হজযাত্রীদের নিয়ে বাণিজ্য করার অভিযোগ উঠেছে ধর্ম মন্ত্রণালয়েরই কয়েক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এদের মধ্যে রয়েছেন- মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (হজ) হাসান জাহাঙ্গীর আলম, উপসচিব (হজ) জাহাঙ্গীর আলম, আশকোনা হজ অফিসের অফিস সহকারী ধর্ম মন্ত্রণালয়ে প্রেষণে কর্মরত আহমেদ মোস্তফা মোল্লা ও সদ্য অবসরোত্তর ছুটিতে যাওয়া ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বজলুল হক বিশ্বাস। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হলেও এদের প্রত্যেকের রয়েছে হ
জ এজেন্সি। তবে তা নিজের নামে নয়, কারও সন্তানের নামে, কারও ভাইয়ের নামে, কারও বা মেয়ের জামাইয়ের নামে। এ ছাড়াও চলতি বছরের হজগাইড নির্বাচন নিয়েও নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। জানতে চাইলে ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান বুধবার সন্ধ্যায় মোবাইল ফোনে যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিল না। খোঁজ নিয়ে এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। হজগাইডের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার অনুমোদন নেয়া হলেও আমাকে বিস্তারিতভাবে জানানো হয়নি। বিষয়টি আমি দেখব। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ২ আগস্ট অবসরোত্তর ছুটিতে যাওয়া ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বজলুল হক বিশ্বাস গত সাড়ে আট বছর ধরে ধর্ম মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন। যুগ্ম সচিব (হজ) হাসান জাহাঙ্গীর আলমও প্রায় ছয় বছর ধরে একই মন্ত্রণালয়ে কর্মরত। এর আগে তিনি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সচিব ছিলেন দীর্ঘদিন। ফলে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তার যোগাযোগ আট থেকে ১০ বছরের। উপসচিব (হজ) জাহাঙ্গীর আলমও ধর্ম মন্ত্রণালয়ে রয়েছেন তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে। দীর্ঘদিন একই মন্ত্রণালয়ে থাকার সুবাদে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। এ সিন্ডিকেটে মন্ত্রণালয়ের আরও কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। সিন্ডিকেটের প্রভাবশালীরা তাদের আত্মীয়দের নামে হজ এজেন্সির লাইসেন্সও বাগিয়ে নিয়েছেন। হজসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা হওয়ার কারণে তাদের তাদের এজেন্সি রমরমা ব্যবসা করছে বলেও একাধিক হজ এজেন্সির দিক থেকে অভিযোগ রয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বজলুল হক বিশ্বাস তার মেয়ের জামাইয়ের নামে ‘সুপার নির্ভান এন্টারপ্রাইজ’ এবং মেয়ের নামে ‘সাবরিনা এন্টারপ্রাইজ’ নামে দুটি হজ এজেন্সির লাইসেন্স নিয়েছেন। অবশ্য এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি একটি লাইসেন্স নেয়ার কথা স্বীকার করে বুধবার যুগান্তরকে বলেন, আগামীতে নিজের নামে হজ লাইসেন্সের আবেদন করব। অন্তত বাকি জীবন যেন হাজীদের সেবা করে যেতে পারি। নানা ধরনের অভিযোগ উঠার পর অবসের যাওয়ার কয়েকদিন আগে বজলুল হক বিশ্বাসকে অন্যত্র বদলি করা হয়। তিনি চলে যাওয়ার পর এ সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন হাসান জাহাঙ্গীর আলম। তার ছেলের নামে ‘সুবহানাল্লাহ ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস’ এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে যৌথভাবে ‘মুনতাকা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস’ নামে দুটি এজেন্সির লাইসেন্স নিয়েছেন। যুগান্তরের কাছে ছেলের নামে লাইসেন্স নেয়ার কথা স্বীকার করেছেন হাসান জাহাঙ্গীর আলম। বুধবার নিজ দফতরে এ বিষয়ে তিনি দাবি করেন, সব নিয়মকানুন মেনেই তার ছেলে লাইসেন্স পেয়েছেন। এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (হজ) জাহাঙ্গীর আলমের ভাইয়ের নামেও একটি হজ এজেন্সির