এমএল পিনাক-৬-এর মতো প্রায় দেড় হাজার ঝুঁকিপূর্ণ লঞ্চ চলছে সারা দেশের বড় বড় নদীতে। এগুলোর মধ্যে সরকার অনুমোদিত তিন শতাধিক। পুরোনো নকশার এক পায়ের (সাংকেন ডেক) এসব লঞ্চ শান্ত ছোট নদী এবং খালে চলাচলের উপযোগী। সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন। অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, সরকারি অনুমোদন নিয়ে মাওয়া-কাওড়াকান্দি রুটেই এ ধরনের লঞ্চ চলছে ৮৩টি। এগুলোর মধ্যে ফিটনেসের মেয়াদ চলে গেছে
১২টির। আর সর্বশেষ ৪ আগস্ট মাওয়ায় পদ্মা নদীতে ডুবে যাওয়া এমএল পিনাক-৬ লঞ্চটিরও চলাচলের অনুমতির (টোকেন) মেয়াদ ছিল না। এ রকম ঝুঁকি নিয়ে সুনামগঞ্জ, আশুগঞ্জ, পটুয়াখালী, রাঙ্গাবালি, ভোলা, বরিশাল প্রভৃতি রুটে এবং হাওর এলাকায়ও লঞ্চ চলছে। কিন্তু এসব যেন দেখার কেউ নেই। একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটলেও তা বন্ধে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। উল্টো সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার কারণে সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। লঞ্চের নকশা প্রণয়ন থেকে নির্মাণের পর নদীতে নামা ও দুর্ঘটনার পর উদ্ধারকাজেও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় থাকে না। দুর্ঘটনা ঘটলে এক সংস্থা আরেক সংস্থাকে দোষারোপ করে। সর্বশেষ লঞ্চডুবির পর সেটি উদ্ধারে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) সঙ্গে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর তেমন সক্রিয় নেই। আবার দুর্ঘটনার পর সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের গঠিত তদন্ত কমিটিতে অন্য সংস্থার কোনো প্রতিনিধিও রাখা হয়নি। লঞ্চটির জরিপ সনদ প্রদানকারী ব্যক্তিকে করা হয়েছে কমিটির প্রধান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান শামছুজ্জোহা খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, বিআইডব্লিউটিএর সঙ্গে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের কাজের সমন্বয়ের বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে গত বৃহস্পতিবার তিনি নৌপরিবহনমন্ত্রীকে বলেছেন। তাঁর আশা, এখন থেকে সমন্বয় ঠিকমতো হবে। যোগাযোগ করা হলে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংস্থাগুলোর মধ্যে একেবারে সমন্বয় নেই, তা বলা যাবে না। আমি তো প্রতিদিন বৈঠক করছি, সেখানে বিআইডব্লিউটিএ, সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরসহ অন্য সংস্থাগুলো থাকছে। মানুষের নিরাপত্তার জন্য অতীতে ৩৩টি অযোগ্য লঞ্চ বন্ধ করে দিয়েছিলাম, তখন এগুলো চালুর জন্য ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল।’ এমএল পিনাক-৬ চলাচলের অনুমতি ছিল না, তাহলে কীভাবে চলছিল? জবাবে মন্ত্রী বলেন, অনুমতি ছিল। কয়েকটা দিন আগেই মেয়াদ শেষ হয়েছে। তিনি বলেন, সংস্থাগুলোর মধ্যে আরও সমন্বয়ের নির্দেশ দেওয়া হবে। কিছু লঞ্চকে পুনরায় জরিপ করার এবং রুট পারমিট দেওয়ার ক্ষেত্রে কঠোরতা আরোপ করা হবে। ২০ বছর ধরে কর্মরত বিআইডব্লিউটিএর একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ২০০০ সালে রাজহংসী-জলকপোত, ২০০২-এ এম ভি সালাউদ্দিন-২ দুর্ঘটনা, ২০০৩-এ এমভি মিতালী, এমভি নাসরিন, ২০০৪-এ এমভি লাইটিং সান, ২০০৯ সালে এমভি কোকো-৪ দুর্ঘটনার পর সাম্প্রতিক এমভি বিপাশা, এমভি শাথিল, মিরাজ—এ রকম ছোট-বড় কোনো লঞ্চ দুর্ঘটনার পর উদ্ধারকাজে সংস্থা দুটির মধ্যে তিনি কোনো সমন্বয় দেখেননি। অন্য একজন কর্মকর্তা বলেন, একটি লঞ্চ দুর্ঘটনা হয়, দুর্ঘটনার পর মন্ত্রী-সচিবের পাশাপাশি বিআইডব্লিউটিএ ও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। সেখানে সাংবাদিকদের কাছে বড় বড় উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেন। তারপর সবাই সব ভুলে যান। অযোগ্য, ত্রুটিপূর্ণ বা ঝুঁকিপূর্ণ লঞ্চ চলাচল বন্ধ করতে নানা উদ্যোগের কথা তাঁরা বলেন কিন্তু পরে আর কিছুই করেন না। পিনাক দুর্ঘটনার পর যা হলো: ৪ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় এমএল পিনাক-৬ দুর্ঘটনার পর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে মাওয়া ঘাটে তাঁবু খাটিয়ে একটি ক্যাম্প করা হয়েছে। সেখানে নিখোঁজ ও উদ্ধার পাওয়া যাত্রীদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। ফায়ার সার্ভিসের উদ্যোগে স্থানীয় ট্রলার ও স্পিডবোটে আনা যাত্রীদের তালিকা তৈরির কাজে নিয়োজিত ছিল পুলিশ। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, বিআইডব্লিউটিএ বা সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের কোনো কর্মকর্তাকে সেখানে দেখা যায়নি। তাঁরা ব্যস্ত ছিলেন নৌমন্ত্রী ও বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানের প্রটোকল নিয়ে। বেলা তিনটায় ৩৮ জন জীবিত উদ্ধারের তালিকা তৈরি হয়। কিন্তু তখন বিআইডব্লিউটিএ ১১০ জন উদ্ধারের কথা জানায়। সন্ধ্যায় মাওয়া সার্কিট হাউসে মন্ত্রীর উপস্থিতিতে ১২১ জন উদ্ধার হওয়ার কথা জানানো হয়। উদ্ধার ক্যাম্পের তালিকার সঙ্গে এই অমিলের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে নৌ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, অন্যরা শ্রীনগর ষোলঘর এবং উপজেলা স্বাস্থকেন্দ্রে চিকিৎসাধীন আছেন। ওই সময় মন্ত্রীর সঙ্গে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানসহ অন্য কর্মকর্তাদের দেখা গেলেও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বর্তমানে মাওয়া বা মাদারীপুরে লাশ উদ্ধারকাজে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে বিআইডব্লিউটিএ, কোস্টগার্ড থাকলেও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের কোনো প্রতিনিধি নেই। শুধু এমভি পিনাক নয়, অতীতেও এমন সমন্বয়হীনতা ছিল। পারস্পরিক দোষারোপ: নিয়ম অনুযায়ী সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর লঞ্চের নির্মাণ, নিবন্ধন ও জরিপ কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। বিআইডব্লিউটিএ নৌযানের রুট পারমিট দিয়ে চলাচলের পথ নির্ধারণ করে। এ ক্ষেত্রেও দুটি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় নেই। পিনাক দুর্ঘটনার পর বড় নদীতে পিনাকের মতোই ত্রুটিপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ লঞ্চ চলাচল করছে। এ ক্ষেত্রে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর ও বিআইডব্লিউটিএ একে অপরকে দোষ দিচ্ছে। সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম ফখরুল ইসলাম গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বিআইডব্লিউটিএকে অনেক দিন থেকে বলে আসছি ছোট লঞ্চ বড় নদীতে চলার রুট পারমিট না দিতে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমের তিন মাস রাতের বেলায় এবং দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় যেকোনো সময় দিনের বেলাতেও ছোট লঞ্চ চলাচল করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএ বিষয়টি আমলে নিচ্ছে না।’ তবে বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (নৌনিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা) শফিকুল হক বলেন, ‘এ ধরনের আপত্তির কথা আমাদের জানানো হয়নি। উল্টো আমরাই বলেছি, মাওয়ার মতো নৌপথে বড় লঞ্চ চলাচলের ব্যবস্থা করতে। কিন্তু সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর ছোট লঞ্চগুলোকে সরিয়ে নিচ্ছে না।’ স্বাধীন অনুসন্ধান সেল হলো না: বিআইডব্লিউটিএর সাবেক পরিচালক সৈয়দ মনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ২০০০ সালের ২৯ ডিসেম্বর মেঘনায় রাজহংসী-জলোকপোত দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটির সুপারিশে একটি ‘স্বাধীন অনুসন্ধান সেল’ করার প্রস্তাব ছিল। বিভিন্ন সময়ের তদন্ত প্রতিবেদনে লঞ্চ জরিপ কাজে মাস্টার মেরিনার, নেভাল আর্কিট্যাক্ট ও মেরিন প্রকৌশলী—তিনটি পক্ষকেই কাজে লাগানোর সুপারিশ ছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মৌসুমে দ্রুত আবহাওয়ার তথ্য দিতে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দরে আবহাওয়া দপ্তর করার সুপারিশ ছিল। মাওয়া এবং পাটুরিয়ায় এ ধরনের দপ্তরের স্থাপনা হয়েছে মাত্র। যন্ত্রপাতি বসেনি, লোকজনও নেই। একটি লঞ্চে কতজন যাত্রী উঠল, কতজন নামল, মাঝপথে উঠল কি না, তা দেখতে তদারকি দল রাখার সুপারিশ বছরের পর বছরেও কার্যকর হয়নি। জরিপ সনদ প্রদানকারী তদন্ত কমিটির প্রধান: পিনাক-৬ লঞ্চের জরিপ সনদ প্রদানকারী কর্মকর্তা নাজমুল হককে তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ জরিপকারক কার্যালয়ের এই প্রকৌশলী ও জরিপকারকের জরিপ সনদে এই লঞ্চ চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত মাওয়া-কাওড়াকান্দি রুটে চলাচল করে। ঢাকা সদরঘাট বন্দরের জরিপকারক মির্জা সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নাজমুল হকের সনদের ধারাবাহিকতায় তিনি সর্বশেষ ৪৫ দিনের জন্য পিনাক-৬কে সাময়িক চলাচলের অনুমতি (টোকেন) দেন। ৪৫ দিনের এই মেয়াদ জুনে শেষ হয়ে গেছে। এরপর লঞ্চটি অনমুতি ছাড়াই চলছিল। যে দুর্ঘটনার জন্য লঞ্চটির জরিপ সনদও দায়ী, সেই সনদপ্রদানকারী কর্মকর্তাকে তদন্ত কমিটির প্রধান করার যৌক্তিকতা কী, জানতে চাইলে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম ফখরুল ইসলাম বলেন, নাজমুল হক ছাড়াও কমিটিতে একজন ম্যাজিস্ট্রেট ও অন্য সদস্যরা রয়েছেন। তাই নাজমুল হক একা কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন না। এদিকে পিনাকের মালিকানা পরিবর্তনের পর নতুন করে এর নিবন্ধন দেন অধিদপ্তরের এই প্রধান প্রকৌশলী। তিনি কয়েক দফায় এই লঞ্চের বার্ষিক জরিপ সনদও দেন। এ বিষয়ে ফখরুল ইসলাম বলেন, মালিকানা পরিবর্তন করলে নতুন করে এর নিবন্ধন ও বার্ষিক সনদ দেওয়া নিয়মের মধ্যেই পড়ে।
No comments:
Post a Comment