মাত্র এক বছরের ব্যবধানেই দেশের দুর্বল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা দুই–তৃতীয়াংশ কমে গেছে। আর অকার্যকর বিদ্যালয়ের সংখ্যাও কমেছে নাটকীয়ভাবে। ফলে বেড়েছে ‘সবচেয়ে ভালো’ বিদ্যালয়ের সংখ্যাও। এমন মূল্যায়ন অবশ্য নিজ নিজ বিদ্যালয়ের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে করেছে সরকার। সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের মূল্যায়নে এবার ৯৫৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় দুর্বল ও ৩১টি অকার্যকর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গতবার দুর্বল বিদ্যালয় ছিল তিন হাজার ৬৬টি এবং অকার্যকর ছিল ১৭৭টি। আর অতি উত্তম বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৭০৪ থেকে বেড়ে এক হাজার ২০টি হয়েছে। এবার এক লাফে বিদ্যালয়ের এমন মান বৃদ্ধির ঘটনায় মূল্যায়ন নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্বল ও অকার্যকর বিদ্যালয়ে ঠিকমতো পাঠদান হয় না। শিক্ষার পরিবেশও ভালো নেই, পরীক্ষার ফলও ভালো হয় না। শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মাধ্যমিক পরীক্ষায় এক বছরের ব্যবধানে পাসের হার বেড়েছে মাত্র ৩ শতাংশ। সেখানে শিক্ষার পরিবেশ ও মান এত উন্নত হয়নি যে দুর্বল ও অকার্যকর বিদ্যালয়ের সংখ্যা এতটা কমবে। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এ ধরনের মূল্যায়ন হয়। কিন্তু ওই সব দেশের বিদ্যালয়গুলোর প্রধান শিক্ষকেরা অনেক বেশি দায়িত্বশীল। তাঁরা তথ্য গোপন করেন না। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো আশা করতে পারব না যে প্রধান শিক্ষকেরা তথ্য গোপন করবেন না। এটা এখনো দুরাশা।’ তাঁর মতে, বাস্তব চিত্র আরও খারাপ হতে পারে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) অধীন সারা দেশের ১৮ হাজার ৪২৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ওপর গত বছর পরিচালিত এই মূল্যায়ন প্রতিবেদনে নির্ধারিত ছকে তথ্য দেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকেরা। এই মূল্যায়নকে বলা হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক স্বমূল্যায়ন। মাধ্যমিক শিক্ষা স্তর উন্নয়ন প্রকল্পের (এসইএসডিপি) সহায়তায় মাউশির উন্নয়ন ও পরিকল্পনা শাখা এই জরিপটি করেছে। আজ বৃহস্পতিবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হবে। এ উপলক্ষে রাজধানীর জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমিতে (নায়েম) একটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। মাউশির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সাতটি সূচক ও ৪৫টি সহসূচকের ভিত্তিতে এই মূল্যায়ন করা হয়। সাতটি সূচক হলো: শিখন ও শেখানোর পরিবেশ, প্রতিষ্ঠানপ্রধানের নেতৃত্ব, ব্যবস্থাপনা কমিটির কার্যকারিতা, শিক্ষকদের পেশাদারত্ব, শিক্ষার্থীদের কৃতিত্ব, সহশিক্ষাক্রমিক কর্মসূচি এবং শিক্ষক-অভিভাবক সম্পর্ক। এই সূচকগুলো বিদ্যালয়গুলোতে কেমন অবস্থায় আছে, তা প্রধান শিক্ষকদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। এর