লাইসেন্স রয়েছে। ‘ইবনে বতুতা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস’ নামে এ লাইসেন্স দিয়ে ব্যবসা করছেন জাহাঙ্গীর আলমের ভাই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর আলম দাবি করেন, তার ভাইয়ের নামে হজ এজেন্সির লাইসেন্স থাকলেও তারা হজযাত্রী নিয়ে ব্যবসা করেন না। এ ছাড়াও আশকোনা হজ অফিসের অফিস সহকারী আহমেদ মোস্তফা মোল্লা (সাপু) ও তার ভাই হজ অফিসের ম্যাসেঞ্জার রফিকুল ইসলাম মোল্লা- এ দুই ভাইয়ের রয়েছে ‘আরএফএল ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস’ নামে একটি হজ এজেন্সি। এই রফিকুল ইসলাম মোল্লা গতবারও হজ-চিকিৎসক দলের সদস্য হিসেবে সৌদি আরব গিয়েছিলেন। পরপর দু’বার যাওয়ার নিয়ম না থাকলেও তিনি এবারও হজ-চিকিৎসক দলের সঙ্গে সৌদি আরব যাচ্ছেন। তার নামে এরই মধ্যে অফিস আদেশও জারি করেছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) একাধিক নেতা যুগান্তরকে জানিয়েছেন, ‘আমাদের ব্যাপারে পান থেকে চুন খসলেই লাইসেন্স বাতিল, লাখ লাখ টাকা জরিমানাসহ নানা শাস্তি। অথচ মন্ত্রণালয়ে যারা সরকারি চাকরির পাশাপাশি হজের ব্যবসা করছে, হাজীদের হয়রানি করছে তাদের শাস্তি দেবে কে? তারা সরকারি চাকরিও করছে আবার ব্যবসাও করছে। এসব দেখার কেউ নেই।’ হজগাইড নির্বাচনে অনিয়ম : চলতি বছরের হজগাইড নির্বাচন নিয়ে নয়-ছয়ের অভিযোগ উঠেছে হজগাইড বাছাই কমিটির বিরুদ্ধে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (হজ) হাসান জাহাঙ্গীর আলম এ কমিটির প্রধান। তার নেতৃত্বে বাছাই কমিটি করা হলেও কমিটির অপর তিন সদস্য বায়তুল মোকাররম মসজিদের দ্বিতীয় খতিব মাওলানা মুহিবুল্লাহ, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ড. আবদুস শুকুর ও আশকোনা হজ অফিসের পরিচালক মিজানুর রহমানকে অন্ধকারে রেখে গাইড নির্বাচন করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী যারা কমপক্ষে ৪৫ জন হজযাত্রী সংগ্রহ করতে পারবেন তাদেরই হজগাইড হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার কথা। কিন্তু এবার একজন হাজীও সংগ্রহ করতে পারেনি এমন ব্যক্তিকেও হজগাইড করা হয়েছে। এমনকি কমিটির প্রধান হাসান জাহাঙ্গীর আলম তার নিজ এলাকা চাঁদপুরের ছয়জনকে গাইড নির্বাচিত করেছেন যাদের মধ্যে চারজনই কোনো হাজী সংগ্রহ করতে পারেননি। চলতি বছর সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১ হাজার ৪৫৭ জন হজযাত্রী হজে যাচ্ছেন। নিয়ম অনুযায়ী ৩৩ জন হজগাইড এবার সৌদি আরব যাওয়ার কথা। অথচ এবার নির্বাচন করা হয়েছে ৪৮ জন। অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছে আরও তিনজনকে। অতিরিক্ত গাইড নেয়া হচ্ছে ১৫ জন। গাইডপ্রতি চার লাখ টাকা খরচ ধরা হলে এই অতিরিক্ত ১৫ জনের জন্য ব্যয় হবে ৬০ লাখ টাকা। আর এ টাকার যোগান দিতে হবে সরকারি ব্যবস্থাপনায় যাওয়া হাজীদের। প্রতি ৪৫ জনের জন্য একজন গাইড দেয়ার নিয়ম থাকলেও এবারই ৪৫ জনের ১০টি গ্র“পকে দুজন করে গাইড দেয়া হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, নওগাঁর মাযহারুল মান্নান নামে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এক কর্মকর্তাকে গাউড নির্বাচিত করা হয়েছে, যিনি মাত্র একজন হাজী সংগ্রহ করতে পেরেছেন। হাসান জাহাঙ্গীরের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় তাকে গাইড করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসান জাহাঙ্গীর নিজ কার্যালয়ে যুগান্তরকে বলেন, এসব অভিযোগের কোনোটাই সত্যি নয়। মন্ত্রী-সচিবের অনুমোদনক্রমেই হজগাইড নির্বাচন করা হয়েছে। অতিরিক্ত ১৫ জন গাইডের টাকা কে দেবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাজীদের প্রশিক্ষণের টাকা থেকে তাদের ব্যয় নির্বাহ করা হবে। কথা বলার একপর্যায়ে তিনি এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ না করার অনুরোধ করেন প্রতিবেদকের কাছে।
No comments:
Post a Comment