৮ লাখ ১৩৭ টাকা মূল্যের সম্পদ অর্জনকালীন তার জ্ঞাত আয়ের পরিমাণ ছিল ৬২ লাখ ৯৫ হাজার ৮৭৫ টাকা, যা তার ১ কোটি ৩৮ লাখ ১৩৭ টাকা মূল্যের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জনের জন্য আয়ের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ফলে তিনি অসদুপায়ে ৭৫ লাখ ৪ হাজার ২৬২ টাকা মূল্যের মালিকানা অর্জন করে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর ২৭(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। দুদক আইন ২৬(২) ধারায় অপরাধ প্রমাণিত হলে ৩ বছর এবং ২৭(১) ধারায় অপরাধ প্রমাণিত হলে ৭ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। আবদুল মান্নান খানের অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদের অধিকাংশই স্ত্রী সৈয়দা হাসিনা সুলতানার নামে। বৃহস্পতিবার দায়ের করা এ মামলায় তার স্ত্রীর বিষয়টি আনা হয়নি। তবে শিগগিরই মান্নানের স্ত্রীর বিরুদ্ধেও মামলা করা হবে বলে জানিয়েছে দুদক সূত্র। মাহবুবুর রহমান : সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী এবং পটুয়াখালী-৪ আসনের এমপি মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা (নং ৩৬) এজাহারে উল্লেখ করা হয়, অনুসন্ধানকালে মাহবুবুর রহমানের আয়কর নথি পর্যালোচনা করে ৫ কোটি ১৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা আয়ের কোনো বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণ বা বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি। তিনি আয়কর নথির মাধ্যমে এ অর্থের বৈধতা নেয়ার অপচেষ্টা করেছেন মাত্র। সুতরাং উল্লিখিত পরিমাণ অর্থ তার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত মর্মে প্রতীয়মান হয়। এজাহারে আরও বলা হয়, ১৩ ফেব্র“য়ারি ২০০৮ ও ২০১৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দাখিল করা হলফনামা নির্বাচন কমিশন থেকে সংগ্রহ করা হয়। ২০০৮ সালের হলফনামা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তিনি নিজ নামে ৫০ লাখ ৮৮ হাজার ১১২ টাকার সম্পদের মালিক ছিলেন। ২০১৩ সালের হলফনামা পর্যালোচনায় দেখা যায়, নিজ নামে ৬ কোটি ৩৫ লাখ ৫১২ টাকার সম্পদের মালিকানা অর্জন করেছেন। ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে ৫ কোটি ৮৪ লাখ ১২ হাজার ৪শ’ টাকার মালিক হয়েছেন। দুদকের অনুসন্ধানে মাহবুবুর রহমানের নিজ নামে ঋণ বাদে ৬ কোটি ৪১ লাখ ৭১ হাজার ৪৪১ টাকার সম্পদের প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে অসাধু উপায়ে এ পরিমাণ সম্পদের মালিকানা অর্জন করেছেন মর্মে প্রমাণ হয়। দুদকের অনুসন্ধানে মাহবুবুর রহমানের স্ত্রী প্রীতি হায়দারের নামে বিপুল সম্পদ বেরিয়ে এলেও এ মামলায় তার প্রসঙ্গও আনা হয়নি। এ জন্য পৃথক মামলার প্রস্তুতি চলছে। আবদুর রহমান বদি : সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার (নং-৩৭) এজাহারে উল্লেখ করা হয়, বদি চলতি বছর ১৪ মার্চ সম্পদ বিবরণী নোটিশ গ্রহণ করেন। ২০ মার্চ সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন। দাখিল করা বিবরণীতে তিনি নিজ, স্ত্রী ও সন্তানদের নামে ৫ কোটি ২০ লাখ ১৪ হাজার ৫৩৮ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ উল্লেখ করেছেন। বিবরণী যাচাই করে দেখা যায়, আবদুর রহমান বদি ২১ নভেম্বর ২০১৩ আয়কর কর্তৃপক্ষের কাছে ৩০-০৬-২০১৩ তারিখ পর্যন্ত অর্জিত আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন। এ থেকে জানা যায়, তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মূল্য ১৬ কোটি ৬ লাখ ৯৬ হাজার ২০৭ টাকা। এতে স্পষ্ট প্রমাণ হয় যে, সংসদ সদস্য বদি অসদুদ্দেশ্যে ১০ কোটি ৮৬ লাখ ৮১ হাজার ৬৬৯ টাকা মূল্যমানের সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন, যা দুদক আইন-২০০৪ এর ২৬(২) ধারায় দণ্ডনীয় অপরাধ। বদি দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে সম্পদের উৎস হিসেবে আমদানি-রফতানি ব্যবসার কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এ ব্যবসা থেকে প্রাপ্ত লাভ-ক্ষতির কোনো দালিলিক প্রমাণ তিনি অনুসন্ধানকালে দেখাতে পারেননি। বদি কক্সবাজার টেকনাফ উপজেলার সাবরেজিস্ট্রি অফিসের দলিল নং-১০৬৩/১২-তারিখ-২৭/০৩/২০১৪ সালে কক্সবাজারে ৬০ শতক নাল জমি রেজিস্ট্রি খরচসহ ৪১ লাখ ৯৬ হাজার ৬২৫ টাকায় ক্রয় করেন। ৮ মাস ৮ দিন পর এ জমি তিনটি পৃথক দলিলে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকায় বিক্রি দেখান, যা ক্রয় মূল্যের চেয়ে ১ কোটি ৯৮ লাখ ৩ হাজার ৩৭৫ টাকা বেশি। এতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, অবৈধভাবে অর্জিত জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অর্থকে বৈধতা দেয়ার জন্য বর্ণিত জমির মূল্য অস্বাভাবিক বেশি দেখিয়েছেন তিনি। অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় নিজের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ উল্লেখ করেছেন ৪৯ লাখ ৭৯ হাজার ৪৪০ টাকা। ২০১৩ সালের নির্বাচনের হলফনামায় সম্পদের পরিমাণ উল্লেখ করেছেন ১৬ কোটি ৬ লাখ ৯৬ হাজার ২০৭ টাকা, যা আগের তুলনায় ১৫ কোটি ৫৭ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৭ টাকা বেশি। বদি অর্জিত এ অর্থের কোনো বৈধ উৎস দেখাতে পারেননি, যা দুদক আইন-২০০৪’র ২৭(১) ধারায় দণ্ডনীয় অপরাধ। দুদকের অনুসন্ধানে বদির স্ত্রী শাহিনা আক্তার সাকীর নামে বিপুল জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অর্থ-সম্পদের তথ্য পেলেও মামলায় তাকে আসামি করা হয়নি। তার বিরুদ্ধে পৃথক মামলার প্রস্তুতি চলছে।
No comments:
Post a Comment