জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে সেই চারজনসহ ছয়জন শিক্ষককে নিয়োগ দিয়েছে
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গত শনিবার রাতে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় তাঁদের নিয়োগ চূড়ান্ত হয়। গতকাল রবিবার তাঁরা যোগদান করেছেন বলে জানা গেছে। এদিকে প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও তড়িঘড়ি করে আরো ছয়জনকে নিয়োগ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিভাগের শিক্ষকরা। গত ২৩ সেপ্টেম্বর কালের কণ্ঠে ‘স্বজনপ্রীতি করে শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ’ শিরোনামে এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে যে চারজনের বিষয়ে স্বজনপ্রীতির কথা বলা হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত তাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, মেধাক্রম অনুসারে ১৫ জনের চূড়ান্ত যে তালিকা করা হয়েছিল এর প্রথম পাঁচজনকে বাদ দিয়ে যথাক্রমে অষ্টম, দশম, ত্রয়োদশ, চতুর্দশ ও পঞ্চদশতম প্রার্থীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগ পাওয়া একজনের নাম তালিকায়ই ছিল না। ওই চারজন ছাড়া অন্য দুজনের নিয়োগ দলীয় বিবেচনায় হয়েছে বলে জানা গেছে। গত শনিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় ছয়জন শিক্ষকের নিয়োগ চূড়ান্ত হয়েছে। নিয়োগপ্রাপ্তরা হলেন বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য ও সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরের ভাগ্নে ও সহকারী প্রক্টর সেলিনা আক্তারের স্বামী কাজী রাসেল উদ্দিন (নন থিসিস, স্নাতকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পঞ্চম), সহকারী প্রক্টর মাহমুদুল হাসানের স্ত্রী আফরোজা পারভীন (স্নাতক প্রথম শ্রেণিতে পঞ্চম ও স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয়), পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরীর ভাগ্নে মোজাম্মেল হোসেন (স্নাতকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম ও স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয়), সুব্রত বণিক (নন থিসিস) ও মো. মাহফুজ আলী খান (স্নাতকে প্রথম শ্রেণিতে চতুর্থ ও স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম)। অন্যজন হলেন ড. মোহাম্মদ মাহবুবুল মোরশেদ। তাঁর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির ফল জানা সম্ভব হয়নি। অথচ স্নাতকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া দুজন, প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় হওয়া তিন এবং স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম চারজন, প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় হওয়া তিনজনকে সিলেকশন বোর্ড বাদ দিয়েছে। সিলেকশন বোর্ডের প্রধান হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। অন্য তিন সদস্য হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের অধ্যাপক নজিবুর রহমান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক হাবিবুর রহমান, টাঙ্গাইলের মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আলাউদ্দিন আহমেদ। জানতে চাইলে উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সিলেকশন বোর্ড যোগ্য মনে করেছে তাই এদের সবাইকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিভাগে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। যে শিক্ষকরা এ নিয়েগের বিরোধিতা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন ইতিমধ্যে লিয়েন ছুটি নিয়ে দেশের বাইরে চলে গেছেন। আরো কয়েকজন বাইরে রয়েছেন। এখন ওই শিক্ষকদের ঘাটতি তো আমাদের পূরণ করতে হবে।’ উপাচার্য আরো বলেন, ‘বিভাগের সভাপতি আমাদের ছয়-সাতজন শিক্ষক নিয়োগ দিতে বারবারই বলে আসছিলেন। আমরা চারটি পদের বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছিলাম। পরে সিলেকশন বোর্ডের কাছে ভালো মনে হওয়ায় ছয়জনকেই নেওয়া হয়েছে।’ নন-থিসিস দ্বিতীয় শ্রেণিতে পঞ্চম হওয়া একজনকে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে উপাচার্য বলেন, ‘তাঁর বাবা মুক্তিযোদ্ধা এমনটি উল্লেখ করে আবেদন করায় তাঁর বিষয়টি আমরা বিবেচনা করেছি।’ গতকাল দুপুরে উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ নিয়োগের প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের শিক্ষকরা। অন্যদিকে বামপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন শিক্ষক মঞ্চও প্রতিবাদ জানিয়েছে। প্রতিবাদকারী শিক্ষকদের অভিযোগ, সিন্ডিকেট, সিনেট, ডিন নির্বাচনকে সামনে রেখে অধিকতর যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে বিজ্ঞাপিত চারটি পদের বিপরীতে ছয়জনকে শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে প্রশাসন। জানা গেছে, বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা না করেই বিভাগের সভাপতির পরামর্শে গত ২৭ আগস্ট প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগে চারজন প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপক নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর ওই বিভাগের ১৪ জন শিক্ষকের মধ্যে ৯ জনই নিয়োগপ্রক্রিয়া বাতিলের আবেদন জানান। ওই আবেদনে স্বাক্ষর করেন অধ্যাপক মো. শাহাদাত হোসেন, সহযোগী অধ্যাপক সোহেল আহমেদ, মো. ইব্রাহিম খলিল, মো. সাবির হোসেন, সহকারী অধ্যাপক ফারহা মতিন জুলিয়ানা, হুসাইন মো. শাহজালাল, মাফরোজ আহমেদ বসুনিয়া, প্রভাষক কাজী সাইফুল ইসলাম ও সুদ্বীপ পাল। বিভাগীয় সভাপতির কাছে করা এ আবেদনে শিক্ষকরা বলেন, ‘শিক্ষক নিয়োগসংক্রান্ত বিজ্ঞাপন দেওয়ার আগে বিভাগের কোনো সভায় বিষয়টি আলোচনা করা হয়নি।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের কাছেও তাঁরা একই দাবি জানিয়ে আবেদন করেছিলেন। উপাচার্য তখন শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি আপাতত সিন্ডিকেট সভায় তোলা হবে না বলে তাঁদের আশ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু গত ২৯ সেপ্টেম্বর প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। সর্বশেষ শনিবার নিয়মিত সিন্ডিকেট সভায় হঠাৎ করেই শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রাণরসায়ন বিভাগের একাধিক শিক্ষক জানান, বিভাগে শিক্ষক ঘাটতি নেই। ২২টি পদের বিপরীতে ২৩ জন শিক্ষক রয়েছেন। যদিও তাঁদের মধ্যে ৯ জন দেশের বাইরে রয়েছেন। বিভাগের সব কোর্সে শিক্ষার্থী আছেন ২৫০ জন। এ অবস্থায় ১৪ জন শিক্ষকের সবাইকে কাজে লাগানো সম্ভব হয় না। এখনো দুজন শিক্ষককে কোনো কোর্স দেওয়া সম্ভব হয়নি। এমনকি তাঁদের বসার জায়গাও নেই। আরো দুজন শিক্ষক ২০১৫ সালের মার্চ মাসের মধ্যে শিক্ষা ছুটি শেষে বিভাগে যোগ দেবেন। ওই শিক্ষকরা দাবি করছেন, বর্তমানে বিভাগে কোনো সেশনজট নেই। গত (২০১৩-১৪) শিক্ষাবর্ষের প্রথমবর্ষ থেকে এমএস পর্যন্ত সব কোর্সের শিক্ষা কার্যক্রম শেষের দিকে। তাঁরা আরো জানান, প্রায় দুই বছর ধরে একজন প্রভাষক অস্থায়ী পদে কর্মরত। তাঁর চাকরি এখনো স্থায়ী করা হয়নি। নিয়োগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মঞ্চের মুখপাত্র ও দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক বিভিন্ন পদে নিয়োগ পেতে পারেন। কিন্তু শিক্ষকের ক্ষেত্রে কখনো মুক্তিযোদ্ধা কোটা গুরুত্ব পেতে পারে না। অধিকতর যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে বিশেষ বিবেচনায় নিয়োগের সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আত্মঘাতী হবে।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সদস্যসচিব ও গণিত বিভাগের অধ্যাপক মো. শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করে আমরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি। উনি একটি বাজে নজির স্থাপন করলেন। এই নিয়োগের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম হুমকির মুখে পড়লে এর দায়ভার উনাকেই নিতে হবে।’
No comments:
Post a Comment