ভিত্তিতে বিদ্যালয়গুলোকে ‘এ’ (অতি উত্তম), ‘বি’ (ভালো), ‘সি’ (মধ্যম), ‘ডি’ (দুর্বল) ও ‘ই’ (অকার্যকর)—এই পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। মাউশির সূত্রমতে, এবার ভালো বিদ্যালয় নয় হাজার ৯৮টি, মধ্যম মানের সাত হাজার ৩১৯টি। গতবার ভালো বিদ্যালয় ছিল ছয় হাজার ৮১৮টি এবং মধ্যম শ্রেণির বিদ্যালয় ছিল সাত হাজার ৭১৯টি। জানতে চাইলে মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষণ ও শেখানো সূচকে দেখা গেছে যে অনেক বিদ্যালয়ে প্রতি শ্রেণিকক্ষে গড়ে ৮০ জন পর্যন্ত শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে পড়ানো হয়। সেখানে স্বাভাবিকভাবেই ঠিকমতো পাঠদান সম্ভব নয়। আবার কোনো কোনো বিদ্যালয়ে পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হার ৪০ শতাংশ বা তার সামান্য কম-বেশি। এগুলোকে বলা হচ্ছে অকার্যকর। আবার এই সূচকের ভিত্তিতে যেগুলো ভালো করেছে, সেগুলোকে বলা হয়েছে অতি উত্তম ও ভালো শ্রেণির বিদ্যালয়। জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, মূল্যায়নের মাধ্যমে বিদ্যালয়গুলো আত্মবিশ্লেষণ করতে পারে। এর ভিত্তিতে কোথায় কোথায় সমস্যা আছে, তা চিহ্নিত হয় এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া যায়। ভালো হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেমন গতবার কিছু সরকারি বিদ্যালয় তুলনামূলক খারাপ ছিল, এগুলোতে বেশি নজর দেওয়ায় ভালো হয়েছে। পিছিয়ে রংপুর, এগিয়ে ঢাকা: প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে খারাপ অবস্থা রংপুর অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোর। এই অঞ্চলে দুর্বল বিদ্যালয় ৩০২টি। মোট অকার্যকর বিদ্যালয়ের মধ্যে ১৩টিই এ অঞ্চলে অবস্থিত। এখানে অতি উত্তম বিদ্যালয় ৬৯টি, ভালো এক হাজার ৮৬টি ও মধ্যম শ্রেণির এক হাজার ৫৫৪টি। খারাপের দিক দিয়ে দ্বিতীয় স্থানে বরিশাল অঞ্চল। এ অঞ্চলে ১১টি অকার্যকর এবং দুর্বল বিদ্যালয় ২৩৮টি। এখানে অতি উত্তম ২৩টি, ভালো ৫৭২টি ও মধ্যম শ্রেণির ৭৬৫টি বিদ্যালয়। ময়মনসিংহ অঞ্চলে অকার্যকর বিদ্যালয় তিনটি, দুর্বল ১১২টি, অতি উত্তম ১৩২টি, ভালো ৯৫৮টি ও মধ্যম শ্রেণির ৯১৩টি। ঢাকা অঞ্চলে অকার্যকর বিদ্যালয় দুটি ও দুর্বল ৭৬টি। অতি উত্তম বিদ্যালয় ঢাকা অঞ্চলে বেশি; ২৪৩টি। এ অঞ্চলে মোট প্রতিষ্ঠানও বেশি। এখানে ভালো বিদ্যালয় এক হাজার ৩৪৯টি এবং মধ্যম শ্রেণির বিদ্যালয় ৭৪৬টি। রাজশাহী অঞ্চলে ৮৬টি দুর্বল ও দুটি অকার্যকর বিদ্যালয় রয়েছে। এ অঞ্চলে অতি উত্তম বিদ্যালয় ১৭৯টি, ভালো এক হাজার ৬১৫টি ও মধ্যম শ্রেণির এক হাজার নয়টি। চট্টগ্রাম অঞ্চলে অতি উত্তম ৮৯টি, ভালো ৮৭৩টি, মধ্যম ৫৬৪টি ও দুর্বল শ্রেণির বিদ্যালয় ৪৭টি। কুমিল্লা অঞ্চলে অতি উত্তম ১৫১টি, ভালো ৭৬২টি, মধ্যম ৩৩২টি ও ১৯টি দুর্বল। খুলনায় অতি উত্তম বিদ্যালয় ৯৬টি, ভালো এক হাজার ৩৮৯টি, মধ্যম এক হাজার ১৪৭টি ও দুর্বল শ্রেণির ৫১টি। সিলেট অঞ্চলে অতি উত্তম ৩৮টি, ভালো ৪৯৪টি, মধ্যম ২৮৯টি ও ২৬টি দুর্বল বিদ্যালয় রয়েছে।
No comments:
Post a Comment