মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারি চাকরিতে অবসরের বয়সসীমার সুবিধা পাওয়া নিয়ে নতুন করে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। গত ৪ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জারি করা এক আদেশের কারণে শুরু হয়েছে এ বিতর্ক। ওই আদেশে বলা হয়েছে, চাকরিতে প্রবেশ করার সময় কেউ নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা না দিয়ে থাকলে তিনি সাধারণ সরকারি চাকরিজীবীদের চেয়ে বাড়তি এক বছর চাকরি করার সুবিধা ভোগ করতে পারবেন না। এ আদেশের কারণে মুক্তিযোদ্ধা হিসে
বে মুক্তিবার্তা বা জাতীয় গেজেটে প্রকাশিত তালিকায় নাম অথবা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সই করা সনদপত্র থাকা সত্ত্বেও আগে ঘোষণা না দেওয়ায় অনেক সরকারি চাকরিজীবীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বর্ধিত সময় চাকরি করার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দুই বছরের বর্ধিত সুবিধা ভোগ করে অবসরে যাওয়া বিসিএস ক্যাডারের (খাদ্য) কর্মকর্তা মো. জামাল উদ্দিন শিকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হয়েও যাঁরা চাকরিতে যোগদানের সময় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা দেননি তাঁরা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জারি করা আদেশের কারণে সমস্যায় পড়বেন। মুক্তিবার্তায় বা গেজেটে নাম থাকা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সই করা সনদপত্র থাকার পরও শুধু চাকরিতে যোগদানের সময় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা না দেওয়ার কারণে সুবিধাবঞ্চিত হলে সেটা একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রতি চরম অবমাননা ছাড়া আর কিছু নয়। সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত একাধিক মুক্তিযোদ্ধা জানান, এখন যাঁরা সরকারি চাকরি করছেন তাঁদের বেশির ভাগই নিয়োগ পেয়েছেন এরশাদের আমলে। তখন নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিয়ে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করা ছিল অসম্ভব। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় প্রকাশ পেলে তখন সরকারি চাকরি পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়ত। এ কারণে অনেক মুক্তিযোদ্ধা তখন চাকরিতে প্রবেশকালে সনদ জমা দেননি। মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে একই রকম ভয় ছিল জিয়াউর রহমানের শাসনামলেও। ওই চাকরিজীবীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এখন যদি মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেওয়া শর্তের বেড়াজালে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরিতে সুবিধা বাতিল হয়ে যায়, তাহলে এর চেয়ে দুঃখের আর কিছু থাকবে না। বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা চাকরিজীবী জানান, সরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুবিধা পাওয়ার জন্য এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে চারটি শর্ত দেওয়া হয়েছিল। এসবের মধ্যে চাকরিতে যোগদানের সময় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার শর্ত ছাড়া আরো তিনটি শর্ত ছিল। অন্য তিনটি শর্ত মান্য করা সত্ত্বেও একজন মুক্তিযোদ্ধার অতিরিক্ত এক বছর চাকরি করার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে ৪ আগস্টের আদেশের কারণে। নারায়ণগঞ্জের সরকারি সফর আলী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ ১৯৭১ সালে ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে অংশ নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিবার্তায় তাঁর নাম রয়েছে, রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রাতিষ্ঠানিক সনদও। এরশাদের আমলে ১৯৮৩ সালে চাকরিতে যোগ দেন আবুল কালাম। কিন্তু ভয়ে সেই সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দেননি, জমা দেননি মুক্তিযুদ্ধের সনদও। মাত্র ১০ মাস পর তাঁর অবসরে যাওয়ার কথা। কিন্তু এত দিন পর এসে মিথ্যা অপবাদ নিয়ে সরকারি সুবিধা থেকে বরখাস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছেন তিনি এবং তাঁর মতো আরো অনেকে। এমনকি মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে তাঁরা যে সুযোগ নিয়েছেন, তা ফিরিয়ে না দিলে সরকার তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করবে বলেও সরকারি এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে। কুষ্টিয়ার মুক্তিযোদ্ধা মো. শহিদুল্লাহ জীবনের মায়া ত্যাগ করে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। ১৯৮১ সালে তিনি যখন সরকারি চাকরিতে যোগ দেন তখন জিয়াউর রহমানের শাসনামল। ভয়ে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় উল্লেখ করেননি চাকরিতে যোগদানের সময়। এখন তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে খুলনায় উচ্চমানের শিক্ষক ইনস্টিটিউটের পরিচালক। আগামী ১৭ নভেম্বর যাবেন অবসরে। চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধা সনদ না দেওয়ায় তিনি পড়েছেন বিপাকে। মো. শহিদুল্লাহ ক্ষোভের সঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি তো যুদ্ধ করেছিলাম কোনো কিছু পাওয়ার জন্য নয়। সরকার আমাদের নির্দিষ্ট কিছু শর্তে এক বছর বয়স বাড়িয়েছে চাকরিতে। এখন শেষ বয়সে এসে এভাবে অপদস্থ করার কোনো মানে নেই। আমি সত্যি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের এ রকম সিদ্ধান্তে মর্মাহত। কারা মুক্তিযোদ্ধা আর কারা ভুয়া- এ তালিকা তো সরকারের কাছে আছেই। সেই তালিকা দেখে ব্যবস্থা নিলেই তো সমস্যা মিটে যায়।’ ১৯৭২ সালের ৭ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণ করে রাষ্ট্রপতির জারি করা আদেশ থাকার পরও এ নিয়ে বিতর্কের অবসান না হওয়ায় ২০০৯ সালে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণের উদ্যোগ নেয় সরকার। পাঁচ বছরেও সেই উদ্যোগ সফল হয়নি। এ অবস্থায় সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেনকে প্রধান করে একটি উপকমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটিকে আগামী ১৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞার খসড়া তৈরি করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই সংজ্ঞা নির্ধারিত হওয়ার আগেই গত ৪ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা আদেশ এখন সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার জন্য বিব্রতকর হয়ে দেখা দিয়েছে। মন্ত্রী বললেন, কিছুটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে : এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গত রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, চাকরিজীবী প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করার জন্যই গত ৪ আগস্ট আদেশ জারি করা হয়েছে। এ আদেশের কারণে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হচ্ছে। তবে ওই আদেশের কারণে যাতে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হন সেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘বিসিএসের ফরমে মুক্তিযোদ্ধা কি না তা উল্লেখ করার ঘর আছে। তাই যাঁরা বিসিএস কর্মকর্তা হয়েছেন তাঁদের বিসিএস ফরমে অবশ্যই ঘোষণা দিতে হয়েছে তিনি মুক্তিযোদ্ধা কি না। চাকরিতে প্রবেশের সময় যদি কোনো বিসিএস কর্মকর্তা ঘোষণা না দিয়ে থাকেন, তাহলে এখন মুক্তিযোদ্ধা দাবি করার সুযোগ নেই। তবে অন্য চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে এ আদেশ কিছুটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করতে পারে। সে ক্ষেত্রে কেউ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হন, তবে তাঁর বিষয়টি যাচাই-বাছাই করা হবে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যেসব শর্ত পূরণ করার কথা, তা থাকলে বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।’ তিনি আরো বলেন, চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ায় সনদ গ্রহণের হিড়িক পড়ে গেছে। তাই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যেই ৪ আগস্টের আদেশ জারি করা হয়েছে। আদালতে গড়িয়েছিল আগেই : সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে সরকারি চাকরিরত মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরি থেকে অবসরের বয়সসীমা সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চেয়ে দুই বছর বাড়িয়ে ৫৯ বছর করে ২০০৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর একটি অধ্যাদেশ জারি করে। পরে সরকার ২০১০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি গণকর্মচারী (অবসর) আইন ১৯৭৪ সংশোধন করে। এ সুবিধা নিশ্চিত করার বিষয়ে ২০১০ সালের ৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের তৎকালীন সচিব মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামানের সই করা এক আদেশে বলা হয়, ‘যেসব কর্মকর্তা/কর্মচারী সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময় বা আবেদন করার সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেননি, অথবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাঁরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বাক্ষরযুক্ত সনদ গ্রহণ করেননি, অথবা যাঁদের নাম মুক্তিবার্তায়/গেজেটে প্রকাশিত হয়নি- কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন বা সনদ নিয়েছেন তাঁদের ক্ষেত্রে ৫৭ বছর চাকরিকাল-পরবর্তী অতিরিক্ত দুই বছর বর্ধিত চাকরিকাল প্রযোজ্য হবে না।’ এদিকে ২০১১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সরকারি সব চাকরিজীবীর অবসরের বয়সসীমা ৫৭ বছর থেকে বাড়িয়ে ৫৯ বছর করে একটি অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। পরের বছর ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকারি চাকরিজীবীদের অবসরসংক্রান্ত আইন সংশোধন করা হয়। এতে অমুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবসরের বয়সসীমা সমান হয়ে যায়। এতে মুক্তিযোদ্ধা সরকারি চাকরজীবীরা ক্ষুব্ধ হয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। ওই রিট আবেদনের ওপর শুনানি শেষে হাইকোর্ট মুক্তিযোদ্ধাদের অবসরের বয়সসীমা আরো এক বছর বাড়িয়ে দিতে রায় দেন ২০১২ সালের ৫ ডিসেম্বর। এ প্রেক্ষাপটে সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে আরো এক বছর বাড়িয়ে অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর করে এ-সংক্রান্ত আইন সংশোধন করে। কিন্তু পরে এ রায় পুরোপুরি কার্যকর না করার অভিযোগ এনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সরকারের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আদালত অবমাননার মামলা করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, চাকরিতে যোগদানের সময় যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা দেননি তাঁদের সনদ যাচাই করার জন্য পাঠানো হয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। সব মন্ত্রণালয় ও দপ্তর থেকে একটি করে তালিকা পাঠানো হয়। এ তালিকা পাওয়ার পর চার শর্ত অনুসরণ করে যাচাই-বাছাই করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে দেওয়া হয় যাচাইপত্র। এই যাচাইপত্রের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চাকরিতে প্রথমে অতিরিক্ত দুই বছর এবং পরে আরো এক বছরের সুবিধা ভোগ করেছেন বা করছেন। কোনো কোনো কর্মকর্তাকে যাচাইপত্র না দেওয়ায় তাঁদের কেউ কেউ হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। জাতীয় গেজেটে নাম থাকার পরও যাচাইপত্র দেওয়া হয়নি বেশ কয়েকজনকে। তাঁদের মধ্যে কাশিমপুর কারাগারের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সিদ্দিকুর রহমান, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সাবেক চিকিৎসক ডা. রথীন্দ্রনাথ কুণ্ডু, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সাবেক উপপরিচালক লুৎফুর রহমান, স্কুলশিক্ষিকা রেহানা বেগমসহ ২৬ জন হাইকোর্টে রিট আবেদন (রিট নম্বর ২৮৯৭/২০১১) করেছিলেন। এরপর আদালতের নির্দেশে তাঁদের যাচাইপত্র দেওয়া হয়। এই যাচাইপত্রের ভিত্তিতে ওই ২৬ জন তিন বছরের (প্রথমে দুই বছর ও পরে এক বছর) বাড়তি সুবিধা ভোগ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেলোয়ার হোসেনের (যুগ্ম সচিব) নাম আছে ভারতীয় তালিকায়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যাচাইপত্র থাকার পরও তাঁকে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত চাকরি করার সুবিধা দেওয়া হয়নি। বলা হয়, তাঁর নাম মুক্তিবার্তা লাল বইয়ে নেই। এরপর হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন দেলোয়ার হোসেন। আদালত সুবিধা না দেওয়ার কারণ জানতে চেয়ে সরকারের প্রতি রুল জারি করেন। এখন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছে, যাঁরা চাকরিতে যোগদানের সময় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা দেননি তাঁরা সুবিধা পাবেন না। এই আদেশের ফলে বর্তমান সরকারের আমলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া যাচাইপত্রও অকার্যকর হয়ে পড়ছে। আর এ কারণেই চাকরিতে যোগদানের সময় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা দেওয়াসংক্রান্ত আদেশ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
No comments:
Post a Comment