প্রেম, বিয়ে এমনকি ধর্ষণের দৃশ্য মোবাইলফোনে ধারণ করে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে চলছে অনৈতিক কর্মকাণ্ড। এসব কাজ নিয়ন্ত্রণে আনতে কিংবা ঘটনার শিকার হয়েছেন তারা লজ্জায় ভীতিতে আইনের আশ্রয়ও নিতে পারছেন না। পর্নোগ্রাফি রোধে ১০ বছরের সাজা রেখে একটি আইন করা হলেও এর সুফল মিলছে না। এ রকম এক পরিবেশে দেশের নারীরা সঙ্কটে আছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ক্ষেত্রে পারিবারিক, সামাজিক ও নৈতিক বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসতে হবে। য
ারা এসব করছেন তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ইন্টারনেট সেবাদাতারা বলেছেন, তারা বুঝতে পারলে পর্নো সাইট বন্ধ করতে পারেন। অটোমেটিক সিস্টেমে এটি বন্ধ করার কোনো সুযোগ তাদের হাতে নেই। মোবাইলফোনে সেবা দেয়ার প্রযুক্তি গ্লোবাল সিস্টেম অব মোবাইল কমিউনিকেশন (জিএসএম) ২০১১ সালে একমত হয়েছিল, মোবাইলফোনের অ্যাপস স্টোর বা অন্য কোনো মাধ্যমে জমা করা শিশুদের পর্নোগ্রাফিগুলো মুছে দেবে। সেটি একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে করা হবে। তবে কয়েক বছর অতিক্রম করলেও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতির খবর জিএসএমএর ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া যায়নি। দেশে জঘন্য ব্ল্যাক মেইলের ঘটনা ঘটিয়েছেন ভিকারুননিসা নূন স্কুলের বসুন্ধরা শাখার শিক্ষক পরিমল জয়ধর। তিনি ওই স্কুলের দশম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীর ভিডিও মোবাইলফোনে ধারণ করে তাকে বার কয়েক শারীরিক সম্পর্কে বাধ্য করেন। বর্তমানে পরিমল জেলে রয়েছেন। মোবাইলফোন ও ইন্টারনেট ফাঁদ : উন্নত বিশ্বে পর্নোগ্রাফির সবচেয়ে বড় সূত্র হচ্ছে ওয়েবক্যাম। এটি সাধারণত ল্যাপটপ বা ডেস্কটপে থাকে। অন্তরঙ্গ প্রেমিক-প্রেমিকারা ইন্টারনেটের মাধ্যমে তারা নিজেদের অন্তরঙ্গ বিষয়গুলো এতে শেয়ার করেন। সেখান থেকে এটি তৃতীয় কোনো পক্ষ তুলে নিয়ে ওয়েবসাইটে আপলোড করতে পারেন। বিশ্বে এ রকম অনেক সাইট রয়েছে। বাংলাদেশেও ওয়েবক্যামে এডাল্ট চ্যাটিং বাড়ছে। ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হচ্ছে, এ রকম সেবার মনিটরিং করার খুবই দুরূহ। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের নজর দিতে হবে। নইলে এটা থামানো সম্ভব হবে না। ইন্টারনেট ও ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ বেশি দামে কিনতে হলেও অল্প দামে পাওয়া নি¤œমানের মোবাইল হ্যান্ডসেটে বাজার ভরে গেছে। বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আড়াই হাজার টাকা মূল্যের হ্যান্ডসেটেই এখন ভিডিও ছবি তোলার ব্যবস্থা রয়েছে। সে কারণে এর নেতিবাচক ব্যবহার হচ্ছে। অল্প দামি এসব হ্যান্ডসেটও এর পেছনে একটা কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। মোবাইল ফোনে তোলা ছবি ইচ্ছে হলেই যেকেউ ফেসবুক, ব্লুটুথ বা এমএমএস করে শেয়ার করতে পারছে। তা ছাড়া নেটে তো শেয়ার করা যাচ্ছেই। বিশ্বাস করে কেউ কাউকে দিলে সেটি অন্যরা বিশ্বাস ঠিক না রেখে ওয়েবসাইটে আপলোড করছে। এতে করে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এসব পর্নো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নায়লা বলেন, রাস্তায় দাঁড়াতেও ভয় লাগে। কার ক্যামেরা কখন পিছু ছুটছে বলা যায় না। সবাইকে দেখে ভদ্রলোকই মনে হয়। কিন্তু মেয়েদের ছবি না জানিয়ে তুলে নিচ্ছেন। ইচ্ছে হলে ওয়েবসাইটে ছেড়ে দিচ্ছেন। এ ধরনের অনৈতিক কাজ বন্ধ করা জরুরি। তার মতে, এসব কাজে যারা জড়িত তাদের বিষয়ে সরকারকে কঠোর হতে হবে। নইলে এটি বন্ধ করা যাবে না। তা ছাড়া নারীদের এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। ইতিহাস : দেশের পর্নোগ্রাফি নিয়ে খোঁজখবর রাখেন এমন লোকদের ভাষ্য মতে, ডিজিটাল সেক্সুয়াল ক্রাইমের সূচনা হয়েছিল দেড় দশক আগে। বাংলাদেশে প্রথম ক্যামেরায় ধারণ করে প্রচার সেক্সুয়াল ভিডিও কিপসটি একজন বিমানবালার। সে দেশের একজন কুখ্যাত সাবেক ছাত্র নেতার সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে, যেটি