দেশের উচ্চ ও নি¤œ আদালতে বিচারকদের নিয়োগ হয় প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশক্রমে। এবার বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতা সংসদে যাচ্ছে। এটা করা হলে উচ্চ ও নি¤œ আদালতে বিচারক নিয়োগ এবং অপসারণ দু’টিই হবে নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্বে। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো মতামত দিতে পারেন না। আর ১৯৯০ সালের পর থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধানই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমান সংসদের
পরিস্থিতিও একই। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছানুযায়ীই বিচারপতিদের অপসারিত হতে হবে। আবার তারা নিয়োগও পাবেন তারই সুপারিশের ভিত্তিতে। বাংলাদেশের সংবিধানে স্বাধীন বিচার বিভাগের কথা উল্লেখ আছে। সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।’ সে মতে ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক ঘোষণা করা হয়। কিন্তু দীর্ঘ সাত বছরেও দেশে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক কোনো সচিবালয় গড়ে ওঠেনি। দেশের প্রধান বিচারপতিসহ এই অঙ্গনের সাথে সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন সময় বলেছেন, পৃথক সচিবালয় ছাড়া বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সম্ভব নয়। আমাদের সংবিধানের চতুর্থ অংশে বিচার বিভাগের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানে বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ স্তর হলো দেশের সুপ্রিম কোর্ট, যা অ্যাপিলেট ডিভিশন ও হাইকোর্ট ডিভিশন নিয়ে গঠিত। প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগেই বিচারপতি নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। প্রধান বিচারপতি নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ গ্রহণের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই রাষ্ট্রপতির। তবে অন্য বিচারপতিদের নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতেই হয়। আর এসব বিচারপতিদের মধ্য থেকেই প্রয়োজনের সময় প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করতে হয়। সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করিবেন।’ এখন আবার সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতা সংসদে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এই সংশোধনীর খসড়া ইতোমধ্যে মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বর মাসে সংসদের যে অধিবেশন বসবে তাতে এই খসড়া উপস্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। এটি সংসদে পাস হলে বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা পাবে সংসদ। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ‘(২) প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে কারণে সংসদের মোট সদস্যসংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোনো বিচারককে অপসারণ করা যাবে না।’ আমাদের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদিÑ (ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোন নির্বাচনে সংসদ সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।’ অর্থাৎ দলের বিপক্ষে কেউ ভোট দিলে তার সংসদ সদস্যপদ বাতিল হবে। সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের কারণে কোনো সংসদ সদস্যই দলের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান নিতে পারেন না। আর এ দেশে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধানই দেশের প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সে জন্য বিচারকদের নিয়োগ এবং অপসারাণ নির্বাহী প্রধানের অভিপ্রায়ের ওপর নির্ভরশীল। দেশের নি¤œ আদালতগুলো উচ্চ আদালতের অধীন করে দেয়া হলেও সেখানে নিয়োগ, কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও ছুটি মঞ্জুরের মতো বিষয়গুলো রাষ্ট্রপতির অধীন। আবার রাষ্ট্রপতি এসব দায়িত্ব পালনকালে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ গ্রহণ করবেন। সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘হাইকোর্ট বিভাগের অধঃস্তন সব আদালত ও ট্রাইব্যুনালের ওপর উক্ত বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ মতা থাকিবে।’ কিন্তু সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বিচার বিভাগীয় পদে বা বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনকারী ম্যাজিস্ট্রেট পদে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক উক্ত উদ্দেশ্যে প্রণীত বিধিসমূহ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নিয়োগদান করিবেন।’ এবং ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল- নির্ধারণ, পদোন্নতিদান ও ছুটি মঞ্জুরসহ) ও শৃংখলাবিধান রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রিম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে।’ এসব নিয়োগ, কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও ছুটি মঞ্জুরের মতো বিষয়গুলো রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত থাকলেও তাকে এসব কাজ করতে হয় নির্বাহী বিভাগের পরামর্শক্রমে। সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘(২) রাষ্ট্রপ্রধানরূপে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অন্য সকল ব্যক্তির ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করিবেন এবং এই সংবিধান ও অন্য কোন আইনের দ্বারা তাঁহাকে প্রদত্ত ও তাঁহার উপর অর্পিত সকল মতা প্রয়োগ ও কর্তব্য পালন করিবেন। (৩) এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ত্রে ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।’ এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের সংবিধান অনুসারে প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ব্যতীত সব দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুসারে কাজ করতে হয়। তাই নি¤œ আদালতে বিচারক নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে হলেও তাদের অন্যান্য কার্যক্রম, উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ সবই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে হয়। আর যেহেতু ৭০ অনুচ্ছেদ মতে আমাদের সংসদ সদস্যরা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারেন না, সে জন্য দলের ইচ্ছাতেই অপসারিত হবেন বিচারপতিরা। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে মতামত দিতে পারেন। তাই বলা যায়, এই সংশোধনী পাস হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলে আর কিছু থাকবে না।
No comments:
Post a Comment