অস্ত্র ও বিস্ফোরকঘটিত অপরাধের বিস্ফোরণ ঘটেছে। আগের বছরের তুলনায় ২০১৩ সালের জুলাই থেকে গত জুন পর্যন্ত এক বছরে অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংক্রান্ত অপরাধ বেড়েছে প্রায় ৭৬ শতাংশ। একই সময়ে খুন, ডাকাতি, রাহাজানি, নারী নির্যাতনসহ প্রায় সব ধরনের অপরাধ বেড়েছে। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংক্রান্ত অপরাধ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্বাচনী সহিংসতা এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট গোল
যোগ মোকাবিলায় ব্যস্ত রাখায় এ ধরনের অপরাধ বেড়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান। পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংক্রান্ত অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাদের যথাযথ দায়িত্বে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন। পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধারের আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা। রাজনৈতিক বিবেচনায় অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া বন্ধের তাগিদও দিয়েছেন তাঁরা। ২০১৩ সালের জুলাই থেকে গত জুন পর্যন্ত এক বছরে সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত এক বছরে সংঘটিত অপরাধের তুলনা করলে দেখা যায়, অস্ত্র ও বিস্ফোরক-অপরাধ বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। ২০১৩-১৪ বছরে অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংক্রান্ত অপরাধ হয়েছে ৯৫১টি। আর আগের বছর এ-সংক্রান্ত অপরাধ হয়েছিল ৫৪১টি। অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংক্রান্ত অপরাধ বেড়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, শুধু অস্ত্র ও বিস্ফোরক-অপরাধই বাড়েনি; গত দুই বছরের অপরাধ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রায় সব ধরনের অপরাধই বেড়েছে। এসবের মধ্যে অস্ত্র ও বিস্ফোরক-অপরাধ বেশি বেড়েছে। এ ধরনের অপরাধ বাড়ার কারণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অন্যান্য কাজে ব্যস্ত ছিল। তারা শুধু তাদের দৈনন্দিন কাজে নিয়োজিত ছিল না। তারা ব্যস্ত ছিল নির্বাচন ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা মোকাবিলায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ কাজে ব্যস্ত ছিল বলেই খুন, নারী নির্যাতন বেড়েছে। এসব অপরাধের সঙ্গে অস্ত্র ও বিস্ফোরক-অপরাধও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। গত মে-জুন মাসেও অপরাধ বেড়েছে র্যাবের কার্যক্রম সীমিত করায়। সাবেক এ সেনা কর্মকর্তার মতে, অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংক্রান্ত অপরাধকে নিয়ন্ত্রণে নিতে হলে দ্রুত অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। অবৈধ অস্ত্র শনাক্ত করতে সমন্বিত বিশেষ টিমকে দায়িত্ব দিতে হবে। আর রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে অস্ত্রের লাইসেন্স দিতে হবে। পাশাপাশি র্যাবকে আগের মতো কার্যকর করার কথাও বলেন তিনি। সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে গত এক দশকে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। একটির বেশি অস্ত্র না দেওয়ার সিদ্ধান্ত থাকলেও তা মানা হয়নি। প্রভাবশালীরা দাপট দেখিয়ে একাধিক অস্ত্র নিয়েছে। এসব অস্ত্রের অপব্যবহার হয়েছে নানাভাবে। নারায়ণগঞ্জের সাম্প্রতিক সাত খুনের ঘটনায় দায়ের করা মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের দুটি অস্ত্রের লাইসেন্স ছিল। লাইসেন্স বাতিল হলেও নূর হোসেন সেগুলো জমা দেননি। সম্প্রতি দুটি অস্ত্রের একটি গুলিভর্তি অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে রাজধানীর মালিবাগ লেভেলক্রসিং থেকে। ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষজনিত দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত একটি প্রাইভেট কার থেকে পিস্তলটি উদ্ধার করা হয়। সেটি বহন করছিলেন নূর হোসেনের শ্যালক। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর সরকারের জন্য অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংক্রান্ত অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ গত পাঁচ বছরের মধ্যে ওই সময় অস্ত্র ও বিস্ফোরক-অপরাধ ছিল সবচেয়ে বেশি। ধীরে ধীরে তা কমে আসে। ২০০৯-১০ সালে এক হাজার ৯৬৮টি অস্ত্র ও বিস্ফোরক-অপরাধ হয়েছিল। কমতে কমতে ২০১২-১৩ সালে সে সংখ্যা ৫৪১-এ নেমে আসে। সেখান থেকে ৭৬ শতাংশ বেড়ে ২০১৩-১৪ সালে সংখ্যাটি ৯৫১-এ এসে দাঁড়ায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যুদ্ধাপরাধের বিচার বা নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার জন্য অস্ত্র ও বিস্ফোরক-অপরাধ বেড়ে যাওয়ার কথা বললেও উল্লিখিত সময়ে সব ধরনের অপরাধই বেড়েছে। দেশের বৈধ ও অবৈধ কোনো অস্ত্রেরই সমন্বিত হিসাব নেই সরকারের কাছে। বৈধভাবে পিস্তল ও রিভলবার রাখার অনুমোদন দেওয়া হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। শটগান ও অন্যান্য অস্ত্রের লাইসেন্স