একই দিনে দুই সন্তান উজ্জল ও আফজালকে হারিয়েছিলেন আবুল কাশেম ও সালমা বেগম দম্পতি। দুই ছেলেই সাভারের ধসে পড়া রানা প্লাজার তৃতীয় তলায় নিউ ওয়েভ বটমস লিমিটেডে কাজ করতেন। বড় ভাই উজ্জলের লাশ পাওয়া গিয়েছিল। ছোট ভাই আফজাল এখনো নিখোঁজ। প্রায় দেড় বছর ধরে নানা জায়গায় ঘুরে, ডিএনএ টেস্ট করেও ছোট সন্তানের লাশের খোঁজ পর্যন্ত পাননি বাবা আবুল কাশেম। লাশ জোটেনি; তাই কোনো স্বীকৃতিও জোটেনি। আর ক্ষতিপূরণ তো দূরের কথা।
সাভারের রানা প্লাজা ধসে এখনো ‘নিখোঁজ’ এমন শ্রমিকদের একটি তালিকা করেছে পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। রানা প্লাজা ধসের এক বছর পর গত ২৯ এপ্রিল সংগঠনটির সহসভাপতি এস এম মান্নান কচিকে আহ্বায়ক করে গঠিত ওই কমিটি ১৫৮ জন শ্রমিকের একটি তালিকা করেছে, যাদের তারা নিখোঁজ বলছে। গত ১৪ অক্টোবর শ্রম মন্ত্রণালয়ে ওই তালিকা পাঠিয়েছে তারা। এই ১৫৮ জন শ্রমিকের পরিবার তাদের স্বজনের লাশ যেমন পায়নি, তেমনি তাদের ডিএনএর নমুনার সঙ্গে অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে দাফন করা ২৯১ জন শ্রমিকের ডিএনএর নমুনারও মিল পাওয়া যায়নি। এসব শ্রমিককে রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় নিহত হিসেবে স্বীকৃতি দিলে তাদের পরিবার প্রধানমন্ত্রীর অনুদান ও ক্ষতিপূরণ পাবে। তবে রানা প্লাজা ধসে প্রকৃত মৃতের সংখ্যাও বাড়ার আশঙ্কা আছে। এখন পর্যন্ত দাফন করা মৃতদেহের মধ্যে অজ্ঞাত রয়ে যাওয়া ও বিজিএমইএর নিখোঁজ তালিকার মধ্যে ফারাক সংখ্যা ৬৩। শ্রম মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ফয়জুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিজিএমইএর তালিকার পাশাপাশি ঢাকা জেলা প্রশাসনের একটি তালিকা আছে। এসব শ্রমিক রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় নিহত কি না তা আমরা পর্যালোচনা করে দেখব। পরে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হলে অনুদান বা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য পাঠানো হবে।’ ১৫৮ জন শ্রমিকের মধ্যে ১৩৫ জন যে রানা প্লাজায় কর্মরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে- এটা তদন্ত কমিটি পুরোপুরি নিশ্চিত। বাকি ২৩ জনের বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্য সরকারি সংস্থা দিয়ে আবার তদন্ত করা যেতে পারে বলে মনে করে বিজিএমইএর তদন্ত কমিটি। তবে এর বাইরে আর কোনো নিখোঁজ শ্রমিক নেই বলে দাবি করেন বিজিএমইএর সহসভাপতি এস এম মান্নান কচি। তিনি বলেন, ‘আমরা সব পক্ষকে নিয়ে এ তালিকাটি করেছি। এর বাইরে আর কোনো নিখোঁজ শ্রমিক নেই।’ ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক মারা গেছে বলে এখন পর্যন্ত স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। বিশ্ব কাঁপিয়ে দেওয়া এ দুর্ঘটনার দেড় বছর পূর্তি হচ্ছে আজ। এর মধ্যে ২৯১টি মৃতদেহ শনাক্ত ছাড়া ডিএনএর নমুনা রেখে দাফন করা হয়। সেখান থেকে এখন পর্যন্ত ২০৬ জনের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। ফলে শনাক্তহীন দাফন করা মৃতদেহের সংখ্যা এখন ৮৫। এর বাইরে ১০ জন শ্রমিককে অন্যত্র নিয়ে গিয়ে দাফন করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ফয়জুর রহমান। ফলে শনাক্তহীন অবস্থায় এখন ৯৫টি মৃতদেহ আছে। কিন্তু বিজিএমইএর তদন্ত কমিটির পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া ১৩৫ জনকে বিবেচনায় নিলে ৪০টি মৃতদেহের কোনো হদিস মেলে না। মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া ২৩ জনকে হিসাবে নেওয়া হলে ৬৩টি মৃতদেহের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। ১৫৮ জনকে স্বীকৃতি দেওয়া হলে মৃতের সংখ্যা বাড়বে কি না জানতে চাইলে ফয়জুর রহমান বলেন, ‘এটা স্বীকৃতি দেওয়ার পর বোঝা যাবে।’ অবশ্য রানা প্লাজার ঘটনাস্থল থেকে এখন পর্যন্ত তিন-চারটি মাথার খুলি ও প্রচুর হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়েছে। নিখোঁজ তালিকায় যেসব শ্রমিক : বিজিএমইএর তালিকায় ‘পুরোপুরি নিশ্চিত’ হিসেবে স্থান পাওয়া নিখোঁজ ১৩৫ জন শ্রমিক হলো সাভারের কামাল, আফজাল, জুমা, হাবিবুর ও সায়লা আক্তার; জামালপুরের নুসরাত জাহান রুনা, বেলাল হোসেন, শামীম হোসেন, শাহিন, শারমিন আক্তার, রিক্তা ও আবিয়া বেগম; কুমিল্লার মর্জিনা বেগম; রাজবাড়ীর রওশন আরা, রাশিদা, আরিনা বেগম, আসমা ও সাজেদা আক্তার; রংপুরের রাজীব, মোরশেদুল, কুলসুম, বাবুল ও রুনা; নাটোরের দেলনাহার খাতুন ও মতিউর রহমান; ময়মনসিংহের মাহমুদা, হৃদয়, ইয়াসমিন ও সালেহা বেগম; মাদারীপুরের বিউটি বেগম; জয়পুরহাটের হাজেরা ও মাহিদুল; পিরোজপুরের আঁখি ও তাপস হাওলাদার; গোপালগঞ্জের নারগিস ও খালেদা; নওগাঁর মুন্নি, ঝর্ণা বেগম, লিপি, ইয়াসমিন, বেবি আক্তার, নাসিমা ও সালেহা; ফরিদপুরের আজম ও মুন্নি আক্তার (সাজেদা); সিরাজগঞ্জের আমেনা খাতুন, সুলায়মান হোসেন, মমতা খাতুন ও আমেনা খাতুন; চুয়াডাঙ্গার আলেয়া ফেরদৌস; ঢাকার হাজারীবাগের শান্তা আক্তার ও ধামরাইয়ের রিনা আক্তার; যশোরের সালাউদ্দিন কবির ও সাবিনা খাতুন; বরগুনার আলী আকবর, হাসান মিয়া, আজমল হোসেন, রোজিনা, রহিমা খাতুন ও আমিনা; রাঙামাটির সেলিনা আক্তার; হবিগঞ্জের সুফিয়া খাতুন ও নির্মলা দাস; শরীয়তপুরের লিপি আক্তার, মায়া বেগম ও সাহিদা বেগম; লালমনিরহাটের বেবি; ঝিনাইদহের মুন্নি ও মমতা রানী দাস; ঠাকুরগাঁওয়ের নাজমা খাতুন, শাহীনূর পারভীন ও শিরিন আক্তার; দিনাজপুরের গুলশানা জান্নাত, শরিফুল ইসলাম, ইসলামুল, শান্তা আক্তার, মাহমুদ হাসান, আবদুল করিম প্রধান, শেফালী, বিলকিস আক্তার, আবদুল লতিফ, সাজু আক্তার, সায়েদা বেগম ও আইনুল ইসলাম; পাবনার ফারজানা, পারভিন আক্তার ও খলিল হোসেন; বগুড়ার আতাউর রহমান, সুলতান, সাথী আক্তার ও সুরুজ মিয়া; টাঙ্গাইলের বাবুল মিয়া ও সুমি বেগম; কুষ্টিয়ার নুরজাহান বেগম, আশা, টিপু, জহিরুল ইসলাম, উজ্জল, মুক্তি ও হালিমা খাতুন; মেহেরপুরের রবিউল ইসলাম; লক্ষ্মীপুরের কুলসুম ও আঁখি; নেত্রকোনার তানিয়া ও শাহীনূর; চুয়াডাঙ্গার সালেহা বেগম; খুলনার রফিকুল শেখ ও ফারজানা; কিশোরগঞ্জের সখিনা খাতুন; গাইবান্ধার মুক্তা, মিনা বেগম, হালিমা (রেশমা) বিথি, শ্যামলী খাতুন, কামনা বেগম, বিলকিস আক্তার ও জিল্লুর রহমান (রফিকুল); মানিকগঞ্জের সিমু বেগম, মাইনা আক্তার, শামীম, শিলা, রাসেল, শিল্পী আক্তার ও সুমি আক্তার; সুনামগঞ্জের রুমা আক্তার; রাজশাহীর জহিরুল ইসলাম ও শিখা আক্তার; ঝালকাঠির সালমা বেগম; শেরপুরের আনোয়ারুল ইসলাম, সেকান্দার; কুড়িগ্রামের সুফিয়া বেগম; পঞ্চগড়ের রেণু আক্তার; চট্টগ্রামের ফরিদ এবং বাগেরহাটের মিজানুর খালিফা। ২৩ জনের বিষয়ে বিজিএমইএর তদন্ত কমিটি পুরোপুরি নিশ্চিত নয় বলে তাদের নাম প্রকাশ করা হলো না।
No comments:
Post a Comment