ধারণ করে পরে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়া হয়। সে সময় দেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার পরিচালিত হচ্ছিল। এরপর সুমন নামে একজন প্রবাসী দেশে এসে তিন নারীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক করে তা ভিডিও ধারণ করে। সে সময় দেশের একটি মোবাইল ফোন অপারেটরের একজন অভ্যর্থনা নির্বাহী তার ফাঁদে পড়েছিলেন। সুমনের পর এ পথে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের ছাত্রলীগ নেতা রোকন। সে তার প্রেমিকার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করে, তা ভিডিও ধারণ করেছিল। তারপর সেটি বাজারে চলে আসে। রোকন ডটকম নামে এটি সর্বাধিক পরিচিত। এরপর এ ইতিহাস কেবল দীর্ঘ হয়েছে। এরপর কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর একটি ভিডিও সিডি বাজারে বের হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর ভিডিও সিডিও প্রকাশিত হয় বাজারে। এসব সম্পর্ক প্রেমের টানে, প্রতারণার কারণে হয়েছে বলে সিডি বিক্রেতারা মনে করছেন। মোবাইল ফোনে ঢাকায় মেমোরিতে ভিডিও কিপ লোড করা হয়, এমন মার্কেট ইস্টার্ন প্লাজা ও মোতালেব প্লাজায় খবর নিয়ে জানা গেছে, দেশে এত বেশি পর্নোগ্রাফি রয়েছে যে, অনায়াসে অন্তত চার জিবির মেমোরি কার্ড ফুল করে দেয়া যায়। একটি জরিপ, উদ্বেগ অনেক : আইসিডিডিআরবি ২০১১ সালে একটি জরিপ করেছে, যাতে বলা হচ্ছে দেশে ১৮ বছরের আগেই অন্তত ৫০ ভাগ শহুরে তরুণ যৌন অভিজ্ঞতা নিচ্ছেন। এরা পরোক্ষভাবে প্ররোচিত হয়ে এমনটা করছেন। এদের এক-তৃতীয়াংশ আবার গ্রুপ সেক্সে (দলগত যৌনকর্ম) জড়িয়ে পড়ছেন। বেশির ভাগেরই সঙ্গী হচ্ছে পেশাদার যৌনকর্মী। তারা কোনো রকমের প্রকেটশন ছাড়াই এসব সম্পর্ক করছেন। এতে করে তাদের মধ্যে এইডসের ঝুঁকি বাড়ছে বলে আইসডিডিআরবি বলছে। তরুণদের এইডসঝুঁকি সম্পর্কে জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচির পরিচালক অধ্যাপক মো: ওদুদ বলেন, যৌনাচরণ পরিবর্তন হওয়ার কারণে তরুণদের এইডসঝুঁকি বাড়ছে। এটি কমিয়ে আনার জন্য তারা কাউন্সিলিংসহ পাঠ্যপুস্তকে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার কথা ভাবছেন। আইসিডিডিআরবি তাদের ওই প্রতিবেদেনে বলেছে, ১১ থেকে ১৪ বছর বয়সী তরুণরা যৌনকর্মে লিপ্ত হচ্ছে পর্নোগ্রাফি দেখে। বিশেষজ্ঞরা কী বলেন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক মাসুদা এম রশীদ চৌধুরীর কাছে জিজ্ঞেস করছিলামÑ এমন সমস্যা কেন জ্যামিতিক হারে বাড়ছে? জবাবে তিনি বললেন, পবিত্রতা বলে যে একটা বিষয় সম্পর্কের মধ্যে ছিল সেটা নানান কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সে কারণে স্বামী স্ত্রীর পবিত্র সম্পর্কটা এখন অশ্ললীতায় রূপান্তর হচ্ছে। বিশ্বাস ও সারল্যের আশ্রয়ে এখন অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলো রেকর্ড করা হচ্ছে। সম্পর্ক খারাপ হলে সে সব ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে অনলাইনে। তিনি বলছেন, এ ধরনের সমস্যা মোকাবেলার জন্য আমাদের দেশজ আইডেন্টিটি ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে হবে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেল সুপার, প্রভোস্ট, বাবা মা এবং শিক্ষক শিক্ষিকাদের সতর্ক হতে হবে। এ ধরনের সঙ্কট সম্পর্কে তাদের সচেতন করতে হবে। সরকারকে এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে। যাতে করে কেউ ব্ল্যাকমেইলের শিকার না হয়। ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের সংগঠন আইএসপিএবির সভাপতি আখতারুজ্জামান মঞ্জু বলেন, আমরা পর্নো সাইট দেখলে তা ব্লক করে দিই। কিন্তু সব সাইটে তো সার্চ করে এ সব বের করাও কঠিন। আমাদের একটা লিস্ট দিলে, সেটি আমরা বন্ধ করতে পারি। কারণ পর্নো সাইটগুলো সহজে চেনা যায় না। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো উপায় হলো অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের ওপর নজর রাখা। তাকে বুঝতে চেষ্টা করা। তার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে শেয়ার করা।
No comments:
Post a Comment