দিয়ে থাকেন জেলা প্রশাসক। কিন্তু কোন জেলায় কত বৈধ অস্ত্র রয়েছে সে-বিষয়ক সঠিক তথ্য নেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। অর্থাৎ ১৯৭১ সাল থেকে এ পর্যন্ত যত অস্ত্রের অনুমতি দেওয়া হয়েছে এর যথাযথ খতিয়ান মন্ত্রণালয়ে নেই। বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েও শেষ পর্যন্ত এ বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারেনি সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত যত অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, সে-সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষিত আছে জেলা প্রশাসনের কাছে। তবে কত লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে বা কত লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে তার হিসাব নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, দেশে কতগুলো অস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে এর হিসাব তাৎক্ষণিকভাবে দেওয়া সম্ভব নয়। কোথাও এ-সংক্রান্ত তথ্য একত্রিত করা নেই। সারা দেশে অস্ত্রের লাইসেন্স কার কার নামে আছে এর একটা একত্রিত ফাইল তৈরি করা হচ্ছে। একত্রীকরণের কাজ শেষ হলে পরিসংখ্যান দেওয়া যাবে। সম্প্রতি অভিযোগ উঠেছে, অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংক্রান্ত অপরাধের মামলায় সাধারণ মানুষকে ব্যাপকভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। বিস্ফোরক-অপরাধের মামলাগুলো হচ্ছে আসামির নাম উল্লেখ না করে অর্থাৎ আসামিরা অজ্ঞাতপরিচয়। বিষয়টি পুলিশকে হয়রানি করার সুযোগ করে দিচ্ছে। কোনো এক জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটার পর সেখানে পুলিশ গিয়ে হাজির হয়। আর মামলা দায়েরের সময় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করা হয়। একজন ভুক্তভোগী জানান, আগে ৫৪ ধারায় মামলা করে পুলিশ সাধারণ মানুষকে হয়রানি করত। এখন তা করতে হয় না। কারণ তাদের রয়েছে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করার সুযোগ। এ কায়দায় হয়রানি করার ঘটনা বেশি ঘটছে মফস্বল এলাকায়। বিস্ফোরণের ঘটনা ধরে আর্থিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তিদের ডেকে নিয়ে বিস্ফোরক মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। তাঁরা হয়রানি এড়াতে পুলিশ যা চায় তা-ই দিয়ে আসেন। আগের বছরের তুলনায় ২০১৩-১৪ বছরে অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংক্রান্ত অপরাধের পাশাপাশি খুন বেড়েছে ১১.২৮ শতাংশ। এ সময়ে সারা দেশে খুনের ঘটনা ঘটেছে চার হাজার ৫৯৯টি। আগের বছর খুন হয়েছিল চার হাজার ১৩৩টি। অগ্নিসংযোগের ঘটনা বেড়েছে প্রায় ৭ শতাংশ। আগের বছর অগ্নিসংযোগের ঘটনা ছিল ৭৮১টি। এর আগের বছর ছিল ৭৩০টি। পাঁচ বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে অগ্নিসংযোগের ঘটনা বেড়েছে। ২০০৮-০৯ সালে অগ্নিসংযোগ ছিল ৩৫৮টি। গত বছরে তা বেড়ে ৭৮১টিতে দাঁড়ায়। এ সময়ে নারী নির্যাতনও বেড়েছে। ২০১২-১৩ সালে নারী নির্যাতনের ঘটনা ছিল ১৪ হাজার ৫৪৭টি। গত বছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ হাজার ৭১২টিতে। গত বছর ডাকাতির ঘটনা ৬.২৫ শতাংশ বেড়ে ৬৪৬টিতে দাঁড়ায়। অস্ত্র ও বিস্ফোরক-অপরাধের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অপরাধ বেড়েছে রাহাজানি-সংক্রান্ত। আগের বছরের তুলনায় গত বছর এ অপরাধ বেড়েছে প্রায় ১৯ শতাংশ। ২০১৩-১৪ বছরে রাহাজানি হয়েছে এক হাজার ১৫৯টি। আগের বছর ছিল ৯৭৫টি। গত বছরের অপরাধের তালিকায় ধর্ষণ ও এসিড নিক্ষেপের ঘটনা কমেছে। ধর্ষণ কমেছে ০.৯ শতাংশ আর এসিড নিক্ষেপ কমেছে ১২.৩৪ শতাংশ। জানা গেছে, ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা থানায় আসেন না। থানায় এলেও প্রভাবশালীদের চাপে পুলিশ মামলা স্থানীয় পর্যায়ে মিটিয়ে ফেলার তাগিদ দেয়। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিধিবদ্ধ কাজে না রেখে নির্বাচনসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহার করার কারণে অস্ত্র ও বিস্ফোরক-অপরাধ বেড়েছে। এ ধরনের অপরাধ বাড়ার বড় কারণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক সদস্য এ-জাতীয় অপরাধ সংঘটনকারীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েছেন। আর ভারত সীমান্তও অনেকটা শিথিল। এ কারণে অস্ত্র সহজে ঢুকে পড়ছে। কাদের অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে সেটিও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেউ কেউ সাত-আটটি করে লাইসেন্স পাচ্ছে। অথচ যাদের দরকার তারা পাচ্ছে না। এ ব্যাপারে পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্যঘটিত অপরাধের ঘটনা বাড়েনি। সব কিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। ইতিমধ্যে বেশির ভাগ বিস্ফোরক-অপরাধের মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। আর যেসব মামলার তদন্ত চলছে সেগুলোতে দ্রুত চার্জশিট দেওয়া হবে।’ অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে বলে তিনি জানান।
No comments:
Post a Comment